ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গৌতম পাণ্ডে

সিনেমায় মহাশ্বেতা দেবীর গল্প

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৪ আগস্ট ২০১৬

সিনেমায় মহাশ্বেতা দেবীর গল্প

সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর লেখনী নির্দিষ্ট কোন গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ, জ্ঞানপীঠসহ একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। তাঁর বাবা বিখ্যাত কবি মনীশ ঘটক জড়িত ছিলেন কল্লোল আন্দোলনের সঙ্গে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক তার কাকা। স্বামী নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যও ছিলেন ভারতে আইপিটিএ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। মহাশ্বেতা দেবী দেখেছেন নকশাল আন্দোলন ও তার পতন, লিপিবদ্ধ করেছেন তার গল্পে। জাত বিদ্বেষের অভিশাপকে সব সময়ই তার লেখনী দিয়ে আঘাত করেছেন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে ফকির সাধুদের নৃসংসতা তুলে ধরেছেন তার লেখায়। বর্ণপ্রথা নিয়ে তার এক একটি লেখা যেন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সারা ভারতজুড়ে নারী অত্যাচার আর ধর্ষণের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাগুলো তাকে নাড়া দিত সব সময়। মহাশ্বেতা দেবীর লেখনী ছিল শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক কণ্ঠ। দীর্ঘ এক বছর রোগে ভুগে চিরকালের জন্য চলে গিয়েছেন এই কিংবদন্তি নারী ব্যক্তিত্ব। তার লেখা ছোট গল্প কিংবা উপন্যাস নিয়ে তৈরি হয়েছে বেশকিছু সিনেমা। তেমনই কয়েকটি সিনেমা নিয়ে এ আয়োজন। ৮ ‘সাংঘার্শ’ (১৯৬৮) মহাশ্বেতা দেবীর ‘লায়লি আসমানের আয়না’ গল্প অবলম্বনে পরিচালক হারনাম সিং রাওউয়ালি নির্মাণ করেন ‘সাংঘার্শ’ সিনেমাটি। দিলিপ কুমার ও বৈজয়ন্তিমালা অভিনীত এ সিনেমাটি খুবই জনপ্রিয়তা পায়। বেনারসে ফকির ও সাধুদের মধ্যকার বিরোধ ও নির্মমতা নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী গল্পটি লিখেছিলেন। সে সময় ফকির ও সাধুরা ব্রিটিশদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যে সকল লুট-তরাজ ও হত্যাকা- চালাতো তারই প্রতিচ্ছবি এই সিনেমা। ৮‘রুদালি’(১৯৯৩) হিন্দু সমাজের জাত বিদ্বেষের অভিশাপকে আঘাত করে মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন ‘রুদালি’ গল্পটি। উঁচু জাতের কোন পুরুষের মৃত্যুতে ভাড়া করে আনা হতো নিম্নবর্ণের কোন নারীকে, যিনি সেই পুরুষের মৃত্যুতে অর্থের বিনিময়ে করতেন অশ্রু বিসর্জন। নিচুবর্ণের এই নারীদের রাজস্থানে ডাকা হতো ‘রুদালি’ নামে। নারীদের এই দুর্দশার চিত্র নিয়েই গল্পটি লিখেছিলেন তিনি। এ গল্পটিকে সেলুলয়েডে রূপ দেন কল্পনা লাজমি। ডিম্পল কাবাডিয়া অভিনীত ‘রুদালি’ একটি অসাধারণ সিনেমা। রাজস্থানের পটভূমিতে গড়ে উঠেছে এর কাহিনী। এই ছবির একটি অসামান্য দিক হলো, শত বঞ্চনা ও যন্ত্রণা সত্ত্বেও প্রান্তিক অবস্থানের নারীসঞ্চারির (ডিম্পল) চোখে কোন অশ্রু নেই। কেন্দ্রীয় চরিত্রে মানবিক এক অভিনয় দিয়ে সেবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলেন অভিনেত্রী ডিম্পল কাপাডিয়া। ৮ ‘হাজার চৌরাশি কা মা’(১৯৯৮) সত্তর দশকে কলকাতায় নকশালবাড়ি আন্দোলনে ছেলে হারানো এক মায়ের মর্মস্পর্শী কাহিনী নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাস। তখন চারু মজুমদারের ইশতেহারের ডাকে এ আন্দোলনে অন্যদের মতো কলেজ পড়ুয়া ব্রতীও যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বাড়িতে খবর এলো, সে ফিরেছে লাশ হয়ে। আদরের সন্তান ব্রতী নয় বরং হাজার চুরাশি নম্বর লাশের দায়িত্ব বুঝে নিতে বলা হয় তার মা সুজাতাকে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি লেখেন গল্পটি। সেই গল্প থেকেই ভারতে ১৯৯৮ সালে নির্মিত হয় ‘হাজার চৌরাশি কা মা’। প্রায় ১৮ বছর পর সেলুলয়েডের জগতে ফিরে শোকাহত সেই মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জয়া বচ্চন। কলকাতায় ষাট থেকে আশির দশকের মধ্যে বামপন্থী নকশালদের আন্দোলনে পুলিশি অত্যাচার এবং গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছিল এ রকম অসংখ্য তরুণ। গুমোট এই পরিস্থিতির বেদনাবহুল প্রেক্ষাপট পরিষ্কারভাবেই ধরা পড়েছিল জয়া বচ্চনের সুজাতা চ্যাটার্জি চরিত্রটিতে। গোবিন্দ নিহালানি নির্মিত ‘হাজার চৌরাশি কা মা’ সেবার পেয়েছিল সেরা ভারতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ৮‘মাটি মায়’ (২০০৭) মহাশ্বেতা দেবীর বর্ণপ্রথা নিয়ে আরেকটি গল্প অবলম্বনে মারাঠি নির্মাতা চিত্রা পালেকার নির্মাণ করেন ‘মাটি মায়’ সিনেমাটি। এতে পারিবারিক প্রথা বজায় রাখতেই গোরখোদকের পেশা বেছে নিতে হয় চান্দিকে। তার কোলে যখন আসে এক সন্তান, তখন লাশের কবর খুঁড়তে তার হাত কাঁপে। ছোট শিশুদের মৃতদেহগুলোকে দেখে গা শিউরে ওঠে তার। নিজের কাজ ছেড়ে দেবার আকাক্সক্ষা পোষণ করায় চান্দির ওপর নেমে আসে গ্রামবাসীদের অত্যাচার। নন্দিতা দাসের অনবদ্য অভিনয়ে ফুটে ওঠে সমাজের চাকচিক্যর আড়ালের অন্ধকার দিকটি। ৮‘গাঙ্গর’ (২০১০) মহাশ্বেতা দেবীর ‘চোলি কি পিছে’ গল্পটি লেখা হয় নারীদের ওপর অত্যাচার নিয়ে। গল্পটিতে ‘গাঙ্গর’ নামে সিনেমায় রূপ দেন ইতালিয় পরিচালক ইতালো স্পিনেলি। এক ফটোগ্রাফারের ক্যামেরার চোখ খুঁজে নেয় বাঙালী এক মা গাঙ্গরকে, যে বুকের দুধ পান করাচ্ছিল তার সন্তানকে। এ ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হওয়ায় হঠাৎই গাঙ্গরের জীবন হয়ে ওঠে নরক। এমনকি পুলিশ স্টেশনে তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় গণধর্ষণের শিকার হবার জন্য। নারীর প্রতি পুরুষ সমাজের নৃশংসতার এ গল্প প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে সিনেমাটিতে।
×