ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উপস্থিত থেকে পুরো অপারেশন মনিটর করার জন্য হলি আর্টিজানে উপস্থিত ছিলেন হাসনাত করিম ;###;অন্য দেশের নাগরিকদের আটক করা হলেও তার পরিবারকে কিছুই বলা হয়নি, বরং খুবই ভাল ব্যবহার করা হয় তাদের সঙ্গে

হত্যাকাণ্ডের সমন্বয়ক

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৩ জুলাই ২০১৬

হত্যাকাণ্ডের সমন্বয়ক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গুলশান হত্যাকা-ে আটককৃতদের পর্যায়ক্রমে টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আরও অনেককেই টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ইতোমধ্যেই বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে কয়েক দফায় টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। হাসনাতের সঙ্গে হত্যাকারীদের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত সংস্থাগুলো। গোয়েন্দাদের ধারণা, হাসনাত করিম সরেজমিন উপস্থিত থেকে গুলশান হত্যাযজ্ঞ মনিটরিং করেছে। তাকে পুরো হত্যাযজ্ঞের সমন্বয়ক হিসেবে ধারণা করছে তদন্ত সংস্থাগুলো। এদিকে, গুলশান হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে আরও তথ্য পেতে কমান্ডো অভিযানে নিহত জঙ্গীদের দেহ থেকে সংগৃহীত আলামতের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে ১৭ বিদেশীসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে জঙ্গীরা। হত্যার আগে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে বনানী থানার ওসি ও ডিবির এসি নিহত হন। শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডোরা হলি আর্টিজানে অভিযান চালান। অভিযানে ছয় জঙ্গী নিহত হয়। হত্যার দায় স্বীকার করে নিহত জঙ্গীদের মধ্যে পাঁচজনের ছবি প্রকাশ করে সাইট ইন্টেলিজেন্স। কমান্ডো অভিযানে নিহত অপরজন সাইফুল চৌকিদারও জঙ্গী ছিল বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনায় অনেককেই আটক করা হয়েছে। তাদের অনেককেই টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অনেককে টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আবার অনেককেই টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসনাত করিমসহ কয়েকজনকে কয়েক দফায় টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সূত্র বলছে, ঘটনার সময় বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম পরিবার নিয়ে রেস্তরাঁটিতে উপস্থিত ছিলেন। তাকে জঙ্গীরা কিছুই করেনি। এমনকি ন্যূনতম ধমক পর্যন্তও দেয়নি। অথচ জঙ্গীরা রেস্তরাঁয় প্রবেশের পরই ভারি অস্ত্রশস্ত্র বের করে সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। এর পর দেশী ও বিদেশীদের আলাদা করে। দেশীদের যে যে ফ্লোরে ছিল, সে ফ্লোরের বাথরুমে আটকে রাখে। অথচ হাসনাত করিম ও তার পরিবারের কাউকেই জঙ্গীরা আটকে রাখা তো দূরের কথা, তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছে। নম্র ভাষায় কথা বলেছে। দেশীদের মধ্যে দ্বিতীয় তলায় একটি বাথরুমেই নয়জনকে আটকে রেখে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল জঙ্গীরা। ঘটনার সময় হাসনাত করিম দিব্যি দোতলার ছাদে ঘুরেছেন। পরবর্তীতে জঙ্গীদের সহায়তাও করেন তিনি। তিনি তার মোবাইল ফোনে জার্মানির থ্রিমা এ্যাপস ডাউনলোড করেন। এ এ্যাপসের মাধ্যমে তার মোবাইল দিয়ে তোলা হত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক ছবি জঙ্গী কর্মকা- পর্যবেক্ষণকারী সাইট ইন্টেলিজেন্সের কাছে পাঠানো হয়। সাইট ইন্টেলিজেন্সই প্রথম হত্যার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে সাইট জানায়, তাদের যোদ্ধারা ২০ জনকে হত্যা করেছে। পরবর্তীতে কমান্ডো অভিযানের পর কয়েক ঘণ্টা ধরে ঘটনাস্থলে তল্লাশি চলে। ওই তল্লাশিতেও ২০ জনেরই লাশ উদ্ধার হয়। একটি লাশও কম-বেশি হয়নি। কমান্ডো অভিযান চালানোর অনেক আগে থেকেই ওই এলাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়ার পর জঙ্গীরা স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করে। তদন্তকারী সংস্থা বলছে, ধারণা করা হচ্ছে, হাসনাত করিমের সঙ্গে আগাগোড়াই যোগাযোগ ছিল। হাসনাত করিম বিষয়টি সবার দৃষ্টি এড়াতে পরিবার নিয়ে সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন। তবে হাসনাত করিমের পরিবারের অন্য সদস্যরা বিষয়টি আগে থেকেই জানতেন কি-না তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে ধারণা করা হচ্ছে, সরেজমিন উপস্থিত থেকে পুরো হত্যাকা- তদারকি করে থাকতে পারেন। সে সম্ভবনাই বেশি। হাসনাত করিমকে পুরো হত্যাকা-ের সমন্বয়ক বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাকে টিএফআই সেলে কয়েকজনের মুখোমুখি করা হয়েছিল। আরও কয়েকজনের মুখোমুখি করার জন্য প্রয়োজনী তথ্যউপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলছে। এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মোঃ মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন, গুলশান হত্যাযজ্ঞের মামলা তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট শুক্রবার ভোরে এফবিআই প্রতিনিধির কাছে কমান্ডো অভিযানে নিহত ছয়জনের দেহ থেকে সংগৃহীত নমুনা হস্তান্তর করে। গুলশান হামলায় জড়িত পাঁচ জঙ্গী ও এক সন্দেহভাজনের চুল এবং রক্ত পরীক্ষার আলামত হিসেবে এফবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, গত ২০ জুলাই বুধবার ওই ছয়জনের প্রত্যেকের দেহ থেকে দ্বিতীয় দফায় বিশ মিলিলিটার করে রক্ত ও ত্রিশটি করে চুল সংগ্রহ করা হয়েছিল। মামলা তদন্তের স্বার্থেই দ্বিতীয় দফায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর আগে নিহতদের দেহ থেকে পাঁচ মিলিলিটার রক্ত, ঊরুর মাংস ও দাঁত সংগ্রহ করা হয়। দ্বিতীয় দফায় মামলার তদন্তকারী সংস্থা আরও নমুনা সংগ্রহের কথা জানায়। দ্বিতীয় দফায় নমুনা সংগ্রহ করে তা তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গীরা নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর আগে শক্তিবর্ধক বা উত্তেজক কোন মাদক গ্রহণ করে থাকতে পারে। বিশেষ করে জঙ্গীরা নৃশংস হত্যাকা- চালানোর আগে ক্যাপ্টাগন নামের একটি মাদক গ্রহণ করছে বলে নানাভাবে আলোচিত হচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে এবং হত্যাকা-ের ধরন, হত্যাকারী, ব্যবহৃত অস্ত্র-গোলাবারুদসহ নানা বিষয়ে তথ্য পেতেই দ্বিতীয় দফায় সংগৃহীত আলামত ও নমুনা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নমুনাগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের ডিএনএ ল্যাবরেটরিতেই পরীক্ষা করার কথা রয়েছে। পরীক্ষা শেষে তারা এ বিষয়ে রিপোর্ট দেবে তাদের। জঙ্গীদের লাশ ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হিমঘরে রাখা আছে। সম্প্রতি দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গণমাধ্যমে আইএস জঙ্গীরা ক্যাপ্টাগন নামের বিশেষ মাদক ব্যবহার করছে বলে প্রকাশিত হয়েছে। মাদকের নেশায় দিনের পর দিন আইএস জঙ্গীরা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বলেও গোয়েন্দা ও সমর বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ষাটের দশক থেকেই পশ্চিমা দেশগুলোতে ক্যাপ্টাগন পাওয়া যায়। শুরুতে বিষণœতা কাটানোর চিকিৎসায় এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। পরবর্তীতে এটি মাদক হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মধ্যপ্রাচ্যজুড়েই এখন ক্যাপ্টাগনের দাপট চলছে। বর্তমানে সিরিয়া ক্যাপ্টাগন নামক মাদকটির বড় উৎস। অনেক দেশে মাদকটি পাচার হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশেই ক্যাপ্টাগন নিষিদ্ধ। মেডস্টার ওয়াশিংটন হসপিটাল সেন্টারের চিকিৎসক রবার্ট কিসলিং আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমকে বলেছেন, ক্যাপ্টাগনের নেশায় একজন মানুষ দিনের পর দিন জেগে থাকতে পারে। ভাললাগার অনুভূতি আর চরম আনন্দ জাগায় মনে। সেবনকারীরা নিজেকে অপরাজেয় মনে করে। কেউ তাকে কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ক্যাপ্টাগনের এ জাদুকরী প্রভাবই যুদ্ধের ময়দানে জঙ্গীদের জাগিয়ে রাখার পাশাপাশি উগ্র মতবাদ লালনের শক্তি যোগাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
×