ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

বাংলার নারীদের এগিয়ে চলা

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ১৫ জুলাই ২০১৬

বাংলার নারীদের এগিয়ে চলা

বাঙালী নারীদের জাগরণের ঈঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের জাতীয়সত্তার এ দুই মুক্তির সংগ্রামে নারীদের অসীম ত্যাগ, সাহস এমনকি পুরুষদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। তারপর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে পুরুষতান্ত্রিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে মোকাবেলা করে নারীরা স্বগর্বে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির সোপানে। যার সুফল আসছে ঘরে বাইরে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে। কাজেই বাঙালী নারীরা ঘর-সংসার, রান্না-বান্না আর স্বামী-সন্তান, শ্বশুরালয়ের সেবাযতেœ জীবন পার করার সেই দিন এখন আর নেই। বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে না নিলেই ভাল। কেননা, দিন অনেক বদলে গেছে। বাংলার নারীরা এখন পুরুষদের সমানতালে অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সামলিয়েও আগের মতোই ঘর-সংসার আর সেবা-যতেœর সব তাল ঠিক রাখছে। এই ধরুন প্রায় শতবর্ষ পূর্বে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন উন্নয়নে নারীদের অংশীদারিত্বের যে পথ দেখিয়ে গেছেন সেই পথ ধরেই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অধিষ্ঠিত হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বদল হয়েছে। তাই পুরুষদের সহযোগিত নিয়ে আজ সবখানে নারীর ভূমিকা প্রায় সমানে সমান। কোথায় নেই নারীর স্বগর্ব অবস্থান- শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনীতি, বাণিজ্য থেকে শিল্প কর্ম, সাংবাদিকতা থেকে বৈমানিক, ঝুঁকিপূর্ণ মিশন থেকে সেবা ধর্মে সবখানেতে আছে নারীর সমুজ্জল ভূমিকা। আমাদের জানা আছে বাংলাদেশে কৃষি ও শিল্প শ্রমে নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। এখন আর গৃহকর্মে বাঙালী নারীর সুনিপুণতা কিংবা সাহিত্যে সৃজনী পদচারণায় সীমাবদ্ধ নয়Ñ এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশে নারীর শ্রমই অন্যতম নিয়ামক শক্তি। আধুনিক সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে নারীদের দৃষ্টিভঙ্গিও। তারই প্রতিফলন সাধারণ পেশার বাইরে চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত হয়ে নারীরা বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছে। অর্থ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মাস্টার কার্ডের ‘মাস্টার কার্ড ইনডেক্স অব উইমেনস এ্যাডভান্সমেন্ট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের নারীরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে। ২০১৪ সালে ইনসিডিন বাংলাদেশ নামের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক জরিপে উল্লেখ করা হয়Ñ বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান কেবলই বাড়ছে। সেখানে আরও বলা হয়, গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান বিশেষত কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে ৫৩ শতাংশ আর পুরুষের অবদান ৪৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছেÑ বর্তমানে ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছে। ষোল কোটি মানুষের দেশে নারীদের এই বিশাল অংশের কর্মক্ষম ভূমিকা জাতীয় অর্থনীতির চাকাতে গতিময় রাখছেÑ এটাই বাস্তবতা। এ কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে, নারীদের শিক্ষা ও দক্ষতা যত বাড়বে পেশাদারিত্বে দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ এবং দেশের উন্নয়নে নিজেদের মেধাকে ততই কাজে লাগাতে পারবে। তারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশে। নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, ঝরে পড়ার হার কমে যাওয়া সহ শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালের পর থেকেই দেশের নারী শিক্ষায় ইতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে। মেয়েদের শিক্ষার চাহিদা, অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ে দেশে যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে তার মধ্যে ৫০ শতাংশ ছাত্রী। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীর সংখ্যা ৫৩ শতাংশ এবং কলেজ পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৭ শতাংশ ছাত্রী। বর্তমানে সরকারী চাকরির মধ্যে নারী মাত্র ২৪ শতাংশ। তবে প্রাইমারি স্কুলের চাকরিতে এ হার ৬০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ৩৩ শতাংশ। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের এই অংশগ্রহণের সুফল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অচিরেই আরও প্রভাব বিস্তার করবে। নারীদের কোন অজুহাতেই দমিয়ে না রেখে বরং তাদের সহযোগিতা করলে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের পরিবর্তনের ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটবে। চারপাশে বিদ্যমান নানামাত্রিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছেন বাংলাদেশের নারীরা। সার্ক অঞ্চলে বিভিন্ন দেশে নারীনিগ্রহের তুলনায় অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, নারীদের উন্নয়নে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া এবং নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশের বেসরকারী সেক্টরে মূলধারার অর্থনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছেন নারী উদ্যোক্তারা। নারীরা তাদের শিক্ষা, মেধা আর সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে ছোট-মাঝারি ও বড় শিল্প গড়ে তুলছেন। পোল্ট্রি, দুগ্ধখামার, ফিশারি, পাটপণ্য উৎপাদন, বুটিক, হ্যান্ডিক্রাফটস, আইসিটি ফার্ম, অনলাইন বিপণন থেকে শুরু করে নতুন নতুন সৃজনী এমনকি উদ্ভাবনী ক্ষেত্রে সফলতার অনন্য স্বাক্ষর রাখছেন। তাদের এসব উদ্যোগের ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং নতুন নতুন পণ্য বাজারও সৃষ্টি হয়েছে। এসব কিছুই আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পেছন থেকে শক্তি যোগাচ্ছে। নারী বিপ্লবের বড় ক্ষেত্র পোশাকশিল্প। এই শিল্পে ৩০ লাখ নারী শ্রমিক কাজ করছেন। বিবিএসের সমীক্ষা বলছে- বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ নারী-পুরুষ কোন না কোনভাবে কাজে সম্পৃক্ত। দেশের কল কারখানায় পুরুষের চেয়ে এক লাখ বেশি নারী শ্রমিক কাজ করেন। বিভিন্ন কারখানায় বর্তমানে ২১ লাখ ১ হাজার ৮৩০ জন নারী শ্রমিক রয়েছেন। দেশে কল কারখানার সংখ্যা অন্তত ৪২ হাজার, এরমধ্যে ২ হাজার ১৭৭টি ক্ষুদ্র মাঝারি ও বড় কারখানার মালিক নারী। এই সাফল্যও কম নয়। বাংলাদেশে ১ কোটি ৬ লাখ লোক গৃহস্থালির কাজ করেন। তাঁদের সিংহভাগই নারী, যাদের শ্রমের মূল্য হিসেবের খাতায় আসে না। সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছেÑ পরিবার পরিপালন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যাসহ সংসার ও আবাসকে গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে নারীর নীরব অবদানের অর্থমূল্য ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। সুতরাং দেশের উন্নয়নে নারীর ভূমিকা বহুমাত্রিক এতে কোন সন্দেহ নাই।
×