ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার অলঙ্কার লালবাগের কেল্লা

মোগলদের নিপুণ স্থাপত্য শৈলী, বেড়ানো ও ইতিহাস পাঠ একসঙ্গে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৩ জুলাই ২০১৬

মোগলদের নিপুণ স্থাপত্য শৈলী, বেড়ানো ও ইতিহাস পাঠ একসঙ্গে

মোরসালিন মিজান ॥ এই অঞ্চলের দীর্ঘ ইতিহাস। কত কত রাজা বাদশা সম্রাটরা শাসন করেছেন! কিন্তু মোগলদের নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। ঘটনাবহুল শাসনকালের নানা স্মৃতিচিহ্ন গোটা ভারতবর্ষজুড়ে ছড়িয়ে আছে। আর রাজধানী ঢাকায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে লালবাগ দুর্গ অদ্ভুত সুন্দর স্থাপনা দেখে চোখ সত্যি জুড়িয়ে যায়। এত বড় শহরে অসংখ্য স্থাপনা। আধুনিক স্থাপত্য শৈলী। এরপরও দেখামাত্র লালবাগ দুর্গকে আলাদা করে ফেলা যায়। এখানে প্রতিদিন ভিড় লেগে থাকে দর্শনার্থীদের। ঈদ উপলক্ষে ভিড় বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে। একইসঙ্গে চলছে বেড়ানো ও ইতিহাস পাঠ। মোগল আমলে নির্মিত দুর্গটি পুরান ঢাকার লালবাগে অবস্থিত। নামটি মূলত কেল্লা আওরঙ্গাবাদ। বর্তমান পরিচিতি লালবাগ কেল্লা হিসেবে। কেল্লার চত্বরে রয়েছে দরবার হল ও হাম্মাম খানা। আছে পরী বিবির সমাধি এবং শাহী মসজিদ। লালবাগ দুর্গ নির্মাণের সঙ্গে যে নামটি বিশেষভাবে যুক্ত সেটি শাহজাদা আজম শাহ। তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পিতার নামে ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে এ দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনি। ঢাকার সুবেদারের বাসভবন হিসেবে এটি ব্যবহারের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য সম্রাট তাঁকে দিল্লী ডেকে পাঠান। এ সময় দুর্গ নির্মাণ কাজ থেমে যায়। এরপর নবাব শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে সুবাদার হয়ে ঢাকায় এসে পুনরায় দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তবে এবারও নির্বিঘ্নে এগোতে পারে না। শায়েস্তা খানের স্নেহের কন্যা পরী বিবির অকাল মৃত্যু হয় এখানে। পরী বিবিকে দরবার হল এবং মসজিদের ঠিক মাঝখানে সমাহিত করা হয়। পরী বিবির সঙ্গে শাহজাদা আজমের বিয়েও ঠিক হয়েছিল। কিন্তু সেটি আর হয়নি। পরী বিবির অকাল মৃত্যুর কারণে অনেকে এ দুর্গকে অপয়া জ্ঞান করতে শুরু করেন। অভিন্ন বিশ্বাস থেকে শায়েস্তা খান ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে দুর্গের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। শায়েস্তা খাঁ দরবার হলে বসে প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করতেন। ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ অবসর নিয়ে আগ্রা চলে যান। দুর্গের মালিকানা বুঝে পায় তাঁর উত্তরাধিকারীরা। তবে শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ছাড়ার পর নানা কারণে লালবাগ দুর্গের গুরুত্ব কমতে থাকে বলে জানা যায়। ১৮৪৪ সালে ঢাকা কমিটি নামে একটি আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠান দুর্গের উন্নয়ন কাজ শুরু করে। মূলত এ সময় দুর্গটি লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮ একর বিস্তৃত দুর্গ এলাকায় খনন কাজের ফলে ২৬ থেকে ২৭টি কাঠামোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। একই সময় আবিষ্কৃত হয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ছাদ-বাগান ও ঝর্ণার ধ্বংসাবশেষ। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর কর্তৃক সংস্কারের পর লালবাগ দুর্গ বর্তমান চেহারা পেয়েছে। দুর্গের একটি ভবন সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রিয় কন্যা পরী বিবির সমাধি নামে পরিচিত। বাংলাদেশে এই একটি মাত্র ইমারতে মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রঙের ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলঙ্কৃত করা হয়েছে। কক্ষগুলোর ছাদ কষ্টি পাথরে তৈরি। মূল সমাধি সৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের ওপরের কৃত্রিম গম্বুজটি তামার পাত দিয়ে আচ্ছাদিত। ২০.২ মিটার বর্গাকৃতির এই সমাধিটি ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে নির্মিত। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমতÑ এখানে পরী বিবির মরদেহ নেই। জানা যায়, লালবাগ দুর্গ বেশ কিছুকাল অবহেলায় অযতেœ পড়েছিল। ১৮৯৬ সালে বিখ্যাত শিল্পী ও পর্যটক ড’য়লীর আঁকা একাধিক ছবিতে ফোটে ওঠে সে চিত্র। ছবি দেখে বোঝা যায়, দুর্গটি তখন পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। অযতেœ অবহেলায় নষ্ট হচ্ছিল। দুর্গের দেয়ালে ঘন ঘন ফাটল। সেখানে আগাছা। ঘন বন। এ অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে উত্তোরণ ঘটে। ১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়। নির্মাণের ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয়। হাবিবুর রহমানের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আদিতে দক্ষিণ প্রাচীরে পাঁচটি প্রতিরক্ষা বুরুজ ছিল। পশ্চিম প্রাচীরে ছিল দুটি। সর্ববৃহৎ বুরুজটিতে ভূগর্ভস্থ টানেল অন্তর্ভুক্ত ছিল। দক্ষিণ প্রাচীরের পাঁচটি বুরুজের মধ্যে কেন্দ্রীয়টি একতল বিশিষ্ট কাঠামো। বাকিগুলো দ্বিতল। কেন্দ্রীয় বুরুজটিতে তিন দিকে বারান্দাসহ একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষ আছে এবং এটিতে হয় নদীর দিক দিয়ে অথবা এর ছাদের ওপর দিয়ে প্রবেশ করা যেত। দুর্গের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের দ্বিতল বুরুজটির ছাদে জলাধার ছিল। সম্ভবত এটি ছিল একটি হাওয়াখানা। পোড়ামাটি নির্মিত দুটি পানির পাইপ পাওয়া গেছে। এগুলোর মাধ্যমে এ জলাধারের সঙ্গে দুর্গের সবকটি ভবনের সংযোগ ছিল। দক্ষিণ দুর্গপ্রাচীরের সমান্তরালে আস্তাবল থেকে পশ্চিমমুখী স্থানটিতে প্রথম দিকে ঝর্ণা, গোলাপ ও তারা নকশার মালঞ্চ, জলাধার ও নয়নাভিরাম ছাদ-বাগান ছিল। এখন অনেক কিছুই নেই। এর পরও যা আছে, দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। লালবাগ দুর্গ সম্পর্কে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের মূল্যায়নটি উল্লেখ করার মতো। এ সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর বলাটি এরকমÑ ‘কোন কোন শহরের একটি প্রতীক থাকে যার উল্লেখ করলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সে শহর। যেমন, আইফেল টাওয়ার বললে প্যারিস বা বিগবেন বললে লন্ডন। লালবাগও তেমনি একটি প্রতীক, যার কথা বললে মনে পড়ে ঢাকা শহর।’ সঙ্গত কারণেই দর্শনার্থীদের বিশেষ আকৃষ্ট করে রেখেছে ঐতিহাসিক এ স্থাপনা। প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ লালবাগের কেল্লা দেখতে আসছেন। বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে প্রতিদিনই এখানে ভিড় লেগে ছিল। ঈদ শেষ হলেও কৌতূহলীরা নিয়মিত আসছেন। মঙ্গলবার দুর্গ ঘুরে দেখা যায়, বহু দর্শনার্থী। বিশাল এলাকার পুরোটা ঘুরছেন। খুঁটিয়ে দেখছেন। জানার চেষ্টা করছেন ইতিহাসটি। চাঁনখারপুল থেকে সপরিবারে কেল্লা দেখতে এসেছিলেন আমিনুল ইসলাম। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমি একটি কলেজে পড়াই। ঐতিহাসিক যে কোন স্থাপনা আমাকে টানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এখানে বন্ধুরা মিলে এসেছি। আজ আসলাম ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে। ওদের কেল্লা ঘুরিয়ে দেখানোর পাশাপাশি ইতিহাসটাও জানানোর চেষ্টা করছি। তিন বন্ধু তিশা, রাব্বি ও তুহিন এসেছিলেন প্রথমবারের মতো। তিশা বললেন, লালবাগ কেল্লার কথা সেই ছোটবেলায় পাঠ্য বইয়ে পড়েছি। কিন্তু কোনদিন আসা হয়নি। আজ অন্য দুই বন্ধু উদ্যোগটি গ্রহণ করে। আমিও রাজি হয়ে যাই। এর পর থেকে তো বিস্ময়ই কাটছে না!
×