ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১৪ জুন ২০১৬

খোশ আমদেদ মাহে  রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বারতাবাহী পবিত্র মাহে রমজানের আজ ৮ম দিবস। আত্মশুদ্ধির মাস, আত্মপোলব্ধির মাস, কৃচ্ছ সাধনের মাস রমজান। আরবী ‘রমজ’ থেকে ‘রমজান’ শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ দহন বা পোড়ানো। এ মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ নিজের সমুদয় দুনিয়াবী কামনা-বাসনাকে বিসর্জন দিয়ে ষড়ঋপু দমন করে মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ পাকের একনিষ্ঠ অনুগত হওয়ার শক্তি সঞ্চয় করে। এ মাস মানুষের সমস্ত আমিত্ব, কুপ্রবৃত্তি, খোদাদ্রোহিতা ও নফসের দাসত্ব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বলে এ মাসের নাম হয়েছে ‘রমজান’। ‘সিয়াম’ অর্থ বিরত থাকা বা পরিত্যাগ করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় সিয়াম মানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (স) নির্দেশ মোতাবেক সুবেহসাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহ যাবতীয় পানাহার ও যৌন ক্রিয়াকর্ম থেকে বিরত থাকা। অবশ্য এটা হলো রোজা বা সিয়ামের দৈহিক দিক। আরও ব্যাপক অর্থেÑ যাবতীয় অবৈধ কাজ হতে বিরত থাকা ও অসৎ ভাবনা হতে মুক্ত থাকা হলো রূহের সিয়াম সাধনা। এরও উর্ধে রয়েছে সিয়ামের আরেক পর্যায়। তা হলো একমাত্র আল্লাহ্ ব্যতীত আর সবকিছু হতে হৃদয়-মন মুক্ত রাখা। অন্তরে একমাত্র অন্তর্যামীকে স্মরণ করতে হবে। অন্য কিছুর স্থান থাকবে না। আল্লাহ ব্যতীত আর কিছুর প্রতি মন যাবে না। এরূপ সিয়াম পালন হলো আল্লাহ্র খাস বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। রোজার এ তাত্ত্বিক ব্যাপারে ইশারা করতে গিয়েই মহানবী (স) ইরশাদ করেছেনÑ যে ব্যক্তি রমজানে রোজা পালন করতে গিয়ে রোজার সীমারেখা বুঝে নেবে এবং যে কর্তব্য রোজার ভেতর পালন করা বাঞ্ছনীয়, তা সুচারুরূপে পালন করে চলবে, তার এরূপ রোজা তার বিগত গুনাহের ক্ষমার কাফফারা হবে। -(বাইহাকী: ৪/৩০৪)। অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছেÑ মান সোয়ামা রমাজানা ওয়া ক্বা মাহু ঈমানান ওয়া ইহতিসাবা গুফিরা লাহু মা তাক্বাদ্দামা মিন জামবিহি; অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি রমজানে রোজা এবং এর রাতে নামাজ আদায় করবে পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখে এবং আত্ম সমালোচনার মাধ্যমে পূণ্যলাভের প্রত্যয়ে, তার অতীতের গুণাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (তিরমিজী ৩/৭৬)। এখন এ গুরুত্বপূর্ণ জীবন গড়ার মাস আমরা পেলাম, অথচ এর হক ও করণীয়গুলোর ব্যাপারে আমরা উদাসীন্য প্রদর্শন করলাম তা অত্যন্ত দুঃখজনক। একজন প্রকৃত আল্লাহর বান্দা খালিস দিলের মুসলমানের উচিত এটাকে সদ্ব্যবহার করা এবং এর যথার্থ কল্যাণ হাসিল করে নিজের জীবন-মন ধন্য করা। আর এ জন্যই আমাদের রমজানের প্রথম থেকেই সজাগ সচেতন হতে হবে। রাসূলে মাকবুল (স) শাবানের শেষের দিকে সাধারণ মানুষদের রমজান মাসের করণীয় ও পালনীয় সম্পর্কে সজাগ ও উৎসাহিত করে তুলতেন। রমজানের আসল মাকসুদ যাতে আমাদের ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হতে পারে সেদিকে আমাদের সকলকে হতে হবে আন্তরিক। এ ব্যাপারে জাতি-ধর্ম-প্রশাসন সবার সমান দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। রমজান মাসকে সফল ও সার্থক করে নিতে হলে আমাদের শুরু হতে প্রতিদিনের চব্বিশটি ঘণ্টাকেই একটা নিয়মের মধ্যে ফেলতে হবে। শুধু উপোস থাকার ব্যবস্থা করলাম অথচ ধর্মের অন্যান্য কাজ যেমন- নামাজ ঠিকমতো পড়লাম না, যাকাত যথানিয়মে দিলাম না, বাকি এগারো মাসের মতোই অন্যায়, অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকলাম, ব্যবসা-বাণিজ্যে, লেনদেনে মানুষকে ঠকানো কিংবা কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকলাম নাÑ তাহলে এ রোজা পালন যথার্থ নয়। রাসূলুল্লাহ (স) তো স্পষ্টই বলে দিয়েছেনÑ ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা বলা ও খারাপ কাজ হতে বিরত থাকে না, আল্লাহ্ তাকে ভূখা রেখে অনাহারে রেখে কোনরূপ কষ্ট দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না।’ আসলে অন্যান্য এগারো মাসের তুলনায় সিয়ামের মাসের আমল ও দিবারাত্রি উদযাপন বেশ স্বতন্ত্র বৈকি। গোটা মাসটি যেন ট্রেনিং পিরিয়ড। হক হালালের মাধ্যমে সেহ্রি ও ইফতার গ্রহণ কষ্টকর হলেও তারাবির নামাজ আদায়, মিথ্যা অসত্য থেকে সারাক্ষণ বিরত থাকার নিরন্তর প্রচেষ্টা সব মিলিয়ে একটি ব্যাপকতর পরিবর্তনের সতর্ক প্রয়াস। এর মধ্যেই বিকশিত হয় একজন প্রকৃত মুমিনের আসল ভাবমূর্তি। এ যেন মানুষ থেকে মুমিন, মুমিন থেকে মুত্তাকীতে উত্তীর্ণের সিঁড়ি। তাই আসুন আমরা এ মহান মাসের পবিত্রতা রক্ষায় সচেতন হই এবং নিজেরা পরিশুদ্ধ জীবন গড়ার কাজে ব্রতী হই।
×