ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

আমার দেখা অন্য এক আলী

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১৩ জুন ২০১৬

আমার দেখা অন্য এক আলী

বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকাটি হাতে পেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে তার প্রথম প্রশ্নÑ এই ফ্ল্যাগ কি আমি আমার মোটরগাড়িতে উড়িয়ে রাস্তায় চলতে পারব? ঢাকার সেগুন বাগিচার কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত জবাব ছিলÑ নিশ্চয়ই পারবেন! এমন কথা শুনে তিনি খুশিতে এতই ডগমগ হয়ে পড়লেন কে বিশ্বাস করবে এই ব্যক্তি মুহাম্মদ আলী- দ্য গ্রেটেস্ট! বালকোচিত আনন্দে প্রায় হাততালি দেয়ার কায়দায় বলে উঠলেন- বাহ্ তাহলে তো আমাকে এরপর পথে পথে ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকতে হবে না। কারণ আমি দেখেছি ভিড়ের ভেতর দিয়ে কূটনীতিকদের পতাকাওয়ালা গাড়ি নির্বিঘেœ চলাচল করতে ট্রাফিক পুলিশের পথ করে দেয়া। বাংলাদেশে অবস্থানের সময় আলীকে নিযুক্তি দেয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ অনারারি কনসাল জেনারেল পদে। সেই মর্মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বাংলাদেশের পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে যখন তাকে হস্তান্তরিত করা হলো তখন তিনি একাধারে যেমন হয়েছিলেন অভিভূত তেমনি পুলকিত। তারপর অচেনা কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি কখনও আমেরিকা থেকে বের করে দেয়া হয় তবে আমার আর একটি দেশ রইল।’ হয়ত তখন দুই চোখে ভিড় করেছিল তদানীন্তন মার্কিন সরকারের আদেশে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে তার অস্বীকৃতি, পরিণামে জেলে যাওয়া ও মুষ্টিযোদ্ধার খেতাবটি পর্যন্ত কেড়ে নেয়ার বেদনা ভারাক্রান্ত দিনগুলোর কথা। আজ থেকে ৩৮ বছর আগের এই ঘটনাটি ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের। সে সময় বিশ্ববরেণ্য হেভি ওয়েট চ্যাম্পিয়ন মুহাম্মদ আলী সফর করছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার ছোট এক দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এই সফরে সঙ্গে ছিলেন পিতা ক্যাসিয়াস মারসিলাস ক্লে, মাতা ওডেসা গ্রেডি ক্লে, ভাই রহমান আলী, স্ত্রী ভেরোনিকা এবং কন্যা লায়লা আলী। একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট বাংলাদেশের মানুষ তাকে জানিয়েছিল বিপুল সম্মান। বঙ্গভবনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আলীকে প্রদান করা হয়েছিল বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব। সেদিন সেখানে এক বুফে আয়োজনে পরিবেশিত হয়েছিল দেশের বিখ্যাত রকমারি মিষ্টি। আর এসব মিষ্টি দারুণভাবে পছন্দ করেছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানে দেখেছি কি সাগ্রহেই না তিনি চাচ্ছেন পরিবেশিত অমন খাবারগুলো। রসগোল্লা ও সমুসা তার কাছে এতই সুস্বাদু লেগেছিল যে, সফরসঙ্গী বাবা, মা, ভাই ও স্ত্রীকেও অনুরোধ করছিলেন এগুলো খেয়ে দেখতে। এরপর দেখলাম ওরাও সেসব খেয়ে প্রশংসা করতে লাগলেন অনেক। বুফের মাঝেই আমন্ত্রিতদের কেউ কেউ তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। ছবি তুলছিলেন বঙ্গভবনের ফটোগ্রাফার খসরু। আমি এক ফাঁকে প্রশ্ন করলাম- কেমন লাগছে বাংলাদেশ? চোখেমুখে খুশি আর সারল্যের সহজাত আভা ছড়িয়ে জানিয়েছিলেন- খুব, খুউব ভাল। তিনি শুধু দেখতে একজন সুন্দর মানুষ নন, তার অন্তরটিও ছিল সুন্দর। যে সময়টা মুহাম্মদ আলী বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলেন পূর্বেই বলেছি সেটি ১৯৭৮ সাল। তার আগে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব অক্ষুণœ রাখার লড়াইয়ে সামান্য ব্যবধানে হেরে গিয়েছিলেন লিওন স্পিন্কসের সঙ্গে। সে ফলাফলে এক শ্রেণীর মিডিয়া রোষভরে মন্তব্য করছিল এই বিচার বক্সিং জাজদের পক্ষপাতদুষ্ট। এহেন প্রচারে দুনিয়াজোড়া আলীর ভক্তরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন ভীষণভাবে। কিন্তু আলী কি বলেছিলেন সে সময়? আমরা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছি তার সত্যবাদী চরিত্রের অসাধরণ রূপ। এক আন্ডারডগের কাছে পরাজিত হয়ে বিশ্ব মুকুট হারিয়ে ফেলায় তিনি তখন আক্ষরিক অর্থেই বিধ্বস্ত ও বিমর্ষ। তার চোখে ছিল কালো চশমা। এটা কেবল ফেব্রুয়ারির রোদের জন্য নয়, স্পিন্কসের ঘুষির কালো আঘাত চিহ্নটাও ছিল চোখে। বাংলাদেশে আগমনের বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেই লড়াইয়ের আগেই। পরাজয়ের চিহ্ন ভরা মুষ্টি নিয়ে আমাদের কাছে আসবেন কিনা তা নিয়ে দোটানায় পড়লেন যেন। তিনি জানেন বীরভোগ্যা বসুন্ধরা- এ পৃথিবীর পরাজিতরা কখনও নায়ক নন। বাংলাদেশের জনগণ এমন দুর্ভাগ্যের সময় তাকে কেমনভাবে বরণ করবে এটাই ছিল তার দুশ্চিন্তার কারণ। তারপরেও সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে মুহাম্মদ আলী বাংলাদেশে আগমনের উদ্দেশ্যে সপরিবারে প্লেনে চেপেছিলেন। আর তিনি দেখেছিলেন তাকে সংবর্ধনা জানাতে কিভাবে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ সেদিন উপস্থিত হয়েছিলেন বিমানবন্দরে। সে সময় আজকের শাহজালাল বিমানবন্দর নির্মিত হয়নি। তিনি অবতরণ করেছিলেন ঢাকার তেজগাঁওয়ের ক্ষুদ্র সেই বিমানবন্দরে। দীর্ঘ প্লেন ভ্রমণে ক্লান্ত ও বিমর্ষ আলী ভিআইপি লাউঞ্জে যখন প্রবেশ করলেন তখন উপস্থিত আমরা কেউ চিরপরিচিত প্রজাপতির মতো চঞ্চল এবং বাকপটু আলীকে যেন চিনতেই পারছিলাম না। এরপর ঘটেছিল একটি অভূতপূর্ব ঘটনা, যখন তিনি মুখোমুখি হলেন দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের। শুধু মনে পড়া নয়, সেটি স্মৃতিপটে আজও লেখা আছে সোনালি অক্ষরে। সাংবাদিকদের মধ্যে কেউ জানতে চাইলেন ‘স্পিন্কসের সঙ্গে বক্সিং প্রতিযোগিতায় আলীকে কি জোর করে হারিয়ে দেয়া হয়েছে?’ কিন্তু তার জবাব দেয়ার আগেই পেছনে ডানপাশে দাঁড়ানো সফরসঙ্গী যিনি আলীর ভাই উচ্চৈঃস্বরে বারবার বলতে লাগলেন- হ্যাঁ তাকে হারানো হয়েছে, হারানোই হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হলো অন্য সফর সঙ্গীদের মিলিত কণ্ঠও। মুহাম্মদ আলী কেন এক বিস্ময় সৃষ্টিকারী মানুষ সে কথা বুঝলাম তার প্রতিক্রিয়ায়। বাল্য বয়সে তার সাইকেলটা চুরি হলে অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবে চোরকে পিটিয়ে তুলোধুনো করার জন্য আলীর মুষ্টিযুদ্ধ শেখার শুরু এবং তাতে তিনি অবিচল থেকেছেন সারাজীবন। সঙ্গীদের মন্তব্য শুনে আলী তখন প্রতিবাদে দু’দিকে মাথা নাড়তে লাগলেন। এরপর ভাই ও অন্যদের উচ্চৈঃস্বরে এক ধমকানি দিয়ে বললেন- না আমাকে হারানো হয়নি, আমি আসলেই লড়াইয়ে হেরে গেছি। এর পরেও সঙ্গীরা প্রতিবাদ করে চলছিল আর দি গ্রেট দৃঢ়তার সঙ্গে আবার বলে চলছিলেনÑ ‘আমি ওই লড়াইয়ে হেরে গেছি, আমাকে হারানো হয়নি।’ সে সময়ের একটা মজার ঘটনার কথা বলি। বিশ্ব কাঁপানো মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলী যে বাংলাদেশে এসে হঠাৎ এক কিশোরের পাঞ্চে পরাভূত হয়ে গিয়েছিলেন এমন কথা কি দুনিয়া বিশ্বাস করবে? লিওন স্পিন্কসের সঙ্গে তীব্র লড়াই করে অবশেষে হার হয়েছিল যার তিনি কুপোকাত হবেন এক ক্ষুদের দশাসই ঘুষিতে? কিন্তু আমরা ওইদিন দেখেছিলাম সেই ঘটনা। সেদিন পল্টনে অবস্থিত ঢাকা স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক। আলী চোখে কালো চশমা সাদা শার্ট পরে যখন সেখানে প্রবেশ করলেন তখন বিপুল করতালির মাধমে তাকে স্বাগত জানালেন হাজার হাজার দর্শক। মাঠের মাঝখানে স্থাপন করা বক্সিং রিংয়ের কর্মকর্তা, রেফারি, প্রতিদ্বন্দ্বী, সবাই প্রস্তুত আর গোটা গ্যালারির দৃষ্টি নিবদ্ধ সেদিকেই। রিংয়ে প্রবেশ করলেন মুহাম্মদ আলী ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী ১২ বছর বয়সী এক বাংলাদেশী কিশোর। লড়াইয়ে শুরুতেই আলী দেখালেন তার সেই দুনিয়া মাতানো পরিচিত প্রজাপতি নৃত্য। তবে প্রতিদ্বন্দ্বীও কিন্তু কম গেল না- আলীর সঙ্গে সমান তালে নাচের মতোই লড়ছে সে এবং লড়তে লড়তে আচমকা ধম করে মুহাম্মদ আলীকে লাগিয়ে দিল এক পাঞ্চ। তাই তো এক্কেবারে কুপোকাত হয়ে বীর আলী পড়ে গেলেন মঞ্চে। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্যে উল্লাসে ফেটে পড়ল সারা স্টেডিয়াম। তিনি যে আসলে গ্রেট সেটা বোঝা গেল যখন তিনি অভিনয় করে দেখালেন কিশোরের ঘুষি খেয়ে তিনি কত কাতর হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। এরপর বহু কষ্টে ভূমিশয্যা থেকে যেন কোনমতে উঠে দাঁড়ালেন। আর এভাবেই দ্য গ্রেটেস্ট মাতিয়েছিলেন গ্যালারি ভর্তি দর্শকদের । এই সফরের সময় তিনি উদ্বোধন করেছিলেন ঢাকার মুহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম। মুহাম্মদ আলী গিয়েছিলেন সিলেটের চা বাগান, সুন্দরবন ও কক্সবাজার। ক্লান্ত যোদ্ধা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করলেন পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। মুহাম্মদ আলীর ভক্ত কক্সবাজার শহরের কলাতলীর বাসিন্দা সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং বিশিষ্ট ক্রীড়ামোদী বাড়ি করার জন্য আখতার নেওয়াজ খান বাবুল তাকে উপহার দিয়েছিলেন এক বিঘা জমি। সময়ের বিবর্তনে সেই জমি একদিন সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার বহুদিন আগে থেকেই পার্কিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত ছিলেন আলী। মুহাম্মদ আলীর সেই পরাক্রমশালী হাতটিকে স্পর্শ করার দুর্লভ সুযোগটি নিয়েছিলাম আমি। মনে প্রশ্ন ছিল কেমন হতে পারে সেই হাতটি- ভয় ছিল তিনি বোধ হয় সামান্য টিপে দিলে আমার হাতটাই গুঁড়ো হয়ে যাবে। বিশ্বের দু’জন ক্ষমতাধর আমেরিকান ব্যক্তির সঙ্গে আমার করমর্দন করার সুযোগ হয়েছিল। আলীর পরে অন্যজন হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। বিলকে দেখে স্বভাবতই নরম শরীরের মানুষ বলে মনে হয়। কিন্তু ২০০১ সালে তার সফরসঙ্গী হিসেবে দক্ষিণ এশিয়া ভ্রমণের সময় এক রাতে দিল্লীর হোটেলে ক্লিনটনের সঙ্গে করমর্দনের সময় অনুভব করেছিলাম ইস্পাতের মতো এক শক্ত হাত, যার নিষ্পেষণে এক রকম গুঁড়ো হয়ে গেল আমার হাত। কিন্তু অন্যদিকে বিশ্ব মুষ্টিযোদ্ধা চ্যাম্পিয়ন মুহাম্মদ আলীর হাত ছিল বিস্ময়করভাবে নরম। তিনি কি করে এমন হাতের ঘুষিতেই পরাজিত করেছিলেন দুর্দান্ত যোদ্ধা জো-ফ্রেজিয়ার এবং জর্জ ফোরম্যানকে? দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মুষ্টিযোদ্ধার এমন তুলতুলে নরম হাত যে না ছুঁয়েছে তেমন কেউ কি বিশ্বাস করবে? লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক
×