ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধ হচ্ছে ছায়ার সঙ্গে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১২ জুন ২০১৬

যুদ্ধ হচ্ছে ছায়ার সঙ্গে

শংকর কুমার দে ॥ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যার মাধ্যমে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে গোপন সংগঠনগুলোর খুনী চক্র। খুনী চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করতে না পেরে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছে সরকার। জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্য বলে যাদের গ্রেফতার করার পরও গুপ্তহত্যা থামানো যাচ্ছে না কেন ? খুনী ধরা পড়লেও খুনী চক্রের শিকড় কোথায় তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন ? গুপ্তহত্যার মাস্টারমাইন্ড কে ? তদন্তে এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর মিলাতে না পারার কারণেই কি গুপ্ত হত্যার পুনরাবৃত্তি ঘটছে? সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেই খুনী চক্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চালাচ্ছে গুপ্ত হত্যা। মোটরসাইকেল যোগে এসে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে খুন নিশ্চিত করা হয়েছে যার ধরন একই কায়দায়। টার্গেট কিলিং বন্ধে শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া সাঁড়াশি অভিযানে সারাদেশে গত দুই দিনে দেড় সহস্রাধিক গ্রেফতার হয়েছে। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্য, চরমপন্থী, সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্তসহ ১০ জন নিহত হয়েছেন। একই কায়দায় ২০১৩ সাল থেকে গত ৩ বছরে সারাদেশে ৪৯ জঙ্গী গোষ্ঠীর হামলায় প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, পুরোহিত, মুয়াজ্জিন, ধর্মযাজক, বিদেশী, মানবাধিকার কর্মী, সেবক, দর্জি, মুদি দোকানি, পুলিশ ও পুলিশ পরিবারের সদস্য, হিন্দু, খ্রীস্টান, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও মতাবলম্বীসহ ৫২ জনকে হত্যা করেছে খুনী চক্র, যাদের পরিচয় বলা হচ্ছে জঙ্গী। এ ছাড়াও ২০০৫ সাল থেকে গত ১০ বছরে ৪৭৯টি জঙ্গী হামলায় খুন হয়েছেন নিরীহ, নির্দোষ, সহজ, সরল, সাধারণ ৫ শতাধিক মানুষ। জঙ্গী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ৪৭৯টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৬২টি। বিচারাধীন আছে ৫৭টি মামলা ও ২৬০টি মামলা তদন্তাধীন। জঙ্গী হামলা ও খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে জঙ্গী সন্দেহে দেড় সহস্রাধিক। এর মধ্যে তদন্ত আর দীর্ঘসূত্রতা, আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে জামিনে মুক্ত হয়ে গেছেন জঙ্গী গোষ্ঠীর ৫ শতাধিক সদস্য। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা তরিকুল ইসলাম ২০০৫ সালে সারা দেশে একযোগে বোমা হামলার ঘটনায় চট্টগ্রামে গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে আবার গত ৫ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও কথিত পীর খিজির খানকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগে আবার গ্রেফতার হন তিনি। গত ২৫ অক্টোবর আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে নিজ হাতে খিজির খানের গলা কাটার কথা স্বীকার করেন তরিকুল। শুধু তরিকুলই নন, গত পাঁচ বছরে জেএমবির ৪২ জন, হিযবুত তাহ্রীরের ৪২১ জন, হরকত-উল-জিহাদের (হুজি) ১৫ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের চারজনসহ ৪৮২ ব্যক্তি জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে। জামিন পাওয়ার পর এসব জঙ্গী ও নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যরা আবারও হত্যা, নাশকতাসহ রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়াচ্ছেন, এমন অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে তদন্তে। জঙ্গী অর্থায়নে ব্যারিস্টার শাকিলার জামিন ॥ জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগে দায়ের করা দুটি মামলায় ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাকে অভিযোগ গঠন করা পর্যন্ত জামিন দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে শাকিলা ফারজানা। গত বছরের ১৮ আগস্ট হামজা ব্রিগেড নামের একটি জঙ্গী সংগঠনকে অস্ত্র কেনার জন্য ১ কোটি ৮ লাখ টাকা জোগানোর অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ঢাকার ধানম-ি থেকে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী হাসানুজ্জামান লিটন ও জজকোর্টের আইনজীবী মাহফুজ চৌধুরীও তার সঙ্গে গ্রেফতার হন। বাঁশখালী ও হাটহাজারীতে দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় তাঁদের গ্রেফতার দেখানো হয়। জঙ্গী সংগঠনে অর্থ সহায়তার অভিযোগে সন্ত্রাস দমন আইনে বাঁশখালী থানায় করা মামলায় ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে র‌্যাব। এই মামলায় আদালতে র‌্যাবের দ্বিতীয় চার্জশিট এটি। ২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালী সাধনপুর ইউনিয়নের লটমনি পাহাড় থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় বাঁশখালী থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে এই মামলা করা হয়েছিল। এতে ১০২ জনকে সাক্ষী করে ‘শহীদ হামজা ব্রিগেডের’ ২৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় র‌্যাব। র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, সন্ত্রাস দমন আইনে করা মামলা অভিযোগপত্র দেয়ার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকে আমরা অনুমোদন পাওয়ার পর চার্জশীট দ্বিতীয়বারের মতো আদালতে পাঠিয়েছি। তিনি বলেন, চার্জশীটে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা, দুই আইনজীবীসহ ‘শহীদ হামজা ব্রিগেডে’র ২৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাসহ ২১ জন কারাগারে আছেন। গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী উপজেলার আল মাদরাসাতুল আবু বকর নামে একটি মাদরাসায় র‌্যাবের অভিযানে ১২ জনকে গ্রেফতারের পর জঙ্গী সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেড সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। হাটহাজারীতে গ্রেফতারকৃতদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর লটমনি পাহাড়ে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখানে হামজা ব্রিগেডের সামরিক প্রশিক্ষণ ঘাঁটির সন্ধান পাওয়া যায়। এ ঘাঁটি থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলা-বারুদসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় র‌্যাব বাদী হয়ে বাঁশখালী থানায় সন্ত্রাস দমন ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে। গত সপ্তাহে জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগে দায়ের করা দুটি মামলায় ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাকে অভিযোগ গঠন করা পর্যন্ত জামিন দিয়েছে হাইকোর্ট। সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেই টার্গেট কিলিং ॥ সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হওয়ার মধ্যেই পাবনার হেমায়েতপুরে সেই একই কায়দায় খুন হলেন শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পান্ডে (৬২)। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে একই কায়দায় খুনের পর শুরু হয় দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান। একই দিনে খুন হন নাটোরে মুদি দোকানি সুনীল গোমেজ। এর আগে খুন হন ঝিনাইদহে পুরোহিত আনন্দ গোপাল। এখন যারা নিহত হচ্ছেন তাদের মধ্যে অনেকেই হিন্দু ও খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী। মাত্র ৩ দিনের ব্যাবধানে একই কায়দায় এসব খুনের ঘটনায় কুলকিনারা করতে না পারায় মারাত্মকভাবে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে। এসব হত্যাকা-ের কয়েকটি ঘটনার তদন্তে অগ্রগতি দাবি করা হলেও এখন পর্যন্ত পরিকল্পনাকারী ও মদদদাতা কিংবা মাস্টার মাইন্ড কাউকেই আটক করতে পারেনি। এ ধরনের টার্গেট কিলিংয়ের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যত রয়ে গেছে অন্ধকারেই। এই পরিস্থিতিতে মানুষজনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আতঙ্কে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। চট্টগ্রামের মিতু হত্যাকা- অন্ধকারেই ॥ চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যাকা- রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত ও ছায়া তদন্ত করছে এমন অন্তত ৬টি আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থা। খুনের পর এক সপ্তাহ ধরেই দু’একজনকে সন্দেহজনকভাবে আটক, মাইক্রোবাস জব্দ, সিসি ক্যামেরার দৃশ্য পর্যালোচনা, জিজ্ঞাসাবাদ, বৈঠক পর্যালোচনা ইত্যাদির মধ্য দিয়েই অতিবাহিত করে দেয়া হয়েছে। কার্যত তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মিতু হত্যাকা-ের প্রতি নজর রাখার পরও খুনী চক্রের বিষয়ে একেকবার একেক ধরনের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে তদন্তকারীরা বিভ্রান্ত। তদন্তের প্রতিটি ইউনিটকে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণে এখনও পর্যন্ত ব্যর্থই বলা চলে। মামলার মূল তদন্তকারী সংস্থা ডিবি পুলিশ ছাড়াও তদন্ত চালাচ্ছে র‌্যাব পিবিআই, থানা পুলিশ, সিআইডি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। সিøপার সেল ও কাট আউট ॥ ভয়ঙ্কর প্রকৃতির সিøপার সেল। এই সিøপার সেল গঠন করেই ব্লগার কিলিং মিশনে নেমেছে জঙ্গী সংগঠন। একেকটি জঙ্গী সংগঠনে সিøপার সেল রয়েছে শতাধিক। সিøপার সেলে কমপক্ষে ৫ জন থেকে সর্বোচ্চ সাত জনের সদস্য মিলে একটি গ্রুপ। এর মধ্যে একজন থাকে দলনেতা। তাদের প্রত্যেককে একে অপরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় মূল পরিকল্পনাকারী। দলনেতাই প্রত্যেক সদস্যকে মিশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়-কাকে, কীভাবে খুন করতে হবে। পরিকল্পনাকারী নিজেই সিøপার সেলের সদস্যদের অস্ত্র সরবরাহ করে। তারা বেশিরভাগ সময় ধারালো চাপাতিসহ ছোরা জাতীয় অস্ত্র ব্যবহার করে। কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যার করে তারা। সিøপার সেলের সদস্যদের একজন সদস্যের সঙ্গে অন্য সদস্যের থাকে না কোন পরিচয়। এমনকি কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার আগ পর্যন্ত সিøপার সেলের সদস্যরা একে অপরের কাছে থাকে অচেনা, অপরিচিত। তারা মনে করে হত্যা করা তাদের ওপর ‘ফরজ’ বলে নাযিল হয়েছে। বেহেস্ত পেতে হলে তাদের এ হত্যা করতেই হবে। এ কারণে একজন সদস্য ধরা পড়লেও অপর সদস্যের ব্যাপারে বিস্তারিত কোন তথ্যই জানেন না বা জানতে দেয়া হয় না, এটা কাট আউট পদ্ধতি। সিøপার সেলের প্রধান তাদের নির্দিষ্ট ব্যক্তির ছবি দেখিয়ে দেয়। ঐ ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে রেকি করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট সময় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু খুনের সময় হাতে নাতে গ্রেফতার হওয়া জিকির ও আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিøপার সেল সম্পর্কে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। ‘সিøপার সেল’ সম্পর্কে গোয়েন্দারা বলছেন, একদল মানুষ লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কোন সন্ত্রাসী বা সহিংস কর্মকা- না করা পর্যন্ত তাদের জানা যায় না। এ কারণেই টার্গেট কিলিং-এর বিষয়ে প্রকৃত খুনী চক্র বা মাস্টার মাইন্ড কারা তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। দুই জন ধরা পড়ার পরও মূলে পৌঁছাতে পারেনি গত বছরের ৩০ মার্চ। সকাল সাড়ে নয়টা। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ি এলাকা। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু (২৬)। প্রকাশ্যে মানুষজনের সামনেই রাস্তায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয় তাকে। খুন করে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে এক হিজড়া ঝাপটে ধরে ফেলে জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে। খুনের সময়ে হাতেনাতে ধরা পড়া জিকরুল্লাহ ও আরিফ দুই জনই মাদ্রাসা ছাত্র। ধরা পড়ার পর পুলিশ এসে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দু’জনকেই। জিজ্ঞাসাবাদ করে খুনের নির্দেশদাতা ‘বড় ভাইয়ের’ নাম, ঠিকানার খোঁজ পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায় খুনের সময়ে আরও একজন ঘটনাস্থলে ছিল, তার নাম আবু তাহের। তাৎক্ষণিক খুনীদের ধাওয়া দিয়ে ঘটনাস্থলের কিছু দূর থেকে তবে আবু তাহের পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় খুনী চক্রের নির্দেশদাতা বড়ভাই মাছুমও। বাবু খুনের পর হাতেনাতে খুনী ধরা পড়ার পর দু’জনের নামও পাওয়া যায়। অথচ এক বছর তিন মাস পরও অধরা দুই খুনীসহ খুনীদের মাস্টার মাইন্ড কোথায় তার হদিস করা যায়নি। তদন্তের গভীরে যেতেই পারছে না তদন্তকারীরা। গত দেড় বছরে টার্গেট কিলিং ॥ চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে একই কায়দায় সর্বশেষ খুন হলেন শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পা-ে (৬২)। এর আগে খুন হন নাটোরে মুদি দোকানি সুনীল গোমেজ, ঝিনাইদহে পুরোহিত আনন্দ গোপাল, চট্টগ্রামে এসপির স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। এর আগে সেই একই কায়দায় গত ৭ এপ্রিল সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে খুন করা হয়। গত ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে ইউএসএইড কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত ৩০ এপ্রিল টাঙ্গাইলে হিন্দু দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দারকে হত্যা করা হয়। গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্লগার অভিজিৎ রায়কে খুন করা হয়। গত বছরের ২ নবেম্বর খুন হন প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। একই দিনে মোহাম্মদপুরে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলকে। গোড়ানে খুন করা হয়েছে নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয়কে। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সামনে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর জখম হন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন ব্লগার অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ। পরে হাসপাতালে মারা যান অভিজিৎ। একই বছরের ৩০ মার্চ ঢাকায় খুন হন ওয়াশিকুর রহমান। ওই বছরের ১২ মে সিলেটে ধারালো অস্ত্র দ্বারা হত্যা করা হয় অনন্ত বিজয় দাসকে। একই বছরের ৭ আগস্ট ঢাকার দক্ষিণ গোরানে নিজ বাসায় প্রবেশ করে হত্যা করা হয় নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নীলকে। একই বছরের ৩১ অক্টোবর শাহবাগে জাগৃতির প্রকাশনী’র প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন খুন হন নিজ অফিসে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার ডিপ্লোম্যাটিক জোন গুলশানে অজ্ঞাতনামা বন্দুকধারীদের গুলিতে খুন হন ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার। এর ৬দিন পর রংপরেুর কাউনিয়ায় বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করে জাপানী হোশি কোনিওকে । এরপর গত ২৩ অক্টোবর পুরনো ঢাকার হোসেনী দালানে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলায় নিহত হয় সাজ্জাদ হোসেন নামে এক কিশোর। আহত হন ১০ ধর্মীয় অনুসারী। গত ৫ ডিসেম্বর দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরে অনুষ্ঠিত রাস মেলায় বোমা হামলায় ১০ জন আহত হয়। গত ২৭ নবেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার হরিপুর গ্রামের ইমাম খোমেনি শিয়া মসজিদে বন্দুকধারীদের হামলায় নিহত হন মসজিদের মোয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন। ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলা চালানো হয় কিন্তু তিনি প্রাণে বেঁচে যান। একই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্লবীতে নিজ বাড়ির সামনে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দার। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। ওই বছরের ৭ মার্চ পূরবী সিনেমা হলের সামনে হামলার শিকার হন আরেক গণজাগরণ মঞ্চকর্মী সনিউর রহমান। ২০১৪ সালের বাউল সম্প্রদায়ের অনুসারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শফিকুল ইসলামকে ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে খুন করা হয়। বন্দরনগরীর সবচেয়ে সংরক্ষিত এলাকা বলে পরিচিত চট্টগ্রামের ঈসা খাঁ নৌঘাঁটিতে ককটেল বোমার হামলা চালানো হয়েছে। এর আগে রাজধানী ঢাকার কাফরুলে সেনানিবাস এলাকায় ছুরিকাঘাতে আহত হন এক সেনা পুলিশ। এছাড়াও পাবনার ঈশ্বরদীতে ধর্মযাজক লুকু সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টাসহ বিভিন্ন ধর্মযাজককে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। দেশজুড়ে হত্যা ও হামলার পাশাপাশি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরাও হুমকির মুখে পড়ছেন। সবকিছুই করা হচ্ছে আইএস পরিচয়ে। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক, ধর্ম প্রচারক এমনকি পুলিশও রয়েছে হুমকি পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায়। সম্প্রতি একটি হিটলিস্টও তৈরি করেছে জিহাদী গ্রুপ। গণমাধ্যম কর্মীদেরও চিঠি পাঠিয়ে শাসাচ্ছে তারা। এ রকম অর্ধশতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি জিহাদী গ্রুপের হুমকির মুখে পড়েছেন। গত দেড় বছরে দেশে ৪৯টি জঙ্গী হামলার ঘটনার মধ্যে ৫১ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ২৮টিরই রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়নি। মাত্র চারটি ঘটনায় দায়ের করা মামলার চার্জশীট দাখিল করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৩৪টি ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। ছয় জঙ্গীর ছবি ও নাম প্রকাশ ॥ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সম্প্রতি সন্দেহভাজন ছয় উগ্রপন্থীর ছবি ও নাম প্রকাশ করে তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে। তারা হলো- এবিটির শীর্ষ পর্যায়ের সংগঠক শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১ ও সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী-২, সদস্য সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সালমান ওরফে সাদ, শিহাব ওরফে সুমন ওরফে সাইফুল ও সাজ্জাদ ওরফে সজীব ওরফে সিয়াম ওরফে শামস। এখন পর্যন্ত কোন সাধারণ নাগরিক উগ্রপন্থীদের ব্যাপারে পুলিশকে তথ্য দেয়নি। হত্যার দায় স্বীকারে ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স ’॥ হত্যাকা- সংঘটিত করেই খুনীরা ক্ষ্যান্ত হয়নি বরং হত্যার দায় স্বীকার করে বিবৃতিও প্রকাশ করেছে জঙ্গীগোষ্টীর নামে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপে’র ওয়েবসাইটে দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়া হয়েছে এই হামলা আইএসের কাজ। তবে সরকার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বার বারই বলা হয়েছে, আইএস বা আল কায়েদা বলতে দেশে কিছু নেই। জামায়াত-শিবির ও দেশীয় জঙ্গীরাই আইএস বা আল কায়েদার নাম ব্যবহার করছে। গত বছরে হত্যা, হুমকি ও হামলার ঘটনাগুলো তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ বেশ কয়েকটি জিহাদী গ্রুপের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে যারা ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এরমধ্যে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও হিজবুত তৌহিদ অন্যতম। গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, নিষিদ্ধ ঘোষিতসহ বেশ কয়েকটি নতুন জঙ্গী সংগঠন বাংলাদেশ জিহাদী গ্রুপ নামে একই প্ল্যাটফর্মে সমবেত হয়েছে। তারাই এই সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। এর স্বপক্ষে বেশ কিছু প্রমাণ ও দলিলাদি আমাদের হস্তগত হয়েছে। তবে হত্যাকা- ঘটার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গীগোষ্ঠী আইএস (ইসলামিক স্টেট) বার্তা দিচ্ছে, যা প্রচার করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিতর্কিত সাইট ইন্টেলিজেন্স। ওদিকে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এটি দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র। জড়িত দেশী-বিদেশী চক্র। যাদের বিষয়ে অনেক তথ্যই নাকি সরকারের হাতে রয়েছে। কিন্তু তাদের নাম-ধাম যেমন প্রকাশ করা হচ্ছে না তেমনি ধরাও হচ্ছে না। এ ধরনের চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ে যাদের মাঝেমধ্যে ধরা হচ্ছে তারা প্রকৃত খুনী কিনা তা নিয়েও জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। জঙ্গী উত্থানের সেই সময় ॥ ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে জেএমবি সদস্যরা মুন্সীগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৩ জেলার সাড়ে ৪শ’ স্থানে একযোগে প্রায় ৫শ’ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। আর এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেয় জঙ্গী সংগঠন জেএমবি (বর্তমানে নিষিদ্ধ)। ওই ঘটনায় দু’জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এ ঘটনায় ১৬১টি মামলার ১০৮টির বিচার শেষ হয়েছে। এসব মামলায় আদালত ৪৫ জনের মৃত্যুদ- দেয়। এর মধ্যে শীর্ষ ৬ জঙ্গী নেতার মৃত্যুদ- কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ। শীর্ষ এ জঙ্গী নেতারা হচ্ছেন শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম, খালেদ সাইফুল্লাহ, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হাসান আল মামুন। বাকি ৩৯ জনের মৃত্যুদ- এখনও কার্যকর হয়নি। উচ্চ আদালতে আপীল করায় তাদের রায় কার্যকর দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। আর সারা দেশে জঙ্গীবাদের এসব মামলায় রায় হওয়ার আগেই জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছেন ভয়ঙ্কর ধরনের দুই শতাধিক জঙ্গী। এর আগে ১৯৯৯ সালে যশোরের উদীচী গ্রেনেড হামলা হয়। ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর পল্টনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা চালায় জঙ্গীরা। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। জঙ্গীদের গ্রেনেড বোমা হামলার ধারাবাহিকতায় আরও আহমদিয়া মসজিদ, গির্জা, সিনেমা হল, সিলেটের মাজারে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের ওপর বোমা হামলা, সিলেটের মেয়র কামরান, হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে হত্যা ও ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ প্রায় ২৪ জন নিহত হন। এই গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। নামে-বেনামে সক্রিয় ॥ গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেছেন, জেএমবি, জেএমজেবি, হুজি, শাহাদত-ই-আল হিকমা ও হিজবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও নতুন নামে তারা তাদের জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। এর মধ্যে আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্স (এআরসিএফ), আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিজবুত তাওহীদ, তাআমীর উদ্দীন, লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই-মোহাম্মদসহ দেশে অন্তত ৪০ টি জঙ্গী সংগঠন এখনও সক্রিয়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর থাকায় তারা প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পাচ্ছে না বলে ওই কর্মকর্তা দাবি করেন। নৃশংস খুনী কারা ॥ খুনী কারা তা চিহ্নিত না করেই প্রাথমিক পর্যায়েই একটা কিছু বলে দেয়া হয়, যা পরবর্তীতে অনুমাননির্ভর বলে প্রমাণিত হয়। খুনী চক্রের পেছনে খুবই প্রভাবশালী মহল জড়িত। যাদের শেকড় দেশের বাইরে হতে পারে। হতে পারে এরা আন্তর্জাতিক শক্তিশালী চক্র। দূরনিয়ন্ত্রিতভাবে কাটআউট পদ্ধতিতে কয়েকটি ধাপ পার করে তারা এসব হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। যাদের মিত্র হয়ে কাজ করছে এখানকার স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী জামায়াত-শিবির। কিছু ঘটনায় স্থানীয় জঙ্গী সংগঠনের লোকজনও সম্পৃক্ত থাকতে পারে। তবে সরকার ও সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এদের বিষয়ে পুরো তথ্য থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আসল কার হচ্ছে, ধারণাভিত্তিক ছাড়া সরকারের কাছে তেমন কোন তথ্যই নেই। সক্ষমতা কিংবা দক্ষতার অভাবে হোক বা যে কারণেই হোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব হত্যাকা-ের তদন্তের গভীরে যেতে পারছে না। কিছু প্রাইমারি ক্লু এবং নানা সন্দেহ ও ধারণাকে ভিত্তি করে তারা তদন্ত করছে। সে ক্ষেত্রে খুনী চক্রের সদস্যরা যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়ে বেশি প্রশিক্ষিত ও প্রযুক্তিজ্ঞানসমৃদ্ধ তা প্রমাণিত সত্য যা স্বীকার না করার কারণেই টার্গেট কিলিংয়ের চক্রটিকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। টার্গেট কিলিং সম্পর্কে কে কি বলেছেন ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, গুপ্ত হত্যা করে কেউই রেহাই পাবে না। দেশে একের পর এক যে গুপ্ত হত্যাকা- ঘটানো হচ্ছে তার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের যোগসূত্রতা রয়েছে। যারা প্রকাশ্যে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে তারাই কৌশল পাল্টে এখন মানুষ হত্যা করছে। জাতীয় সংসদে বক্তব্যের পর একই দিনে গনভবনে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সাম্প্রতিক গণহত্যার পেছনে দুটি রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারপ্রধান হিসেবে আমার কাছে নিশ্চয়ই তথ্য আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সোমবার সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের বলেছেন, আইএস নয়, দুটি আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় কয়েক রাজনীতিক দেশকে অস্থিতিশীল করতে টার্গেট কিলিং করছে। শীঘ্রই চট্টগ্রামে এসপি’র স্ত্রী হত্যায় জড়িতদের খুঁজে বের করা হবে। পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী খুনের ঘটনা টার্গেট কিলিং। এই ঘটনার রহস্য উৎঘাটনে গোয়েন্দা বাহিনী তৎপর। এই হত্যার সঙ্গে আইএস সম্পৃক্ত নয় বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগেও বলেছেন, গুপ্তহত্যার পেছনে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র যুক্ত। জেএমবি, এবিটি, জামায়াত-শিবির আলাদা কিছু নয়। যারা জেএমবি-এবিটি; তারাই জামায়াত-শিবির। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটি (সিটি) প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, বেশ কিছু জঙ্গী হামলার ঘটনায় আসামি গ্রেফতার হয়েছে। এসব আসামির অনেকেই জিজ্ঞাসাবাদে অতীতে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী বলে জানা গেছে। জেএমবি ও এবিটিতে জামায়াত-শিবিরের একটি অংশ ঢুকে পড়েছে। যারা জেএমবিকে পেট্রোনাইজ করছে তারা চাকরির মতো করে জঙ্গীদের বেতন দিচ্ছে। পাশাপাশি তাদের পরিবারের বাসা ভাড়া, সাংসারিক খরচ থেকে শুরু করে সব ধরনের খরচ বহন করা হচ্ছে। এসব অর্থদাতারা পলিটিক্যাল। এটা সুস্পষ্ট। যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় না তারাই সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, যুদ্ধাপরাধীর বিচার, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বিএনপি-জামায়াত রাজনীতির নামে যে সহিংস সন্ত্রাসে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে নেপথ্য থেকে মদদ দিয়েছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এর মধ্যে জঙ্গী অর্থায়নে সহায়তা করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ইতোমধ্যেই ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের দুই কূটনীতিককে বহিষ্কার ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও রায় কার্যকর নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতির ঘটনাই তার প্রমাণ। এ ছাড়াও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা স্বীকার করেছেন। জঙ্গী সংগঠন জেএমবি ও এবিটিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের ভেতর থেকে কেউ কেউ মদদ দিচ্ছে, যা জেএমবি ও এবিটির মাধ্যমে জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে পুনরায় দেশব্যাপী উগ্রপন্থী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে গুপ্ত হত্যা বা টার্গেট কিলিং করানো হচ্ছে। অপরাধ বিশ্লেষকগণ বলেন, সরকার বা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টায় একের পর এক হত্যাকা- ঘটানো হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এসব হত্যাকা-ের পেছনে অর্থনৈতিক যোগসাজশ থাকতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, একের পর হত্যাকা- ঘটছে, আসামি ধরা হচ্ছে, কিন্তু এর কোন পরিসমাপ্তি হচ্ছে না। পুলিশের যে দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, পেশাদারিত্ব ও গোয়েন্দা নজরদারিতে বড় ধরনের ঘাটতি ও দুর্বলতা আছে। জিহাদের নামে নিরীহ ব্যক্তিদের হত্যা করা হচ্ছে। এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার বিষয়টি সম্পৃক্ত। স্বাধীনতা বিরোধীরা এসব অপশক্তিকে ব্যবহার করছে। এদের নিয়ন্ত্রণে ফলদায়ক কিছু না হলে নিরীহ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতির সৃষ্টি হবে এবং জঙ্গীবাদ যে বাংলাদেশে আছে সেটি প্রমাণ করার একটি সুযোগ তৈরি হবে। যারা এসব গুপ্তহত্যা ঘটাচ্ছে তাদের কতগুলো দৃশ্যমান কিলিং সেল আছে দেখা যাচ্ছে। এই সিøপার সেলের নামে কিলিং সেলের অস্তিত্ব ভাঙতে না পারলে এ ধরনের হত্যাকা- বন্ধ হবে না।
×