ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শর্ষের তেলের ঘূর্ণি চাকায় ঘুরছে জীবন

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১১ জুন ২০১৬

শর্ষের তেলের ঘূর্ণি চাকায় ঘুরছে জীবন

সমুদ্র হক ॥ বাইসাইকেলে শর্ষের তেলের ঘূণি চাকায় ঘুরছে জীবন তার। নিজের বাইসাইকেলের দুই ধারে তিনটি করে ৬টি বড় প্লাস্টিক কন্টেনার এঁটে তিনি বানিয়ে নিয়েছেন অয়েল ট্যাঙ্কার। প্রতিদিন দোকান ও শহরের বাসাবাড়িতে অন্তত একশ’ লিটার শর্ষের তেল বিক্রি করেন এই বাইসাইকেল অয়েল-ট্যাঙ্কারে ঘুরে ঘুরে। দাবি করেন তার শর্ষের তেল এতটাই খাঁটিÑ যে বাড়িতে একবার এই তেলে রান্না হয়েছে সেই বাড়ির গৃহিণী বাজারের তেল আর কেনেন না। এভাবেই দিনে দিনে তার গ্রাহক বেড়েছে। যিনি নিজের বুদ্ধিমত্তায় জীবনের চাকা ঘুরিয়েছেন তার নাম মোঃ মুসা আজাদ। তবে তেলের সাইকেল-আজাদ নামে অধিক পরিচিত। বয়স ষাটের কাছাকাছি। বাড়ি বগুড়া শহরের ফুলবাড়ি। স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে সংসার। দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণীই শেষ ধাপ। তারপর সংসারের ঘানি টানতে হয়েছে। তারুণ্যে চাকরি করেছেন নানা প্রতিষ্ঠানে। স্বল্প রোজগারে সংসার চলেছে মিটিমিটি করে। এরই মধ্যে তার ছোটভাই জয়পুরহাটের তিলকপুরে শর্ষের তেলের মিল স্থাপন করলে সেখানে দেখাশোনার কাজ জোটে। বছরখানেক চাকরি করার পর মাথায় বুদ্ধি আসে নিজে শর্ষে কিনে মিল থেকে ভাঙ্গিয়ে নিয়ে সেই তেল দোকানে ও বাড়িতে পৌঁছালে লাভের অঙ্ক বাড়বে। নিজে গতর খেটে একটা ব্যবসা চালু করা যাবে। বছরচারেক আগে তিনি ১২শ’ টাকায় পুরনো সাইকেল কিনে মেরামত করেন। প্রথমে একটি প্লাস্টিক কন্টেনার ক্যারিয়ারে রশি দিয়ে আটকে নেন। তারপর সাইকলে চেপে দোকানে ও বাসাবাড়িতে তেল বিক্রি করতে থাকেন। গ্রাহকরা খাঁটি তেল পেলে ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা আজাদের কথা ছড়াতে থাকে। দিনে দিনে বেড়ে যায় গ্রাহক। এক পর্যায়ে নিজেই বুদ্ধি আঁটেন সাইকেলের ক্যারিয়ারে কীভাবে একাধিক প্লাস্টিক কন্টেনার রাখার ব্যবস্থা করা যায়। বুদ্ধি ঠিকই বের হয়। সাইকেলের পেছনে দুই ধারে স্টিলের পাতির ওপর বিশেষ ব্যবস্থায় ৩টি করে ৬টি জ্যারিকেন বা প্লাস্টিক কন্টেনার বসালেন। প্রতিটি কন্টেনারে ১০ লিটার করে মোট ৬০ লিটার শর্ষের তেল ভরে নেন। তারপর সাইকেলের প্যাডেলের ঘূর্ণনে শুরু হয় আরেক জীবন। এ দোকান সে দোকান, এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে তেল বিতরণ করতে থাকেন। প্রথমের দিকে দিনে ৬০ লিটার (তার মতে ৫৪ কেজি) শর্ষের তেল বিক্রি হতো। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে বর্তমানে দিনে একশ’ থেকে ১শ’২০ লিটার তেল বিক্রি হয়। এ জন্য তাকে দুবার প্লাস্টিক কন্টেনার ভরাতে হয়। প্রতিদিন শহরের উত্তরে নিজের বাড়ি ফুলবাড়ি থেকে ৬০ লিটার তেল ভরিয়ে পথে বের হন। ফুরিয়ে যাওয়ার পর শহরের দক্ষিণে মালতিনগরের এমএস ক্লাবের মাঠের কাছে গোডাউন থেকে আর ৪০ থেকে ৬০ লিটার তেল নিয়ে বাকি চাহিদা পূরণ করেন। ওই গোডাউন তিনি ভাড়া নিয়েছেন। বললেন শহরের উত্তরের এলাকার তেল শেষ হওয়ার পর দক্ষিণের এলাকায় তেল বিতরণ করা হয়। একটা সময় শর্ষের তেল ছিল মুখ্য। রান্নায় ব্যবহার ছাড়াও গোসলের আগে গোটা শরীরে তেল মেখে কিছুক্ষণ রোদে থাকতে হতো। শর্ষের তেলে সলতে চুবিয়ে আগুনের ধোঁয়ায় কাজলদানিতে কাজল ভরানো হতো। শর্ষের তেলের ছিল নানামুখী ব্যবহার। আজ আর এতটা নেই। তারপরও ঐতিহ্যের ধারায় শর্ষের তেল ব্যবহার করা হয়। আজাদের তেল বিক্রি হয় ফুলবাড়িহাট, মানিকচক, আশেকপুর, সাবগ্রাম, ফুলতলা, শাকপালা, কলোনি, বনানী, বৌবাজারে। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, নিজে শর্ষে কিনে তা মিলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভাঙ্গিয়ে নেন। প্রতিকেজি তেল বিক্রি করেন ১শ’ ২০ টাকা ও প্রতিলিটার ১শ’১০ টাকা দরে। যে যে মাপে তেল নিতে চায় সেভাবেই বিক্রি করেন তিনি। কন্টেনারের পেছনে কয়েকটি র‌্যাকে লিটার ও কেজির মাপের মগ আছে। ডিজিটাল স্কেলও আছে। বাইসাইকেলে প্যাডেল করে এক সঙ্গে ৬০ লিটার তেল পরিবহনে অসুবিধা হয় না! এমন প্রশ্নে জানান, তরল পদার্থ পরিবহনে একটু অসুবিধা হয়। অয়েল-ট্যাঙ্কার নিয়ে মোটর ও রেল চালানো সহজ নয়। তরল পদার্থ নড়লেই ঝাঁকুনিতে সাইকেলের ব্যালেন্স ঠিক রাখা কঠিন হয়। এখন আর অসুবিধা হয় না। কোথায় প্যাডেল বাড়াতে হবে কমাতে হবে তা বোঝা যায়। মাসে দুই/তিনবার তিনি তিলকপুর থেকে শর্ষে ভাঙ্গিয়ে ড্রামে করে তেল আনেন কখনও পিকাপভ্যান কখনও মিনিট্রাকে করে। সঙ্গে কেনা, ভাঙ্গা এবং পরিবহনে যে খরচ হয় তার সঙ্গে সামান্য লাভ যোগ করে বিক্রি করেন। দোকানিরা এই তেল কিনে যদি ভেজাল দেয় তাহলে তো খাঁটি তেল থাকছে না! এমন প্রশ্নে আজাদের কথা, দোকানিরা কি করল তা বুঝবেন কেমন করে। তবে দোকানিদের অনুরোধ করেন শর্ষের তেলে যেন আর কিছু না মেশান। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেন বাসাবাড়ির সকলেই তার তেল যে ভাল তা বলেন। এটাই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
×