ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

রাতারগুলের পথে ...

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ৩ জুন ২০১৬

রাতারগুলের পথে ...

নিস্তব্ধ ঝকঝকে দুপুর। তটিনীর কূলে ডেকে যায় একলা ডাহুক। এমন নিস্তব্ধ দুপুরে শুধু নৌকার বৈঠা শব্দ করছে ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল। এমনই এক সময়েই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বাংলার এ্যামাজন নামে পরিচিত সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাতারগুলে। সারা পৃথিবীতে ফ্রেশওয়াটার সোয়াম্প ফরেস্ট বা স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশে আছে এর দুইটি একটা শ্রীলঙ্কায় আর আরেকটি সিলেটের গোয়াইনঘাটে। সিলেট শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে এই রাতারগুল। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের গুয়াইন নদীর দক্ষিণে রাতারগুলের অবস্থান। প্রায় ৩১০ একর জমির ভূমির ওপর জলের মধ্যে ভেসে থাকা সবুজ বৃক্ষ, তার মাঝ দিয়ে নৌকায় করে রাতারগুলে ঘুরে বেড়ানোর যাবে মাত্র এক থেকে ২ ঘণ্টায়। চাইলে আরও বেশি সময় কাটাতে পারেন। বন বিভাগের তথ্যমতে, বনের আয়তন ৩ হাজার ৩০৫ দশমিক ৬১ একর। ১৯৭৩ সালে বনের ৫০৪ একর বনভূমিকে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। স্থানীয় মানুষজনের কাছে এইটা ‘সুন্দরবন’ নামেই বেশি পরিচিত। যাব যাব করেও গত বর্ষায় আর প্ল্যান করা হয়ে ওঠেনি, সত্যি বলতে প্ল্যান করে কোথাও যাওয়ায় হয় না হঠাৎ করে না গেলে। অদ্ভুত এই জলের রাজ্য। কোন গাছের কোমর পর্যন্ত ডুবে আছে পানিতে। একটু ছোট যেগুলো, সেগুলো আবার শরীরের অর্ধেকটাই ডুবে আছে জলে। ঘন হয়ে জন্মানো গাছপালার কারণে কেমন যেন আলো-আঁধারির এক মাদকতাময় খেলা। বনের মাঝ দিয়ে চলতে গেলে ভ্রমণ পিসাসুদের জড়িয়ে ধরবে নানা ধরনের গাছপালা। বৈশিষ্ট্যে এ বনের সঙ্গে মিল রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের আমাজনের। ডিঙিতে চড়ে বনের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে দেখা যাবে প্রকৃতির রূপসুধা। জলমগ্ন বলে এই বনে সাপের আবাসটাই বেশি, তবে ভাগ্য ভাল হলে দেখা হয়ে যেতে পারে দু-একটা বানরের সঙ্গে। তা ছাড়া চোখে পরার মতো বনে সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙ্গা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঘুঘু, চিলসহ নানা জাতের পাখি তো আছেই। রাতারগুল যাওয়ার পূর্বে আমরা এক পরিচিত মানুষ মারফত এক মাঝি ঠিক করে নিয়েছিলাম, মাঝির নাম রমিজ মাঝি। তার কথামতো আমরা দুপুর ৩টার দিকে রাতারগুলের উদ্দেশে রওনা দেই। অনেকেই ভাবতে পারেন এই ভরদুপুরে কেন আমরা বের হলাম এর কারণ হলো- দুপুরে খুব রোদ থাকে তাই ঘুরতে গেলে খুব সকালে নয়ত ভরদুপুরের পর যখন রোদের তেজ কিছুটা কমে আসে। আমাদের দলের সবাই ঘুমপাগল তাই সকালে না গিয়ে ভরদুপুরে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। পূর্বেই গাড়ি ঠিক করে রাখাছিল। গাড়িতে করে সোজা গেলাম আমরা জাহাজ ঘাটে। জাহাজ ঘাটে নেমে আমরা রমিজ মাঝির খোঁজ পেলাম। রমিজ মাঝি আমাদের নদীর ঘাটের দিকে নিয়ে গেলেন। নদীর ঘাটে যাওয়ার সময় এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। এক সঙ্গে শিব মন্দির ও মজার দেখে। বাংলাদেশ যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ এটিই এর প্রমাণ। আমরা ডিঙ্গি নৌকা করে যাত্রা শুরু করলাম। ভারতের মেঘালয়ের জলধারা গোয়াইন নদীতে এসে পড়ে, আর সেখান কার এক সরু শাখা চেঙ্গী খাল হয়ে পানিটা প্লাবিত করে রাতারগুল জলাবনকে। বর্ষা মৌসুমের প্রায় সবসময়ই পানি থাকে বনে। শীতকালে অবশ্য সেটা হয়ে যায় আর দশটা বনের মতোই, পাতা ঝরা শুষ্ক ডাঙ্গা। রমিজ মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম এই বনের নাম রাতারগুল কেন বলা হয়Ñ মাঝি বল্লেন, এই বনে প্রচুর মুর্তা বা পাটি গাছ হয় স্থানীয় ভাষায়, মুর্তা বা পাটি গাছকে রাতাগাছ নামেও ডাকা হয়। রাতাগাছের নামেই এই বনের নাম হয়েছে রাতারগুল। নদীতে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করে মাছ ধরছে কিশোরা। তাদের আবার নৌকা থেকে জিজ্ঞেস করলাম মাছ বিক্রি করবে কিনা কিন্তু কেউ বিক্রি করতে চায় না। হঠাৎ চোখে পড়ল এক মাছরাঙ্গা দূর থেকে এসে ছো দিয়ে মাছ শিকার করে উড়ে চলে গেল। মুর্তার ঝাড়ের মধ্যখান দিয়ে ঝোপ কেটে কেটে নৌকা চলতে শুরু করল। আমরা বনের ভেতর ঢুকছি বনের ভেতর এক শুন-শান নীরবতা। রমিজ মাঝি বললেন, শীতের শুরুতেই আনাগোনা শুরু“হয় অতিথি পাখির। বনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই রাতারগুলে চলে পাখির ‘ডুবো খেলা’। বনজুড়ে চরে বেড়ায় নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী। হাওড় আর নদী বেষ্টিত অপূর্ব সুন্দর বনের দক্ষিণ পাশে সবুজের চাদরে আচ্ছাদিত জালি ও মুর্তা বেতবাগান। এর পেছনেই মাথা উঁচু করে আছে সারি সারি জারুল-হিজল-কড়চ। বনের ভেতর যত ঢুকছি ততই অবাক হচ্ছি ঘন গাছের সারি। কিন্তু গাছগুলোর দুই রঙ ওপরের অংশগুলো সবুজ আর নিচের অংশগুলো কর্দমাক্ত আর কারণ হলো আমরা যখন বনে ঢুকি তখন ভাঁটা ছিল তাই। গাছের মধ্যে করচই বেশি। হিজল গাছে ফল ধরে আছে শয়ে শয়ে। তবে রাতারগুলের বেশ বড় একটা অংশে বাণিজ্যিকভাবে মুর্তা লাগিয়েছে বন বিভাগ। মুর্তা দিয়ে শীতল পাটি হয়। মুর্তা বেশি আছে নদীর উল্টো পাশে। ওদিকে শিমুল বিল হাওর আর নেয়া বিল হাওড় নামে দুটো বড় হাওড় আছে। বড়ই অদ্ভুত এই জলের রাজ্য। কোথাও চোখে পড়বে মাছ ধরার জাল পেতেছে জেলেরা। ঘন হয়ে জন্মানো গাছপালার কারণে কেমন অন্ধকার লাগবে পুরো বনটা। মাঝে মধ্যেই গাছের ডালপালা আটকে দেবে পথ। হাত দিয়ে ওগুলো সরিয়ে তৈরি করতে হবে পথ। চলতে হবে খুব সাবধানে। কারণ রাতারগুল হচ্ছে সাপের আখড়া। বর্ষায় পানি বাড়ায় সাপেরা ঠাঁই নেয় গাছের ওপর। সাপের মধ্যে রয়েছে গুইসাপ, গোখরা, জলধুড়াসহ বিষাক্ত অনেক প্রজাতি। বর্ষায় বনের ভেতর পানি ঢুকলে এসব সাপ উঠে পড়ে গাছের ওপর। বনের ভেতর দাঁপিয়ে বেড়ায় মেছোবাঘ, কাঠবিড়ালি, বানর, ভোদড়, বনবিড়াল, বেজি, শিয়ালসহ নানা প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। টেংরা, খলিশা, রিঠা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউস, রুইসহ আরও অনেক জাতের মাছ পাবেন এখানে। শুকনো মৌসুমে পানি কম থাকে বলে অনেক সময় ছোট ছোট মাছগুলো লাফ দিয়ে ডিঙ্গিতে উঠে যায়। রমিজ মাঝি বনের ভেতরে এক গাছের ছায়াতে নৌকা থামালেন। হঠাৎ চোখে পড়ল এক দল বাঁদর এই গাছ থেকে ওই গাছে ছুটোছুটি করছে। আমাদের ফিরার সময় চলে আসছে আমরা ফিরছি। আমরা ফেরার সময় জোয়ার ছিল তাই গাছগুলো পুরো ডুবে গিয়েছিল পানিতে। সূর্যাস্তের কিরণ ছড়িয়ে পড়ল আকাশজুড়ে। সেই সঙ্গে অগণিত পাখির নীড়ে ফেরার ব্যাকুলতা। বন গোধূলির স্পনিল মোহে আছন্নে হয়ে কখন যে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার আঁধারে ঢুকে গেছে টের পাইনি। রাতারগুল যাওয়ার পথ ১. সিলেটের বন্দরবাজার পয়েন্ট থেকে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে মটরঘাট (সাহেব বাজার হয়ে) পৌঁছাতে হবে, ভাড়া নেবে ৩০০-৪০০ টাকা আর সময় লাগবে ঘণ্টাখানেক। এরপর মটরঘাট থেকে সরাসরি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে চলে যাওয়া যায়, এতে ঘণ্টাপ্রতি ৪০০-৫০০ নেবে। এই পথটিতেই সময় ও খরচ সবচেয়ে কম। ২. সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে গোয়াইনঘাট পৌঁছানো, ভাড়া পড়বে ৭০০ টাকা। ওসমানী এয়ারপোর্ট, শালুটিকর হয়ে যাওয়া এই রাস্তাটা বর্ষাকালে খুবই সুন্দর। এরপর একইভাবে গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে, ভাড়া ১ হাজার থেকে ১৫শ এর মধ্যে (আসা যাওয়া) আর সময় লাগে ২ ঘণ্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে, এতে ঘণ্টাপ্রতি ৩০০-৪০০ নেবে। ৩. সিলেট থেকে জাফলং তামাবিল রোডে সারীঘাট হয়ে সরাসরি গোয়াইনঘাট পৌঁছানো। এরপর গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে, ভাড়া ১ হাজার থেকে ১৫শ এর মধ্যে (আসা-যাওয়া) আর সময় লাগে ২ ঘণ্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে, এতে ঘণ্টাপ্রতি ২০০-৩০০ নেবে। বনে বা তার আশপাশে খাবার বা থাকার কোন ভাল ব্যবস্থা নেই। তাই খাবার গোয়াইনঘাট বা সিলেট থেকে নিয়ে আসা যায়। আরেকটা বিষয়, নৌকায় করে ঘোরার সময় পানিতে হাত না দেয়াই ভাল কারণ জোঁকসহ বিভিন্ন পোকামাকড় তো আছেই, বিষাক্ত সাপও পানিতে বা গাছে দেখতে পাওয়া যায় অনায়াসেই। যারা সাঁতার জানেন না, সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখতে পারেন। তবে বনের পরিবেশ নষ্ট করবেন না, আর পলিথিন, বোতল, চিপস-বিস্কুটের প্যাকেট এসব জিনিস পানিতে ফেলবেন না দয়া করে। আমাদের নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। পরামর্শ : রোদের জন্য ছাতা নিতে পারেন। তবে দুপুর টাইমে না যাওয়াই ভাল। খুব সকালে অথবা বিকেলে গেলে অনেক পাখি দেখতে পারবেন। তাদের কিচির-মিচিরে পরিবেশটা হবে অন্যরকম।
×