ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিন মাস ধরে বেতন পায় না ২শ’ কর্মী

ছয় কোটি টাকা হজম করেও বহাল

প্রকাশিত: ০৩:১৯, ৬ মে ২০১৬

ছয় কোটি টাকা হজম করেও বহাল

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বেসরকারী সংস্থা কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট (সিএইচসিপি) থেকে ছয় কোটি টাকা আত্মসাতসহ একাধিক অনৈতিক কর্মকা-ের প্রমাণ পাওয়ার পরেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন সংস্থার চেয়ারম্যান, নির্বাহী পরিচালক ও অর্থ সমন্বয়কারী। তাদের দুর্নীতির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে দাতা সংস্থার অর্থ। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে ২৯টি অফিসে কর্মরত দু’শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে সংস্থাটির যাত্রা শুরু হয়। কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার কাঠিরা গ্রামে স্থাপিত প্রধান কার্যালয় থেকে। পর্যায়ক্রমে সংস্থার কার্যক্রম বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ২৯টি শাখা অফিসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রধান কার্যালয় নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানান, শুরুতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করলেও পর্যায়ক্রমে উন্নয়ন প্রকল্প বাদ দিয়ে ১৯৮৪ সাল থেকে দাতা দেশ জার্মানি (ইজেডই) সরকারের অর্থ সহায়তায় মাইক্রো ক্রেডিটের কাজ শুরু হয়। যা ছিল সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত। দাতা সংস্থা তাদের হেলথ কেয়ার প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দিত। প্রয়োজনে মহিলাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিনাসুদে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প চালুর নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদ সবকিছু বাদ দিয়ে দাতা দেশের অর্থ মাইক্রো ক্রেডিটে ব্যবহার করে। ফলে দাতা সংস্থাকে কাগজে কলমে দেখানো হতো হেলথ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। সূত্রমতে, দুই বছর মেয়াদী কমিটি নবায়নের কথা থাকলেও তা একটানা ২১ বছর চেয়ারম্যানের পদ আগলে রেখেছেন দুর্নীতিবাজ সুধীর অধিকারী। তার সরাসরি মদদে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ডাঃ সঞ্জীব কুন্ডু ও অর্থ সমন্বয়কারী জেমস মহানন্দ ম-ল সংস্থার টাকা লুটপাটের মহোৎসবে মেতে ওঠেন। আরও জানা গেছে, অর্থ সমন্বয়কারী মহানন্দ ম-লের বিরুদ্ধে সংস্থায় কর্মরত নারী কর্মকর্তাদের যৌন হয়রানির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে তার বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে। ওইসব মামলার ব্যয়ভার বাবদ প্রায় দুই লাখ টাকা মহানন্দ অফিস থেকেই নিয়েছেন। নারী কর্মকর্তাদের কাছে টানতে মহানন্দ বেতন বৃদ্ধি এবং পদোন্নতির লোভ দেখাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তার কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ঢাকার আরবান প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প ব্যবস্থাপক উপজাতি সম্প্রদায়ের রুথ সেবিকা রাকসামকে চাকুরিচ্যুতসহ অসংখ্য নারী কর্মকর্তাকে হয়রানিমূলক বদলি এবং চাকরিচ্যুত করেছেন। মহানন্দ নিজের ধর্ম গোপন রেখে নিজেকে মুসলমান দাবি করে মুসলিম পরিবারের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ওই নারীকে মহানন্দ তালাক দিয়েছেন। এছাড়া মহানন্দ নিজে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সংস্থার বিভিন্ন শাখায় কয়েক লাখ টাকার জাল রেভিনিউ স্ট্যাাম্প সরবরাহ করতেন বলেও প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কমিশন। বিষয়টি জানতে পেরে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে দাতা সংস্থা দুর্নীতিবাজ পরিচালক সুধীর অধিকারীকে সংস্থার পদ থেকে সরে যেতে বলেন। কিন্তু তিনি সরে না যাওয়ায় দাতা সংস্থা ফান্ড দেয়া বন্ধ করে দেয়। এতে যেকোন মুহূর্তে সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মিরপুর শাখা ব্যবস্থাপক লরেন্স বাড়ৈকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় সিএইচসিপি নয় সদস্য বিশিষ্ট রক্ষা কমিটি। ফলে গত ৯ নবেম্বর অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয় লরেন্স বাড়ৈকে। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি সুনির্দিষ্ট ১০টি ঘটনা উল্লেখ করে লরেন্স বাড়ৈ প্রধানমন্ত্রীর দফতর, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন। এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কেএম আব্দুস সালাম ওই সংস্থার পরিচালক-১ গোলাম মেজবাহ উদ্দিনকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। তদন্ত কর্মকর্তা ৬ কোটি টাকা আত্মসাত ও তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কর্মরত নারী কর্মকর্তাদের যৌন হয়রানিসহ সুনির্দিষ্ট ১০টি অভিযোগের বাইরেও তথ্য প্রমাণে আরও বিস্তার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ছয় পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদন দাখিলের পর আজও ওই তিন কর্মকর্তা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। ফলে বিপাকে পড়েছেন ২৯টি অফিসে কর্মরত দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা মাইক্রো ক্রেডিট চালিয়ে রাখলেও বেতন বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
×