ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সত্যজিৎ স্মরণে ॥ সত্যজিতের ‘অপুর সংসার’ই হয়ে গেল আমার চলচ্চিত্র জগতের ভিত্তি-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ৫ মে ২০১৬

সত্যজিৎ স্মরণে ॥ সত্যজিতের ‘অপুর সংসার’ই হয়ে গেল আমার  চলচ্চিত্র জগতের ভিত্তি-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

অভিনয় জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই বয়সেও দুই বাংলার আবৃত্তি, মঞ্চ ও টিভি নাটক এমনকি চলচ্চিত্রাঙ্গনেও তার সরব পাদচারণা। সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ১৪টিতেই দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন তিনি। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়ের মহান সৃষ্টি ‘অপু’। সেলুলয়েড কিং সত্যজিৎ রায়ের সেই অপু চরিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা ও আবৃত্তিকার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথোপকথনের চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন পান্থ আফজাল অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক কিভাবে হলো? সৌমিত্র : বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। কিন্তু তখনো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেয়া যেত না। সে কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। এসব দেখেই এক সময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ে। বাবা আমাকে বোঝাতেন, কীভাবে অভিনয় করতে হয়, আবৃত্তি করতে হয়। পরবর্তীতে কলকাতায় শিশির কুমার ভাদুড়ীর অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ বাড়ে। একইসঙ্গে অভিনয়, নির্দেশনা, কবিতা লেখা, নাটক রচনা বা পত্রিকার সম্পাদনা কিভাবে করেন? সৌমিত্র : গত পাঁচ দশক ধরে নিরন্তর ছবিও আঁকছি। ওটাও আমার আরেকটি ভালবাসা। খেলাধুলোতে উৎসাহ ছিল; তবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো না। একবার একনাগাড়ে ৬৩ দিন জ্বর ছিল শরীরে। ডাক্তার বাবু আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। শরীর আরও ভেঙে যায়। পড়াশোনা মোটামুটি করতামÑ এমন নয় যে সবাই ধন্য ধন্য করবে। কিন্তু খুব ছোটবেলা থেকে যখনই অভিনয় করতাম, সবাই ভাল বলত। ওই লোভটা আমার ভেতরে দ্রুত বেড়ে উঠেছিল। ভাবলাম, অভিনয় করলে নিজেকে আড়াল করা যাবে। সবাই ভাববে, এ তো অভিনয় করছে, বাস্তবে এমন না। টিভি, চলচ্চিত্র ও মঞ্চে অভিনয় একটা থেকে আরেকটা কতটুকু ভিন্ন? সৌমিত্র : প্রথমত অভিনয়। তারপর পরিবেশ বুঝে উপস্থাপনা। এতে আমি কোন পার্থক্য খুঁজে পাই না। যিনি ছবি আঁকেন, তিনি ছোট ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন, বড় ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন। কবে থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবি হয়ে ওঠা? সৌমিত্র : কিশোর বয়স থেকেই একটু একটু করে কবিতা লেখার শুরু। এর মূল উৎস হলো অব্যক্ত কথা প্রকাশ করার প্রয়াস। এখনকার সময়ে ছেলেরা তো যেখানে-সেখানে মেয়েদের নিজের গোপন কথাটি বলে দেয়, হাত ধরে ফেলে, আমাদের সময় সেটা সহজ ছিল না। আর সেই অব্যক্ত বাসনা থেকেই কবিতা লেখার শুরু। আবৃত্তিচর্চায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশালত্বকে কিভাবে পান? সৌমিত্র : আবৃত্তিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছেই আমার ‘ঋষি ঋণ’। ‘রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠ নিয়ে আমার পরিবারের লোকেরাও নানা কথা বলত। ওই সময়ে আবৃত্তির রেকর্ডিংগুলো খারাপ মানের ছিল। তবে দেশের বাইরে যে দু-একটা রেকর্ডিং আছে, তা শুনেই বুঝেছি, তাঁর কণ্ঠে কী গভীরতা ছিল। অভিনয় করার ক্ষেত্রে আবৃত্তিচর্চার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না? সৌমিত্র : এটা অভিনয়ে ভীষণ রকম দরকার। যারা এটা বোঝেন না, তারা এখনও চোখ বুঁজে আছেন। অভিনয়ের প্রারম্ভিক কাজÑ কথা বলা, সেটা আবৃত্তিচর্চা ছাড়া হয় না। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পরিবার পরিজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে আবৃত্তি এবং গান করি। সর্বোপরি একজন অভিনেতাকে চার অক্ষরের একটি শব্দকে আঁকড়ে রাখতে হয় তা হলো, ভালবাসা। ভালবাসা ছাড়া কিছু হয় না। চলচ্চিত্রে পথচলা আর ‘অপু’র গল্পটা শুনতে চাই? সৌমিত্র : এমএ পড়াকালীন ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে জগতবিখ্যাত পরিচালক তখন সত্যজিৎ রায়। এর দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে তিনি ‘অপরাজিত’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভাবছিলেন। এ ছবির ‘অপু’ চরিত্রের জন্য একজন অভিনেতা খুঁজছিলেন তিনি। সত্যজিৎ বাবু আমাকে দেখামাত্র বললেন, ‘আরে না না, তোমার বয়সটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।’ তাই সত্যজিতের পরবর্তী ছবি অপুর সংসারই হয়ে গেল আমার চলচ্চিত্রজগতে ভিত্তি গড়ে তোলার গল্প। তারপর তো সেই ‘অপু’ চরিত্রের মাধ্যমেই আজ আপনাদের কাছে আমার পরিচিতি। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সখ্যের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? সৌমিত্র : সত্যজিৎ রায়ের কাজের নিমগ্নতা ছিল প্রশংসার যোগ্য। সত্যজিৎ রায় সহকারীর এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারলেন, সৌমিত্র নামের একটি ছেলে অভিনয় করে। তা থেকেই আমার সেখানে যাওয়া। এভাবেই শুরু। একদিন সত্যজিৎ রায় আমাকে ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ছবিদা, এর নাম সৌমিত্র। এ হচ্ছে আমার অপুর সংসারের অপু।’ তখন আমি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করি। ‘তারপর একের পর এক সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করেছি। সেদিন থেকে বিপুল লড়াই, সংগ্রাম করে ৫৫ বছর ধরে টিকে আছি।’ একজন সত্যিকার অভিনেতার কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরী? সৌমিত্র : তিনিই সত্যিকার অভিনেতা, যিনি সমাজের ভাবনা-চিন্তা, অবস্থা প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিতে পারেন। চিরসবুজ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের তরুণ থাকার রহস্য জানতে চাই? সৌমিত্র : ব্যাপারটা আসলে ঠিক তা নয়। বাইরে থেকে হয়তো লোকেরা চিরসবুজ ভাবে। আসলে তো কেউ চিরসবুজ থাকে না। বিশেষ করে চিরসবুজ থাকার জন্য মানুষের মাঝে যে ইচ্ছে জন্মায়, সেটা হয়তো এই হতে পারে যে, আমি এখনও কর্মক্ষম আছি কিংবা কাজে ব্যস্ত আছি। এখনও নাটক করছি, নাটক লিখছি। কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে নিয়মিত ডাকা হয় এবং আমি তাতে অংশগ্রহণ করি। আর অসুখ-বিসুখ কিছুটা তো আছেই, সেগুলো নিয়েই তো জীবনটা চলছে।
×