ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিনরাত চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ ॥ কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২০ এপ্রিল ২০১৬

দিনরাত চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ ॥ কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

আজাদ সুলায়মান ॥ রাত তখন তিনটা। সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন তখনও কানে ভেসে আসে। তারই পাশে নিবিষ্ট মনে কাজ করে চলেছেন একদল দেশী-বিদেশী প্রযুক্তিবিদ। সঙ্গে দক্ষ শ্রমিক। তারা কাজ করছেন বিমানবন্দরের একটি কেবল ডাট ড্রেনেজের। পরদিন সকাল দশটা। তখনও গিয়ে দেখা যায় সেখানে আরেক টিম। তারা চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যা থেকে আসে আরেক দল। এভাবেই তারা পালাক্রমে দিবারাত্রি কাজ করছেন কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। গত নয় মাস ধরে এ প্রকল্পে কাজের এমন ধুমই চোখে পড়ে। দ্রুত এগিয়ে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে কাজের হার। কী রোদ, কী বর্ষা, কী রাত, কী দিন- থেমে নেই কাজ। বিমানবন্দরজুড়ে চলছে একযোগে কাজ। কেউ মাটি কাটে, কেউ বালি সরায়, কেউ পাথর ভাঙ্গে, কেউ রোলার দিয়ে মাটি মসৃণ করে। কেউ সমুদ্রের ঢেউ ভেঙ্গে গড়ে তোলে এ্যাপ্রোচ লাইটিং সিস্টেমের পিলার, যা দেশের প্রথম তো বটেই; বিশ্বনন্দিত আধুনিক লাইটিং সিস্টেম হিসেবে খ্যাত। বহুল আলোচিত এ প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি সরেজমিন পরিদর্শনের সময় চোখে পড়ে বিশাল এই কর্মযজ্ঞ। কক্সবাজারের মানুষ যখন ঘুমে আচ্ছন্ন তখন রাত জেগে সেখানে একদল দেশী-বিদেশী প্রযুক্তিবিদ ও শ্রমিককে নিবিষ্ট মনে কাজ করতে দেখা যায়। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই যাতে বর্তমান সরকারের মেয়াদে প্রকল্পটা উদ্বোধন করা যায় সে লক্ষ্যেই সিভিল এ্যাভিয়েশনের প্রকৌশল বিভাগ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট। প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দুু বিকাশ গোস্বামীর নেতৃত্বে একদল মেধাবী ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী এ বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে বিশ্বের যে কোন দেশ থেকে সরাসরি আকাশপথে পৌঁছার সব রকমের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও সুযোগ-সুবিধাসংবলিত কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার প্রকল্পটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহের ফসল। তিনি নিজে এ প্রকল্পের বিষয়ে যথেষ্ট কৌতূহলী। বর্তমান সরকারের বিগত আমলেই প্রকল্পের কাজটি হাতে নেয়া হয়। কিন্তু দরপত্র জটিলতায় সে সময়ে কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। দেশী-বিদেশী অর্থায়নে এ প্রকল্পটি দুটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। প্রথম পর্যায়ের ৫৭০ কোটি ব্যয়ে ৩০ মাসের মধ্যে এটিকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার জন্য কার্যাদেশ দেয়া হয়। এজন্য নিয়োগ করা হয় দেশী-বিদেশী তিনটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান- কোরিয়ার ইয়োশিন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন, আইএল শিন হাইটেক ও দেশীয় ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্ট লি.। প্রকল্পের ঠিকাদারির দায়িত্বও পেয়েছে কোরিয়ার হাল্লা এমএইচ শিওকওয়াং জেভি ও দেশীয় শীর্ষস্থানীয় মীর আখতার হোসেন লিমিটেড। এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে- বর্তমান রানওয়ে ৭৬৬৫ ফুট থেকে ৯ হাজার ফুটে উন্নীতকরণ, ১৫০ ফুট রানওয়ের চওড়া বৃদ্ধি করে ২০০ ফুটে উন্নীতকরণ, রানওয়ের শক্তিবৃদ্ধিকরণ, এয়ারফিল্ড লাইটিং সিস্টেম স্থাপন, ফায়ার ফাইর্টিং ভেহিক্যাল ক্রয়, সমুদ্রতীরবর্তী বাঁধ নির্মাণ ও নাব্য যোগাযোগের জন্য আইএলএস, ডিভিওআর স্থাপন। মাত্র ৩০ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে কাজ শুরু হয় গত জুলাইয়ে। প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ৩২১ দশমিক ৩৪ হেক্টর ভূমি ইতোমধ্যে অধিগ্রহণ করে ভূমি উন্নয়নের কাজ বহুলাংশেই সমাপ্তির পথে। এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের পুনর্বাসনের কাজও যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রকল্পের অন্য গুরুত্ব কাজগুলো হচ্ছেÑ ৮৩৯০ বর্গমিটার নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণ, ড্রেনেজ সিস্টেম নির্মাণ ও অগ্নিনির্বাপক গাড়ি সরবরাহ। পরিদর্শনে দেখা যায়, পুরনো জরাজীর্ণ কক্সবাজার বিমাবন্দরের চারপাশেই একযোগে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাইট অফিস, লেবার শেড, স্টোর, ল্যাবরেটরি ভবন, মেটারিয়াল স্টেকইয়ার্ড ও প্ল্যান্ট নির্মাণের মাধ্যমে গোটা বিমানবন্দরের চেহারা বদলে দিয়েছে। সমুদ্রতীরবর্তী জমি থেকে মাটি ও বালু কেটে সমতল করার কাজ প্রায় শেষের পথে। আসন্ন বর্ষার আগেই মাটি ভরাটের মূল কাজ শেষ করার প্রত্যয়ে দিবারাত্রি বুলডোজার দিয়ে মাটির কাজ করা হচ্ছে। রাতে ১০০টি ফ্লাড লাইটের আলোতে যখন সবকটি পয়েন্টে কাজ চলে তখন সমুদ্রের নাবিকেরও দৃষ্টিগোচর হয় দিবালোকের মতোই। কক্সবাজারবাসী ও দেশী-বিদেশী পর্যটকরা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় কবে নাগাদ শেষ হবে এ কাজ, কী কী সুবিধা থাকবে তাতে? প্রশ্ন ছিল আমাদেরও- কী কী থাকছে বহুল প্রতীক্ষিত এই বিমানবন্দরে? এটি কি শুধু নামে মাত্র আন্তজার্তিক, নাকি সত্যি সত্যিই তাতে থাকবে সে সুবিধাগুলো? সিভিল এ্যাভিয়েশনের তরুণ ও মেধাবী প্রকৌশলী আামিনুল হাসিব যিনি এটির প্রকল্প পরিচালক পাল্টা প্রশ্ন রাখলেন- কী থাকছে না? একটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ ল্যান্ডিং ও টেক অফ করতে যা যা লাগে তার চেয়ে আরও অনেক অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বহুমাত্রিক সুবিধা থাকছে। যেভাবে রানওয়ে সাজানো হচ্ছে তাতে পাইলটরা যতটা মুগ্ধ হবেন তারচেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করবেন। প্রথম পর্যায়ে রানওয়েটাই মুখ্য ধরে তার সহায়ক অন্য কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে থাকছে একটি দৃষ্টিনন্দন টার্মিনাল শেড ও অন্যান্য স্থাপনা। পরিদর্শনের সময় দেখা যায়, প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শেষ করার জন্য ইতোমধ্যে এখানে আনা হয়েছে দেশী-বিদেশী প্রযুক্তির সব যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক উপাদান। প্ল্যান্ট স্থাপন, ইকুপমেন্ট আনয়ন ও উপাদানের স্তূপ তো চোখেই পড়ে। এসফল্ট, কংক্রিট পেভার, টায়ার রোলার, গ্রেডার, ট্রেইলার ড্রেজার, ডাম্পট্রাক, এক্সেভটর দিয়েই রাতদিন কাজ চলছে। ১৪টি জেনারেটরের সাহায্যে রাতে ১০০টি ফ্লাড লাইট যখন জ্বলে ওঠে তখন সেখানে এক ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। বিমানবন্দরের দক্ষিণে গড়ে তোলা হয়েছে এক লাখ ঘনমিটার পাথর, দুই হাজার টন বিটুমিন, পাঁচ লাখ ঘনমিটার বালুর স্তূপ। দূর থেকে এসবের স্তূুপ যেন মিনি পাহাড়ের মতো নজর কাড়ে। রাত গভীরে ফ্লাড লাইটের আলোতে মাথা নিচু করে স্যুয়ারেজ ক্যানেল নিমার্ণের সময় কথা হয় কোরিয়ার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইউশিন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের প্রকৌশলী মি. জনের সঙ্গে। তার সঙ্গে কক্সবাজারের স্থানীয় কজন শ্রমিক ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মীর আখতারের তত্ত্বাবধায়ক নির্বাহী পরিচালক মানিক কুমার বিশ্বাস। তারা জানান, এতটুকু সময় নষ্ট করার নয়। দ্রুততম সময়ে প্রকল্প উদ্বোধনের চিন্তা মাথায় রেখে সবাই কাজ করছেন। রাতের নীরবতায় কক্সবাজারের মানুষ যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন এখানে চলে রোলার, ড্রেজার স্টিমলার গ্রাইন্ডিং মেশিনে অত্যানুধিক প্রযুক্তিনির্ভর স্থাপত্যরীতির কাজ। কী রাত কী দিন, নেই কোন ছেদ। বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দেও চলে কিছু কাজ। এভাবে চললে সেটা যে নির্দিষ্ট সময়ের অন্তত ছয় মাস আগেই এ বিমানবন্দর চালু করা সম্ভব তাতে কোন সন্দেহ নেই। অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুনের সময়সীমার ছয় মাস আগেই আগামী বছরের ডিসেম্বরে এটা উদ্বোধন করা সম্ভব। প্রকল্পের কোরিয়ান কর্মকর্তা মি. হাল্লা ও মি. লি জনকণ্ঠকে জানান, কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য যারা পরামর্শক ও ঠিকাদারের কাজ করছেন তারা বিশ্বখ্যাত। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কোরিয়ার ইনচন এয়ারপোর্টের কাজও তারাই করেছে যা দুনিয়াব্যাপী নজরকাড়া নিপুণতার স্বাক্ষর। প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী জানান, কক্সবাজার বিমানবন্দরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এ্যাপ্রোচ লাইটিং সিস্টেম। বিমানবন্দরের উত্তর পাশের রানওয়ের শেষ মাথা থেকে শুরু হয়ে উত্তরদিকে ৯০০ মিটার দীর্ঘ এই স্থাপনা গিয়ে শেষ হয়েছে সমুদ্রের ভেতরে মহেশখালী চ্যানেলে। দূর থেকে এটাকে সমুদ্রের মাঝে একটা ব্রিজের মতো দেখালেও আদতে এটি বিশেষ ধরনের লাইটিং সিস্টেম, যা বাংলাদেশে তো নয়ই, উপমহাদেশের কোন বিমানবন্দরে এত দৃষ্টিনন্দন লাইটিং সিস্টেম নেই। রাতে পাইলট যখন ল্যান্ড করার জন্য এগিয়ে আসবেন রানওয়ের দিকে তখন গভীর সমুদ্রাকাশে অবস্থান করে তিনি নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাবেন। যাত্রীরাও এ আলোর অপরূপ সৌন্দর্যলীলায় ক্ষণিকের জন্য দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি ভুলে যাবেন। ঢাকা থেকে ওই কাজের সার্বিক নির্দেশনা দিচ্ছেন প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী। প্রচারবিমুখ এই প্রকৌশলীর একটাই ব্রত- যে করেই হোক নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দক্ষতার সঙ্গে কক্সবাজারের রানওয়েতে আন্তর্জাতিক বিমান ওঠানামা করতে হবে। এ জন্য তিনি নিয়োগ দিয়েছেন সিভিল এ্যাভিয়েশনের বাছাই করা মেধাবী ও দক্ষ কজন প্রকৌশলীকে। তারা ঢাকা ও কক্সবাজারের মধ্যে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছেন, যাতে বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজে বিন্দুমাত্র ভুলত্রুটি বা গাফিলতি না ঘটে। প্রকল্প পরিচালক আমিনুল হাসিব বলেন, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই রানওয়ে খুলে দিয়ে বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া- এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাজ কত দ্রুততম সময়ে অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে করা যায়। এ বিমানবন্দর চালু হলে গোটা কক্সবাজারের চেহারা পাল্টে যাবে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বিস্তৃতি ঘটবে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যের বর্ণচ্ছটা। বিশেষ করে আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে- মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, মিয়ানমার, ভারত, সিঙ্গাপুর, ঝুয়াংঝু ও কোরিয়ার অন্যতম নির্ভরযোগ্য বিমানবন্দরের মর্যাদা পাবে এটা। এটা তখন পর্যটনের এ্যাভিয়েশন সেক্টরের আঞ্চলিক হাব হিসেবে গড়ে উঠবে, যা গোটা কক্সবাজার নয়; গোটা দেশের অর্থনীতি ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করবে। এ প্রকল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, দ্রুততম সময়ে মানদ- কাজ সম্পন্ন করার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হচ্ছে বিমানবন্দরের তিন আশপাশের ভূমি অধিগ্রহণ ও তাদের পুনর্বাসনের ওপর। এটার দায়িত্বে রয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। যত দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হবে তত দ্রুতই সম্ভব হবে এ প্রকল্পের কাজ। এটা এখন নির্ভর করছে জেলা প্রশাসনের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার ওপর।
×