ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

বছরের পর বছর প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড কার্যালয়ে ঘুরছে, টাকা জোটেনি কারও কপালে

প্রবাসে নিহত ৬ হাজার কর্মীর পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৯ এপ্রিল ২০১৬

প্রবাসে নিহত ৬ হাজার কর্মীর পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি

ফিরোজ মান্না ॥ শাহীনা ইয়াসমিন, ১৫ বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন। তাঁর স্বামী ওমর ফারুক সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সেই থেকে নিজেই টানছেন জীবনের ঘানি। ছোট তিন এতিম সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে তাদের। প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের টাকা ও স্বামীর কর্মস্থলের ইন্স্যুরেন্সের টাকার জন্য আবেদন করেন। শুরু হয় ঢাকায় আসা-যাওয়া। প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড এ নিয়ে কেবল চিঠি চালাচালি ছাড়া আর কোন কিছু করতে পারেনি। ১৫ বছরে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড ১৮ চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। আর এই ১৮ চিঠির অনুলিপি পেয়েছেন শাহীনা। তাছাড়া আর কিছু জোটেনি তার কপালে। এখন তিনি হতাশ। টাকার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। সম্প্রতি শাহীনা ইয়াসমিনের সঙ্গে আলাপ হয় প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড কার্যালয়ে। আলাপকালে বলেন, ১৫ বছর ধরে তিন সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে। অনেক কষ্ট করে তাদের অল্প কিছু লেখাপড়া করিয়েছি। এক মেয়েকে বিয়েও দিয়েছি। এসব করার পাশাপাশি স্বামীর প্রাপ্য টাকার জন্য লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরবগা গ্রাম থেকে প্রতিমাসেই একবার করে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। কোন কোন মাসে দুই বারও ঢাকায় এসেছি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামী ওমর ফারুক ১৫ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় সৌদি আরবে মারা যান। দুই মেয়ে এক ছেলের সংসার তার। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছেলে তখন নবম শ্রেণীতে পড়ত। ওমর ফারুক যখন মারা যায় তখন ৮ মাসের গর্ভবতী ছিলেন শাহীনা। সৌদি আরব থেকে দেশে এনে ওমর ফারুকের লাশ দাফনের মাস খানেক পর শাহীনা জন্ম দেন শিশুপুত্র ওমর আরবের। বাবার দেখা মেলেনি তার। মনে অনেক ক্ষোভ আর দ্রোহ নিয়ে বছরের পর বছর তিনি ঢাকা আসছেন। আবার নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তার এই আসা-যাওয়া কবে শেষ হবে তা তিনি জানেন না। এদিকে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন দেশে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ছয় হাজারের বেশি প্রবাসী কর্মী। তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় ক্ষতিপূরণের আবেদন করা হয়েছে। বর্তমানে এ ধরনের তিন হাজার ৭৭৩ আবেদন কল্যাণ বোর্ড ও জেলা জনশক্তি ব্যুরোর কার্যালয়ে পড়ে আছে। আবেদনগুলো বছরের পর বছর পড়ে থাকলেও এ গুলোর কোন সুরাহা হচ্ছে না। দুই হাজার ৩৮৭ আবেদন ২২ দূতাবাসে জমা আছে। ওই আবেদনগুলো নিয়ে দূতাবাস কোন প্রকার ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। জানা গেছে, দুই হাজার ৩৭৪ জন জেদ্দায়, রিয়াদে এক হাজার ৩২ জন নিহতের পরিবার এখন পর্যন্ত কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি। আবুধাবিতে নিহত ৭৭১, দুবাইতে নিহত ৩৯৮ জনের পরিবারও কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি। মালয়েশিয়ায় ৬০৭ জন। এর মধ্যে ১৪৬ নথি দূতাবাসে ও ৪৬১ নথি জনশক্তি কার্যালয়ে আটকে আছে। সিঙ্গাপুরে ২০৩, কুয়েতে ১৮৯, বাহরাইনে ২০২, লিবিয়ায় ৯২, লেবাননে ৩১, ইতালিতে ২২, মিসরে ১১, ব্রুনেইয়ে ৯, গ্রিস ও জর্দানে ৮, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৭, মালদ্বীপে ৬, মরিশাস, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ায় একজন করে মৃত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণের আবেদন পড়ে আছে। নিহত প্রবাসী পরিবারগুলো আবেদন করে দিনের পর দিন অপেক্ষা করলেও কেন তারা টাকা পাচ্ছেন না তা কেউ বলতে চাননি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদিশেক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম শামসুন নাহার এ বিষয়ে কোন কথা বলেননি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসির সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। বিএমইটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও কিছু বলতে চাননি। নিহত ওমর ফারুকের স্ত্রী শাহীনা ইয়াসমিন ১৫ বছর কেন কিসের আশায় ঘুরছেন সেই কাহিনী অনেক বড়। তবে তিনি এই ১৫ বছর নষ্ট করলেও হাল ছাড়েননি। তিনি বলেন, ২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবের দাম্মাম আল খোবার এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তার স্বামী। সৌদি আরবে নিজ কর্মস্থল রোড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন তিনি। দুর্ঘটনার পর তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। তার পাসপোর্ট নং ০৩৩৯৪০৪, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ নং-১০৫৬৩/২০০১ দূতাবাস পত্র নং এলডব্লিউ/এ-১২৮/২০০১। মৃত্যুর পর কয়েক দিনের মধ্যে ওমর ফারুকের লাশ দেশে এনে দাফন করা হয়। শাহীনা ইয়াসমিন বলেন, সেই সময়ই তিনি তার স্বামীর মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডও প্রবাসে মৃত্যু হলে তার জন্য ক্ষতিপূরনেণর টাকা দিতে বাধ্য। কারণ একজন কর্মী যখন বিদেশে চাকরি নিয়ে যান তখন তাকে কল্যাণ বোর্ডে টাকা জমা দিয়ে যেতে হয়। সেই টাকা থেকেই আমার স্বামী টাকা পাবেন। তাছাড়া তিনি যে কোম্পানিতে চাকরি করতেন সেখান থেকে পাবেন ইন্স্যুরেন্সের টাকা। আমরা জেনেছি, প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডে প্রবাসী কর্মীদের হাজার কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এখান থেকে প্রাপ্য টাকা তিনি পাবেন। কিন্ত সেই ক্ষতিপূরণ পেতে তাদের ১৫ বছর ধরে ঘুরতে হচ্ছে। আরও যে কত বছর ঘুরতে হবে কে জানে। একের পর এক চিঠি চালাচালিই চলছে। আর আমরা পাচ্ছি তার অনুলিপি। স্বামীর মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা ছেড়েই দিতে হচ্ছে তাকে। কর্মকর্তারা যেন তার সঙ্গে তামাশা করে যাচ্ছেন। যদি আইন না থাকত, যদি ক্ষতিপূরণের টাকার কোন ব্যবস্থা না থাকত তাহলে এ নিয়ে কোন কথা ছিল না। যেহেতু সরকার এমন আইন বা ব্যবস্থা রেখেছে তাই ক্ষতিপূরণের টাকার আশায় বছরের পর বছর ঘুরছি। আমরা যে টাকার আশায় এতদিন বেঁচে আছি, সেই টাকা আসলে পাব কিনা জানি না। স্বামীর কর্মস্থল থেকেও কোন ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। আমার স্বামীর একটা ইন্স্যুরেন্স ছিল। জেনারেল অর্গাইনেজশন অব সোসাল ইন্স্যুরেন্স(গোসি)। ওই কোম্পানিও ইন্স্যুরেন্সের টাকা দেয়নি। মারা যাওয়ার পর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষ থেকে চাহিদা মাফিক প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠিয়েছি। স্বামীর ইন্স্যুরেন্স বাবদ আমাদের নামে ২২ হাজার রিয়াল দেয়ার কথা জানানো হলেও আজ পর্যন্ত কোন চেক কিংবা টাকা পাঠায়নি তারা। যতবার ওই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় ততবারই তারা বলে চেক পাঠাচ্ছি- পাঠাব বলে টালবাহানা করেই যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে গত ২২ মার্চ উক্ত ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সৌদি রাষ্ট্রদূতের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করি। স্বামীর ইন্স্যুরেন্স গোসি কোম্পানির সিরিয়াল নং ৮৩৬৩৬৫৪৪৫ ফাইল নং ৭-৬৬৮৫। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানোর পর দীর্ঘ ১৩ বছর কেটে গেছে। কিন্তু ওই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি কোন ক্ষতিপূরণ দেয়নি ওমর ফারুকের পরিবারকে। ২০১৪ সালে ই-মেলে শাহীনা ইয়ামিন সৌদি দূতাবাসে অভিযোগ জানান। তার কিছু দিন পর গোসি তাকে জানায়, মৃত ওমর ফারুকের পরিবারের নামে সাতটি চেকে ২২ হাজার রিয়াল পরিশোধ করা হয়েছে। শাহীনা ইয়াসমিন কোন চেক কিংবা টাকা পায়নি মর্মে আবারও অভিযোগ দায়ের করলে ওই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি অভিযোগ তদন্ত করে সত্যতা খুঁজে পায়। গোসি থেকে শাহীনা ইয়াসমিনকে জানানো হয় ২২ হাজার রিয়ালের সাতটি চেক পাস হয়েছে ঠিকই কিন্ত সেগুলো ক্যাশ হয়নি। দ্রুত চেকগুলো পাঠানো হবে বলে আবার তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এরপর আরও দুই বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু কোন চেক পাঠায়নি ওই কোম্পানি। এভাবেই কেটে যাচ্ছে শাহীনার দিন। শুধু শাহীনা নন, এমন অনেক শাহীনাই রয়েছেন যাদের পরিবার ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি। বছরের পর বছর ঘুরেও তারা ক্ষতিপূরণের কোন কিছুই তাদের কপালে জোটেনি।
×