ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবারের আনন্দমুখর বৈশাখ

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ১১ এপ্রিল ২০১৬

পরিবারের আনন্দমুখর বৈশাখ

বর্ষবরণের এই উৎসব আমাদের শত-সহস্র বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি তথা পেশাদারিত্বের একটি তাৎপর্যময় দিন এটি। ছেলেবেলায় আমরা এ উৎসব পালন করেছি অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে পাট-পূজা, চড়ক পূজা, অষ্টক গান, সঙ সাজা, মেলার পসরা সাজিয়ে তোলা এসবের প্রভাব বা ভাষার ওপর এত বেশি যে আমরা যেখানে, যতদূরেই যাই না কেন আমাদের তা ছুঁয়ে থাকে। এখনও যে উৎসবের জাঁকজমক কমে গেছে তা নয়। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম, চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রা ইত্যাদিতে তরুণ বয়সী ছেলেমেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কারও ভাল না লেগে যায় না। তবে এটাও সত্যি যে, আজকের বিশ্বায়নের যুগে সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তারপরও কিন্তু বাঙালীুুুুুুুু তার শেকড় খোঁজার চেষ্টা করে একটা জায়গায়। আর সেটা হয় আমরা বাঙালী বলেই। জাতি হিসেবে আমরা সাংস্কৃতিক উৎসব মুখরতায় বিশ্বাসী। বাংলা নতুন বছরে তাই আমাদের চেতনা থাকে নিজেদের ঐতিহ্য আর প্রকাশভঙ্গিকে তুলে ধরার। পহেলা বৈশাখ আমাদের কাছে অর্থাৎ নাগরিক জীবনযাপনে যতটা না পার্বণ তার চেয়ে বেশি কার্নিভাল। তাই এর লোকায়ত রূপে আমরা দিয়েছি কঠিন চার দেয়ালের স্পর্শ। সেই স্পর্শের যাতনায় পহেলা বৈশাখ এখন ছুটে চলছে রমনায় ছায়ানটের গান শুনতে কিংবা মেলা, রেস্টুরেন্ট অথবা কাফেতে বসে পান্তা-ইলিশ আর পেঁয়াজকুচি খেতে, কখনও কখনও আমরা ছুটছি ভোর সকালে মুখোশ হাতে আনন্দ র‌্যালিতে, গানপাগল তরুণরা চাইছে ওপেন এয়ার কনসার্ট, সানসিল্ক খুঁজে চলছে রমনা বটমূলে কিংবা চারুকলা চত্বরে সুন্দরী সৌভাগ্যবতী রূপসীদের। বাংলা নববর্ষের উদযাপন শুরুটা হয়েছিল সম্রাট আকবরের শাসনামলে। সে সময় পহেলা বৈশাখ প্রথম উদযাপিত হতো চৈত্রের সমাপ্তিতে সব খাজনা পরিশোধের আনন্দে। আর মোগলরা শাসক হিসেবে আনন্দিত হতো খাজনাপ্রাপ্তির প্রত্যাশায়। নতুন খাজনার খাতা খুললে তারা তার নাম দিয়েছিল হালখাতা। একপক্ষ উৎসব করছে দায়মুক্তির আর অন্যপক্ষ উল্লাসে মেতে উঠছে নতুন দিনের দায় পাবে এই আশায়। দুই প্রাপ্তির মিলনের ফলেই প্রথম বাঙালী এমন এক উৎসব পেল যাতে অংশগ্রহণ থাকল সমাজের সর্বশ্রেণীর। আর আমরা পেলাম পহেলা বৈশাখ। ১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবর যে প্রত্যাশায় পহেলা বৈশাখের সূচনা ঘটিয়েছিলেন তা আজ আর আকবরের প্রত্যাশার সীমানায় নেই। ১৮৬৭ সালে কলকাতার ঠাকুর পরিবারে যে নববর্ষ উৎসব পালনের রীতি তৈরি হয়েছিল তা এখন ছাড়িয়ে গেছে শুধু বনেদী পরিবারগুলোতে নয় বরং মেট্রোপলিটন-কসমোপলিটন লাইফের প্রতিটি স্তরে। ১৯৬৭ সালে ছায়ানট যখন নববর্ষ পালন উৎসব শুরু করে তখন যে উৎসবমুখরতা ছিল তা আজ নতুন রূপ আর নতুন স্টাইলে বাঙালীরা গ্রহণ করে নিয়েছে। বৈশাখ আমাদের জীবনে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার। তাই প্রাণের উপলব্ধিতে বাঙালীর পরিবর্তন বৈশাখী স্টাইলে প্রতিবছর সংযোজন করছে নতুন নতুন ধারা। শুধু পান্তা-ইলিশ নয় ফাস্টফুডের দোকানেও এখন বৈশাখ স্টাইল। তাই তো হোটেল সোনারগাঁও কিংবা রূপসী বাংলায় নয়ত র‌্যাডিসনে আয়োজন করা হচ্ছে বৈশাখী উৎসবের আধুনিক আয়োজন। ফাস্টফুডের দোকানেও চলছে অন্যধরনের বৈশাখী আয়োজন। একতারা আর বাউলের কণ্ঠ বাদ দিয়ে রমনার সবুজ ছায়াতলে কিংবা টিএসসিতে নয়ত গুলশান পার্ক, ফ্যান্টাসি কিংডম অথবা নন্দন পার্কে জনপ্রিয় ব্যান্ড পরিবেশন করছে উদ্দাম রক আর পপ গান। ফ্যাশনে বাঙালীর লোকায়ত ঐতিহ্য ফতুয়া ফিরে এসেছে তবে পুরনো রূপে নয় এক নতুন কাটিংয়ে, নতুন স্টাইলে। তাই বাঙালী মানেই এখন আর সনাতন জীবনধারা নয়। রিমোট কন্ট্রোল জীবন আমাদের। পহেলা বৈশাখ ঐ রিমোটের অন্যতম প্রধান বাটন। যেখানে টিপ দিলেই আমরা পাই আমাদের ঐতিহ্য আর মননে লালিত এমন এক উৎসব যার স্টাইল বদলে যেতে পারে কিন্তু আনন্দের তৃপ্তি বদলায়নি এতটুকুও। বৈশাখ মানেই খানিকটা উত্তাপ। উত্তাপ মানেই লাল রঙের আকুতি। এদিনটিতে পরিবারের সবাই সবার সঙ্গে আনন্দঘন দিন কাটানোর পরিকল্পনা করে থাকে। বাবা মা ভাই বোন সন্তানদের নিয়ে একবেলা আয়েশ করে খাওয়া দাওয়া করা একসঙ্গে ঘুরতে বের হওয়া সবই যেন বৈশাখের আবহ সৃষ্টি করে। এ যেন অন্য রকম দিন। ভাললাগা ভালবাসা দিন। নতুন ও উদ্যোমতার এ বারতা নিয়ে বৈশাখ আমাদের জীবনে আসুক বার বার। ছবি : চন্দ্রবিন্দু
×