ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

রবীন্দ্র-নজরুল ॥ বাংলা সাহিত্যের নারীরা

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ৪ মার্চ ২০১৬

রবীন্দ্র-নজরুল ॥ বাংলা সাহিত্যের নারীরা

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে নারী একটা বিশেষ অংশজুড়ে রয়েছে। এটি শুধু তাদের কল্পনার সৃষ্টি নয়। তাদের বর্ণিল ব্যক্তি ও মনোজগতে নারী সাহচর্য যেমন আনন্দানুভূতি নিয়ে এসেছিল তেমনি গভীর বেদনাও নিয়ে এসেছিল। নারী হয়ত নিরাশার স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে এসেছিল বার বার তা সত্ত্বেও রবীন্দ্র ও নজরুল রচনায় নারী চরিত্র এত সমৃদ্ধভাবে ও মর্যাদার সঙ্গে আলোচিত যা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। নারীর ন্যায্য অধিকারে তাদের লেখা অনেক উঁচুস্তরে নারীকে আসীন করায়। রবীন্দ্র সাহিত্যে নারী আরও ব্যাপকভাবে এসেছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নারী চরিত্র রূপায়িত নানা ব্যঞ্জনায়। তারা যেমন রুচিসম্পন্ন, বুদ্ধিমতী ও সহনশীল তেমনি সমাজের সংস্কারের বলি কিন্তু সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার প্রয়াসও দেখায়। এক্ষেত্রে ‘জীবিত ও মৃত’ ‘সুভা’, ‘শাস্তি’, ‘নষ্টনীড়’, ‘হৈমন্তী,’ ‘বোষ্টমী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘অপরিচিতা’ গল্পের নারী চরিত্রগুলো নারীদের নানামুখী সমস্যা ও সম্ভাবনা চিত্রিত করে নারীকে বিশিষ্ট করে তুলে। নজরুলের ‘নারী’ কবিতায় পুরুষ ও নারীর যে সমতার কথা বলা হয়েছে তা বর্তমানের নারী অধিকারের (ঋবসরহরংস) চেয়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। তার নারী কবিতাটি কাব্যিক গ-ি ছেড়ে সমতায়নের এক বড় বার্তা বহন করে। তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলেন- ‘সাম্যের গান গাই- আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই!’ নজরুলের এই যুগান্তকারী আহ্বান ঋবসরহরংস -এর চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য; কারণ নারী আন্দোলনের অধিকার সব ধর্ম, দেশ ও জাতির জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়; নারীবাদীরা আবার নিজেদের মাঝেই বিভিন্ন বিষয়ে বিভক্ত। ঋবসরহরংস নারী পুরুষের মাঝে ভেদের সৃষ্টি করে, যা নজরুলের নারী চিন্তার উল্টো, আর এটি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পুরুষবিরোধী একটি বীজ বপন করে। কিন্তু নজরুলের নারী ভাবনা বিশিষ্টভাবে অনন্য। নারীবাদী শব্দটি পুরুষের সঙ্গে নারীর দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। হতে পারে নারীর বঞ্চনার প্রেক্ষিতে ঋবসরহরংস-এর আগমন কিন্তু এটি নারী আর পুরুষকে মুখোমুখি দাঁড় করায়। কিন্তু খুব নিঃসঙ্কোচে নজরুল নারীকে তার প্রাপ্য স্থান দেন- ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ তিনজন নারী নজরুলের জীবনে শ্রেষ্ঠ নারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। নার্গিস, প্রমীলা এবং ফজিলাতুন্নেসা। যদিও নার্গিসকে কবি বিয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরে কাবিনে নজরুলের ঘরজামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘরজামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হওয়ার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে প্রমীলা মায়ের আশ্রয়ে চলে যান এবং কালক্রমে নজরুল-প্রমীলার মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়। নার্গিসকে কবি বিয়ে করেননি কিন্তু কবির সাহিত্যে নার্গিসের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ১৯২৪ সালে নজরুলের সঙ্গে প্রমীলা দেবীর বিয়ে হয়। নারী যে কেবলমাত্র নজরুল সাহিত্যে প্রিয়তমা হিসেবে ধরা দিয়েছে তাই নয়, এসেছে মাতা, বোন, কন্যা এমন নানা চরিত্রে। নারীদের নজরুল কত সুউচ্চ আসন দিয়েছিলের ‘বারাঙ্গনা’ কবিতাটি তার উদাহরণ। নারীকে অসতী বানানো সমাজের একটা রীতি। তিনি এই বিশেষ কবিতাটিতে বলেন কামনা ছাড়া এই বিশ্বে কোন মানবেরই জন্ম হয়নি- দেড় শত কোটি সন্তান এই বিশ্বের অধিবাসী কয়জন পিতা-মাতা ইহাদের হয়ে নিষ্কাম ব্রতী পুত্রকন্যা কামনা করিল কয়জন সৎ-সতী? মানুষ সে হতে পারে পথভ্রষ্ট কিন্তু তাদের মাঝে ভেদাভেদ নজরুল করেন না। অসৎ মায়ের সন্তানকে আমরা জারজ বলি কিন্তু অসৎ বাবার ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চুপ। কবি পুরুষ-কেন্দ্রী সমাজ যা নারীকে অপবাদ দিয়ে নিজেকে নিষ্কলুষ রাখে তারও তীব্র বিরোধিতা করেন ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায়- অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়, অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়! এটা নজরুলের অনেক বড় মানবতাবাদ তিনি একজন বারাঙ্গনাকে মা বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন না যা বিশ্বসাহিত্যে নজিরবিহীন। অসতীর ছেলেকেও নিজের ভাই হিসেবে পরিচয় দিতে তার ভেতর কোন লজ্জাবোধ নেই- ‘কে তোমারে বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু গায়ে? না-ই হ’লে সতী, তবু তো তোমরা ভগীনির জাতি; তোমাদের ছেলে আমাদেরই মতো, তারা আমাদের জ্ঞাতি;’ নজরুল সাহিত্যে ঘটেছে নানা ধর্মের, বর্ণের নারীদের আগমন; মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, মমতাজ, মুসলিম নারীযোদ্ধা চাঁদ সুলতানা, শিরি-ফরহাদ কাহিনীর শিরি, ইরানি বালিকা, পল্লী বালিকা, দারুচিনি দ্বীপের নারী, পারুল, বারাঙ্গনা, বেদেনী থেকে কৃষ্ণের আরাধ্য রাধা পর্যন্ত; কিন্তু ফেমিনিজমের তত্ত্ব এতকিছু একসঙ্গে ধারণে ব্যর্থ। নজরুল সকল ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণীর নারীদের সন্নিবেশ ঘটান তার সাহিত্যে এবং তাদের অনন্য মহিমা ধ্বনিত করেন। এক্ষেত্রে লালনের কথা মনে পড়ে যায় যিনিও একজন বড়মাপের মানবপ্রেমী ছিলেন এবং জাত-পাত, শ্রেণী বৈষ্যমের বিরুদ্ধে তার গান অনন্য নজির হয়ে আছে। মানুষ যে ভিন্ন ভিন্ন জাতের হয়েও এক লালন তা তার গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন- ‘ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি একি জলেই সব হয় গো সুচি দেখে শুনে না হয় রুচি যমে তো কাউকে ছাড়বে না’ তার এলাকায় যখন গৌড়িয় বৈষ্ণবদের গোঁড়ামি প্রকট হয়ে ওঠে উঁচু-নীচ দুই শ্রেণীর বিভেদ যখন চরমে তথাকথিত কুলীনদের আত্মভরিতায় লালন গান মানবতার অমিয় গান। মা কে তিনিও নজরুলের মতো সম্মানিত করেন- ‘মায়েরে ভজিলে হয় সে বাপের ঠিকানা। নিগম বিচারে সত্য গেল তাই জানা।’ সর্বহারাদের জীবন অঙ্কনে নজরুল মার্কসবাদী চেতনা প্রকাশ করেন নজরুল গ্যেটের মতো মানবমুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন শুধু তাই নয় তিনি যোদ্ধা হয়ে সেই সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। গরিব, দুঃখী, সম্বলহীন যোদ্ধা জীবন নজরুলের গল্প ও উপন্যাসে মূল উপজিব্য। তাই নারী চরিত্ররা পুরুষের আড়ালে কিছুটা হলেও ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু দ্রোহের কবি হলেও নারীর কোমলতা তাকে আর্দ্র করে রাখে। দারুণ বিদ্রোহের মাঝেও তিনি তার সাহিত্যকর্মে নারীকে বেছে নিয়েছিলেন শুধু তার স্নিগ্ধ কোমল অন্তঃপ্রাণের জন্য নয় বরং নারীর নমনীয়তাকেই তিনি শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাই তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও গানে নারীরা এসেছে অবাধে। তার নারী চরিত্রগুলো উদার, প্রেমময়, সংযমী, ধৈর্যশীল ও পরোপকারী। এর বড় উদাহরণ ‘মৃত্যুক্ষুধা’র মেজবৌ, গজালের মা ও হিড়িম্বা। তারা চিরায়ত বাঙালী নারীর ¯েœহ, মমতা উদারতা আর সহানুভূতিকে ধারণ করে। নারীকে নজরুল দাসী হিসেবে নয় কর্তব্যপরায়ণ মাতৃময়ীরূপে দেখেছেন। উনিশশ’ ষাটের দশকের নারী আন্দোলন তাকে প্রেরণা যুগিয়ে থাকতে পারে কিন্তু তার নারী কখনো পুরুষের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত নয় বরং পুরুষের পরম বন্ধু হিসেবেই প্রতীয়মান যে তার কোমল কিন্তু প্রেমরূপী শক্তি দিয়ে পুরুষকে ভালবাসার বন্ধনে জড়ায়। তিনি মমতাজ মহল কিংবা চাঁদ বিবিকে যেমন সুন্দর করে তুলেছেন, তেমনি সমান মর্যাদায় রাজদাসী আনারকলিকেও সমান মূল্য দান করেছেন। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে নারী অধিকার নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রচারণা যেমন বহুমুখী ও ব্যাপক নারীর সঙ্কটময় পরিস্থিতিও তেমনি ভয়াবহ। নারীর জন্য যুগে যুগে অনেক সুরক্ষাকবচ নিশ্চিত হয়েছে কিন্তু তাতে নারী বঞ্চনা কমেনি মোটেই। নারী যেমন অধিকার আদায়ের নামে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও চাকরিক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে অংশগ্রহণ করছে তেমনি তারা এক বিপদাপন্ন পুরুষ শাসিত সমাজে অরক্ষিতভাবে নিজেদের উন্মুক্ত করছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বহুমুখী নারী-স্বাধীনতা যেমন আছে নারীর প্রতি বৈষম্যও কম নেই। তাই নারীবাদেরও জন্ম সেখানেই। নারীবাদ আসলে পুরুষ নারীতে সমতা বিধান না করে নারী থেকে পুরুষকে আলাদা করে দেয়; কিন্তু নজরুল অসাধারণ নারী চেতনায় সমতায়নের ব্যাপারটি দীপ্তভাবে বলেছেন। আলোর বিপরীতে যেমন অন্ধকার, রূপের বিপরীতে অরূপ তেমনি প্রতিটি সত্তার পেছনে একটা বিপরীত সত্তা বিরাজ করে; এরা একে অপরের পরিপূরক কিন্তু সাংঘর্ষিক নয়; কিন্তু ঋবসরহরংস পুরুষ ও নারী সত্তাকে সাংঘর্ষিক করে তোলে। নজরুলের নারী চেতনায় পুরুষ ও নারী একে অপরের পরিপূরক হয়ে যায়- ‘নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’ জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে।’ সমঅধিকার প্রাপ্ত নারী বিজ্ঞান, চিকিৎসা, শিক্ষকতা ও নানা পেশা, মিডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ঠিকই কিন্তু নারী তার আত্মসম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় অনেকখানি অনিরাপদ। সিনেমা শিল্প, নাটক, ফ্যাশন শো, সুন্দরী প্রতিযোগিতা নারীকে তার মর্যাদাবোধ হারানোর হুমকিতে ফেলছে। নারী দামী গাড়ির মতো প্রদর্শনীর পণ্য হয়ে গেছে উত্তর-আধুনিক বিশ্বে। পুরুষ সৌন্দর্যের মোহজালে বন্দী করে নারীকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থে নজরুল ‘নারী’ কবিতায় এর তীব্র সমালোচনায় মুখর- ‘স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী/করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন সে অত্যাচারী?’ অন্যদিকে, নারী রবীন্দ্র রচনায় অনবদ্যভাবে উপস্থিত। তার নারী চরিত্রগুলো দৃঢ় প্রত্যয়ী, আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন ও ব্যক্তিত্ববোধে সমুজ্জ্বল। ‘হৈমন্তী’তে রবীন্দ্রনাথ পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে কষাঘাত করেছেন। হৈমন্তীর মৃত্যু দিয়ে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজের কদর্যরূপ তিনি অঙ্কিত করেছেন। তার ছোট গল্পগুলো আধুনিক, শিক্ষিত সমাজেও যে নারী কতটা অবহেলিত তার প্রমাণ রাখে। বিশেষ করে উপন্যাস ও ছোট গল্পগুলোতে নারীর অসহায় অবস্থা তিনি বিচলিতভাবে বর্ণনা করেছেন; আবার এর পাশাপাশি নারীদের মর্যাদার বিষয়টিতেও আলোকপাত করেছেন। আরেকটা বিশেষ দিক তার ছোটগল্পগুলো নারী চরিত্র-কেন্দ্রিক। এখানে রবীন্দ্রনাথের নারীদের প্রতি তার যে সমর্থন তা প্রকাশিত। বঙ্কিমের নারী চরিত্রগুলো যেমন পুরুষ চরিত্রের আড়ালে পড়ে যায় বিপরীতভাবে রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্রগুলো আপন আভায় আলোকিত। রবীন্দ্রনাথ তার ছোটগল্পগুলোতে দেখিয়েছেন পুরুষতান্ত্রিকতা কীভাবে নারীর মানসিক, সামাজিক ও বৈবাহিক অধিকারের প্রতি অন্তরায় হয়ে ওঠে। তার ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের নায়িকা মৃণাল আমাদের ডলস হাউসের নোরার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে পুরুষশাসিত সমাজ ত্যাগ করে। নোরার মতো মৃণালও প্রতিবাদ করে সংসার ছেড়ে চলে যায়। স্বামীর বিরুদ্ধে এক পাড়াগাঁয়ের মেয়ের যুদ্ধ গল্পটিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। মেয়েরা বুদ্ধিমতী হতে পারে না কিংবা পুরুষরা তাদের সেই স্থান দিতে যেতে চায় না মৃণালের চিঠি তাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়: ‘মা আমার এই বুদ্ধিটার জন্য বিষম উদ্বিগ্ন ছিলেন, মেয়ে মানুষের পক্ষে এ এক বালাই।’ বিষমবেদনায় মৃণাল লেখে ‘আমার ঘর শুধু তো আমার ঘর নয়।’ এভাবেই পুরুষের কাছে নারীকে সামাজিক বন্দী এক জীব হয়ে থাকতে হয়। নারীর প্রতি পুরুষের অবহেলা রবীন্দ্রনাথের অনেক গল্পেই খুঁজে পাওয়া যায়; যেমন ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে গ্রাম্য বালিকা রতনের কুসুম কোমল অনুরাগগুলো বিদীর্ণ করে রতনের অতি-বাস্তব শহুরে মনোজগত। ‘বোষ্টমী’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ দ্বিধাবিভক্ত প্রেমে অসফল আনন্দীর প্রেমের বর্ণনা করেন। জন ওয়েবস্টারের ‘ডাচিস অব মালফি’র সঙ্গে আনন্দীর অমিল ডাচিস তার প্রণয়ের মূল্য আদায় করতে জানে কিন্তু আনন্দী তার দ্বিধাবিভক্ত প্রেম নিয়ে স্বামী ও প্রেম দুটোই ছাড়তে বাধ্য হয়। সমাজ তাকে সেই সাহস দেয় না যাতে সে স্বামী ত্যাগ করে তার প্রেম গুরুঠাকুরকে গ্রহণ করবে কারণ তাতে যে সে দ্বি-চারিণী হয়ে যাবে। ‘নষ্টনীড়’ গল্পে স্বামীর চারুলতার প্রতি উপেক্ষা চারুলতার মানসিক স্থিতিকে ভারসাম্যহীন করে তোলে। ভূপতির অবহেলা চারুলতাকে ঘরে থেকেও ঘরহীন করে দেয়। সমাজের প্রতিটি স্বামীর তার স্ত্রীর প্রতি অবহেলার প্রতীক হয়ে যায় চারুলতা। ভূপতির বক্তব্যই তার প্রমাণ ‘যুবতী স্ত্রীর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া কোন আত্মীয়া তাহাকে ভর্ৎসনা করিলে ভূপতি একবার সচেতন হইয়া কহিল, ‘তাই তো, চারুর একজন সঙ্গিনী থাকা উচিত, ও বেচারার কিছুই করিবার নাই’। অমলের সঙ্গে চারুলতার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে কিন্তু পরিশেষে অমলের নির্মোহ আচরণ চারুলতার জন্য দ্বিগুণ কষ্ট বয়ে নিয়ে আসে। এভাবে জৈবিক ও মানসিকভাবে পরিত্যাজ্য চারুলতাদের সব ইচ্ছা আকাক্সক্ষাকে পরিত্যাগ করতে হয়। ‘শাস্তি’ গল্পে নারীদের চরম অস্তিত্বহীনতার স্বাক্ষর বহন করে ‘বউ গেলে বউ পাইব, আমার ভাই ফাঁসি গেলে আর তো ভাই পাইব না’ উক্তিটি। কাদম্বিনী গল্পে কাদম্বিনীর মৃত্যু নারীবিরোধী প্রতিকুল ও নির্মম বাস্তব সমাজচিত্র তুলে ধরে। কাদম্বিনীর মৃত্যুও সমাজের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদ হয়ে আসে। কিন্তু ‘মানসী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নারীর চিরায়ত ভঙ্গুর অবস্থাটাই বর্ণনা করেন। নারী যে পুরুষের আপন ইচ্ছার অধীন রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কবিতা-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কবি নারীকে এখানে অর্ধ-মানুষ করে দেখান। নারী হয়ে যায় পুরুষের কল্পনার উপকরণ- ‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী! পুুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি’ ‘মানসী’ কবিতা শেষ হয় নারী সত্তাকে দ্বি-খ-িত করে- ‘পড়েছে তোমার ’পরে প্রদীপ্ত বাসনা অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।’ জসীমউদ্দিনের ‘কবর’ কবিতা বিপদাপন্ন নারীর এক করুণ গাথা। ‘হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে; বা ‘শ্বশুর তাহার কষাই চামার’ এর বর্ণনা নারীদের নিরাশ্রয়তার ভয়াবহতা প্রমাণ করে। জীবনানন্দের কবিতায় ‘পাখির নীড়ের মত চোখ’ আর ‘তোমার হৃদয় আজ ঘাস’ নারীকে প্রকৃতি বানিয়ে ফেলে; জীবনানন্দের অতৃপ্ত চেতনায় নারী কেবল ছায়াই হয়ে থাকে। শেক্সপিয়রের বুদ্ধিমতী নারীরা সবাই ছেলেদের পোশাক পরে; কারণ ছেলে বা পুরুষ না হলে জ্ঞানী হওয়া যায় না। ব্যাকরণও নারী-পুরুষ বিভেদ তৈরি করে কারণ পুরুষ শব্দ দিয়েই নারীদের লিঙ্গান্তরিত করা হয়। এমন অনেক শব্দ আছে যার নারী বাচক কোন পুরুষ লিঙ্গান্তর নেই। ইংরেজীতে সধহশরহফ, যঁসধহ, ‘যঁসধহ নবরহম’ শব্দগুলোতে পুরুষের প্রতি নিঃসন্দেহে পক্ষপাতটা থাকে বেশি যদিও এগুলো দিয়ে নারী পুরুষ দুটোই বুঝায়। তাই আজকাল সধহশরহফ-এর বদলে যঁসধহশরহফ ব্যবহার করা হয়। নারী আড়ালে থেকে তার অশেষ প্রেরণায় পুরুষকে করেছে বিশ্ব-বিজয়ী ; যদিও সেখানে নারীর কোন স্বীকৃতি নেই। পুরুষের প্রতিটি বিজয়ের পথে নারীর অবদানের কথা চমৎকারভাবে শুধু নজরুলই স্বীকার করতে পারেন- ‘কোনকালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।’ নারী পুরুষের মতো শক্তি দিয়ে নয় তার মানসিক কঠিন জমানো মুক্তার মতো ধৈর্য দিয়ে নিভৃতচারী থেকে চিরকাল পুরুষকে শক্তি যুগিয়ে নিজে থেকেছে নিরালায়। তাজমহলের অনুপম প্রাসাদ শাহজাহানের কথা ইতিহাসে লিখে রাখলেও এর পেছনে যে নারী তার প্রাণকে জাগিয়ে তুলেছিল তা বিস্মৃত। কিন্তু নজরুল মমতাজকেই প্রাধান্য দেন তাজমহল সৃষ্টির জন্য- ‘তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছে তার প্রাণ, অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরেতে শাজাহান।’ বেগম রোকেয়া বাংলাদেশে নারী মুক্তির সবচেয়ে অগ্রগণ্য নাম। তার ‘অবরোধ-বাসিনী’ ও ‘নারীর অধিকার’ প্রবন্ধে আমাদের সমাজে নারীর অসহায়ত্বের কথা বলে গেছেন। তিনি তার অসামান্য লেখনীর মাধ্যমে নারীর বঞ্চনা মুক্তিতে ছিলেন জীবনের শেষ ক্ষণটি পর্যন্ত অকান্ত। নারীর অধিকার রক্ষায় তাই তিনি আজও পথিকৃত হয়ে আছেন। সুফিয়া কামালও নারী-অধিকার রক্ষায় অন্যতম প্রধান এক নাম; তিনি শুধু তার লেখায় নয় রোকেয়ার মতো সমাজ-কর্মের মাধ্যমেও নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দূর করতে প্রত্যয়ী ছিলেন। এই দুই মহীয়সী নারী বাংলাদেশে নারীর অধিকার আদায় ও বঞ্চনা রোধে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। নজরুলও লিপিবদ্ধ করে গেছেন নারীর আত্মত্যাগের বঞ্চনা- ‘কোন রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে, কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।’ নজরুল ছিলেন একজন সাম্যবাদী ; সবার সমান অধিকারে বিশ্বাসী, তাই তিনি খুব আধুনিক চিন্তাবিদদের মতো বুঝতে পেরেছিলের সমাজের মাঝে সমতা আনতে নারীকে কখনোই পুরুষের চেয়ে নীচ করা যাবে না; নারীর সমান সুযোগ একটা সুসম সমাজ গড়ে তুলতে পারে। নজরুল সেকালে বসে বলে গিয়েছিলেন অনাগত ভবিষ্যতের যুক্তিপূর্ণ চিন্তা- ‘সেদিন সুদূর নয়- যেদিন ধরণী পুরুষের সঙ্গে গাহিবে নারীরও জয়!’ নজরুল সমাজের সম্যক উন্নয়ন চেয়েছেন। আর নারী অবরুদ্ধ থাকলে সমাজের পূর্ণাঙ্গ অগ্রযাত্রা অসম্ভব। তিনি জানতেন নারী নানা শৃঙ্খলে আবদ্ধ; কিন্তু তিনি এও জানতেন নারীর মাঝে আছে অমিত সম্ভাবনা। তাই নারী জাতিকে অবরুদ্ধ রেখে পুরো জাতি এগোতে পারে না। নারীর সুপ্ত শক্তিকে জাগাতে তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় বিখ্যাত শব্দমালা ‘ধু ধু জ্বলে ওঠে ধুমায়িত অগ্নি,/জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নি!।’ তিনি অমিত শক্তির নারীকে ঘুম ভাঙ্গাতে আহ্বান করেন ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা’। বাংলা সাহিত্যে নারীকে এতবেশি যুগোপযোগী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেননি আর কেউ। তাই নজরুলের পুরুষ ও নারী সমতায়নের সচেতন প্রয়াস তাকে আধুনিক এক নারীবাদী নয় মানববাদীরূপে প্রতিষ্ঠা করে সর্বযুগে। তেমনিভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘অপরিচিতা’ গল্পের নায়ক অনুপম কল্যাণীর প্রতি আকৃষ্ট হয় তার ভেতর আধুনিকতার এবং পরিবর্তনের দীপশিখা দেখে। কল্যাণী নামটি রবীন্দ্রনাথ যেন ইঙ্গিতরূপে ব্যবহার করেছিলেন। তার কল্যাণী নারী বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে কল্যাণের পথে নিয়ে যাবে অকল্যাণকে এই ছিল যেন তার অশেষ চাওয়া।
×