ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আফসানা মিমি

নামের বানান ভুল হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

নামের বানান ভুল হয়নি

ক’দিন ধরেই ফরীদি ভাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন মাথার ভিতর। ১৩ ফেব্রুয়ারি তার চলে যাবার দিন- মৃত্যুদিন। জন্মদিন ২৯ মে। হুমায়ুন ফরীদি নামটা লিখছি ভয়ে ভয়ে। য় এর সঙ্গে ঊ? নাকি উ? দ এর পর ই? নাকি ঈ? হয়ত বেজে উঠবে ফোন! নামের বানান ভুল করার জন্য বকুনি খাব। ফরীদি ভাইয়ের নামের বানান এবং নাটকের টাইটেলে তার নামের অবস্থান নিয়ে কি যে তটস্থ থাকতে হতো! শুধু কি তাই, কলটাইম আর প্যাকআপের সময় নিয়েও কম অস্থিরতা ছিল না আমাদের নির্মাতাদের। তবু কি এক জাদু দিয়ে বশ করে রাখতেন তিনি সবাইকে। স-বা-ই-কে... অভিনয়ের জাদু ক’জন জানেন তার মত? এদেশে কি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির মূল্যায়ন হয়েছে? অথবা তার অভিনয়ের মূল্যায়ন? তাকে কখনও মনে হতো আল পাচিনো। কখনও ড্যানিয়েল ডে লুইস। কখনও মার্লন ব্র্যান্ডো। সবসময় মনে হয়েছে খুব কম নাটক, সিনেমা বা পরিচালক পেয়েছিলেন তিনি যারা তার অভিনয় প্রতিভার যথাযথ ব্যবহার করতে পেরেছেন। বিশ্বমাপের অভিনেতা ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। মানুষটা কি বড্ড বেশি নিঃশব্দে চলে গেলেন? সময়ের আগে তো গেলেনই। উফ্ কি তীব্রভাবে লোকটা নিজেকে মৃত্যুর কাছে নিয়ে গেল... ২০১১ সালে উদযাপিত হয়েছিল তার ৬০ বছরের জন্মদিন। আয়োজন করেছিলেন তারই সতীর্থ বন্ধুরা। কেন জানি মনে হয় অসাধারণ অনুভূতিসম্পন্ন মানুষটা সেদিনই জানতেন আর কোন অনুষ্ঠান উদযাপনের সুযোগ কাউকে দেবেন না তিনি। ৮০’র দশকের শুরুর দিকে, যখন আমরা কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের দিকে ধাবমান। টেলিভিশনের পর্দায় তাকে দেখি। একজন অভিনেতাকে দেখি, যিনি কখনও ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’র জোতদার সেরাজ তালুকদার। কখনও ‘সংশপ্তক’-এর শয়তান কানকাটা রমজান। কখনও চূড়ান্ত রোমান্টিক নায়ক অলি। ৮৪ সালে নির্মিত-প্রচারিত ও রাধা ও কৃষ্ণের অলির প্রেমে তখন সব মেয়েই/দর্শকই পড়েছিল। সেই সময় আমরা কলেজের প্রথম বর্ষে। ভীষণই এলোমেলো ছেলে অলি ইউনিভার্সিটির বাসের জানালায় বসে থাকা মেয়েটিকে রোজ বলতো, ‘উই মাস্ট লাভ ওয়ান এ্যানাদার, অর ডাই’। কি নির্মল সেই আহ্বান! অলির নায়িকার নাম ছিল ‘মিমি’। নাটক প্রচার হবার ক’দিন পরের গল্প। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনের ঘাসের চত্বরে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম হুমায়ুন ফরীদিকে! একে তো পর্দার মানুষকে কাছ থেকে দেখা, তাও আবার হুমায়ুন ফরীদি! কি নির্বিকার ভঙ্গিতে লোকটা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ঘাসের উপর... খাতা কলম এগিয়ে দিলাম, অটোগ্রাফ... খাতায় লিখতে লিখতে বললেন, ‘নাম?’ জীবনে নিজের নাম বলতে গিয়ে এত বিব্রত হইনি কোনদিন। নিশ্চিত বুঝলাম তিনি মনে করবেন মিমি আমার আসল নাম নয়, অলি-মিমি’র ‘মিমি’ হওয়ার জন্য বানিয়ে বলছি। লজ্জায় লাল হতে হতে কোনমতে নাম বললাম। মনে হলো ধরণী দ্বিধা হও... সেই ফরীদি ভাইকে পরে কত কাছ থেকে দেখেছি, তার স্নেহধন্য হয়েছি। একসঙ্গে কাজ করেছি কখনও সহশিল্পী হয়ে, কখনও পরিচালক হয়ে। কত সময়, কত গল্প, কত আড্ডা যাপন হয়েছে। কত বকুনি খেয়েছি, কত বকুনি দিয়েছি। আমাদের পুরো প্রজন্ম বা আমাদের পরে যারা অভিনয় ও পরিচালনায় এসেছেন, আমরা যারা তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছি, তার সঙ্গে কাজ করেছি, তাকে নিয়ে কাজ করেছি, সকলেই আশ্রয় হারিয়েছি ফরীদি ভাই চলে যাওয়ায়। টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির সতেজ বাতাস দিন দিন বিষময় হয়ে উঠছে, ফরীদি ভাই থাকলে আমাদের কথা শোনার মানুষটা থাকত। সাহস দেয়ার মানুষটা থাকত। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি; নাটক শুরুর টাইটেলে আমরা লিখেছিলাম- ‘এত আলোর কথা বলে অন্ধকারে কে যায়?’ হুমায়ুন ফরীদিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি। নামের বানান ভুল হয়নি।
×