ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বরাদ্দের দীর্ঘদিনেও রাজউকের প্লট বুঝে পাননি ভুক্তভোগীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৮ জানুয়ারি ২০১৬

বরাদ্দের দীর্ঘদিনেও রাজউকের প্লট বুঝে পাননি ভুক্তভোগীরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গত ২৮ বছর আগে ৯ এপ্রিল ১৯৮৭ সালে বাড্ডা এলাকায় শহর বাড়াতে আমাদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার। কথা ছিল পরবর্তীতে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বাড্ডা এলাকায় ২ কাঠা ৮ ছটাকের একটি প্লট বুঝিয়ে দেবে। এই প্লট পেতে রাজউকের কাছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ঘুরতে ঘুরতে শ্বশুর মারা গেছেন ১৯৯৬ সালে। এরপর শাশুড়িও এ প্লটের দাবি নিয়ে রাজউকে ঘুরে ঘুরে কয়েক বছর আগে তিনিও মারা গেছেন ২০০০ সালে। আজও মেলেনি রাজউকের প্রতিশ্রুত সেই কাক্সিক্ষত প্লট। আর কতকাল অপেক্ষা করলে পাব সেই প্লট? নাকি জমির মালিকের উত্তরাধিকারীরাও এ থেকে বঞ্চিত হবেন? এই কি রাজউকের সেবা? বুধবার সকালে রাজধানীর জেনারেল ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক গণশুনানি অনুষ্ঠানে শ্বশুরের পক্ষ থেকে শহীদুল্লাহ নামের এক ভুক্তভোগী এসব কথা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উদ্যোগে রাজউকে হয়রানির শিকার ও ভুক্তভোগীসহ নানা বিষয়ে সেবাবঞ্চিতদের অভিযোগ নিয়ে আয়োজিত গণশুনানিতে এমন অনেক অভিযোগ তোলেন ভুক্তভোগীরা। গণশুনানিতে মূল মঞ্চের বাঁদিকে বসেন ভুক্তভোগী জনগণ। ডানপাশে ছিলেন রাজউক কর্মকর্তারা। মাঝে বসে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আখতার হোসেন ভুঁইয়া। দুদক সূত্র জানায়, গণশুনানিতে মোট ৭৫ ভুক্তভোগী অংশগ্রহণ করেন। শুনানিতে আসা অভিযোগকারীদের কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেছে, আজ নাগরিক আদালতের কাঠগড়ায় অভিযুক্ত রাজউক। এ জন্য তারা দুর্নীতি দমন কমিশনকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানান। তবে শুনানিতে রাজউকের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কেউ কোন অর্থনৈতিক লেনদেনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রদান করতে দেখা যায়নি। শুনানিকালে দর্শক সারিতে উপস্থিত ছিলেন দুদক কমিশনার ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ, দুদক সচিব আবু মোঃ মোস্তফা কামাল, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান জিএম জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া, দুদক মহাপরিচালক জিয়াউদ্দীন আহমেদ, মহাপরিচালক ড. মোঃ শামসুল আরেফিন, ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক নাসিম আনোয়ার, রাজউক ও কমিশনের উর্র্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। শুনানিতে রাজউকের পক্ষ থেকে অফিসে যোগাযোগের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যার সমাধানসহ একদিন থেকে শুরু করে তিন মাসের মধ্যেই প্রায় সব সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয়। গ্রাহকদের এসব অভিযোগের সকল প্রশ্নের উত্তর দেন সংশ্লিষ্ট রাজউকের সকল সদস্য, পরিচালক, উপরিচালক, সহকারী পরিচালকসহ অথরাইজড অফিসারগণ। বাড্ডার বাসিন্দা শহীদুল্লাহর প্রশ্নের প্রেক্ষিতে রাউজকের পক্ষে উপ-পরিচালক ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, বাড্ডা এলাকায় ঢাকা ডিসি অফিসের সঙ্গে রাজউকের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে ঢাকার ডিসি অফিসের কিছু ঝামেলা থাকার কারণে রাজউক এখনও ওই এলাকার জমি বুঝে পায়নি। অপেক্ষা করুন। শীঘ্রই প্লট বুঝিয়ে দেয়া হবে। এর উত্তরে মোঃ শহিদুল্লাহ বলেন, ২৮ বছর পার হয়ে গেছে, আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবেÑ এ সময়ে গণশুনানির সঞ্চালক রাজউক কর্তৃপক্ষের জানতে চান। রাজউকের পক্ষ থেকে আগামী এক বছরের মধ্যে প্লট বুঝিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। সম্প্রসারিত উত্তরা আবাসিক এলাকায় প্লট বরাদ্দ নিয়ে ভুক্তভোগী সাবেক সরকারী কর্মকর্তা আবদুর রশিদ খান অভিযোগ করে বলেন, ‘উত্তরায় রাজউকের তৃতীয় প্রকল্পে ১৭ এইচ প্লট বরাদ্দ পাই। কিন্তু প্রায় ২০ বছর ঘুরেও প্লট আজও বুঝে পাইনি। সরকার থেকে পেনশনের যে টাকা পেয়েছি তা প্লটের পেছনে শেষ করেছি। রাজউকের প্রতিটি ফ্লোরে ঘুরেও কোন সমাধান পাইনি। রাজউকের প্রতি টেবিলে টেবিলে টাকা ঢালতে হয়। রাজউকে একটি নথি দেখতে ২০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগে। আবদুর রশিদের এমন বক্তব্যে সঞ্চালক রাজউকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে তার প্লটের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে মাস দু’য়েকের মধ্যে সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয়। নিজের জমিতে প্ল্যান পাস করে অন্য একজন ভবন নির্মাণ করে দখল করেছেন এমন অভিযোগ তুলেছেন মিরপুর এলাকার বাসিন্দা গাজী আবু তাহের। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক বছর ধরে বিদেশে আছি। দু-এক বছর পর পর দেশে আসি। মিরপুরে আমাদের নিজের জমিতে টিনের ঘর তুলে ভাড়া দেই। ২০১২ সালে দেশে এসে দেখি, আমার জমিতে ওই এলাকার প্রভাবশালী বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার খোরশেদ আলমসহ বেশ কয়েকজনে মিলে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করে ফেলেছেন। রাজউক কিভাবে নকশা অনুমোদন দিল? এ কোন্ দেশে বাস করছি?’ রাজউকের অথরাইজড অফিসার আশরাফুল ইসলাম ওই অভিযোগের উত্তরে বলেন, ‘বিষয়টি রাজউককে অবহিত করার পর আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। সমস্যা সমাধানে ধৈর্য ধরতে হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, রাজধানীতে পরিত্যক্ত জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফ্ল্যাট দেবে রাজউক। তিনি বলেন, রাজউকের আওতাধীন যেসব পরিত্যক্ত সম্পত্তি রয়েছে, যেমন- স্বাধীনতার পরে যেসব পাকিস্তানী এ দেশ ছেড়ে চলে গেছে, তাদের পরিত্যক্ত জায়গাগুলোয় বহুতল ভবন নির্মাণ করে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। পরিত্যক্ত জায়গায় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করলে দুর্নীতিবাজরা জায়গাগুলো দখল করতে পারবে না। এর আগে সকাল ১০টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেলুন ওড়ানোর পর গণশুনানি কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন দুদক চেয়ারম্যান মোঃ বদিউজ্জামান। এরপর শান্তির পায়রা উড়ান গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর গণশুনানির কার্যক্রম শুরু হয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দুদক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য সরকারী বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাতিষ্ঠানিক টিম ছিল। দীর্ঘদিন ধরে ওইসব সেক্টরে কাজ করতে গিয়ে কেউ কেউ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এ কারণে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম বিলুপ্ত করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের ধারণা রয়েছে, রাজউকে সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়। এটা অনেকটাই সত্যি। তিনি বলেন, ‘রাজউক, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি দূর করতে প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে দুদক। কিন্তু দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি দূর করার পরিবর্তে টিমগুলো দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। তাই আমরা টিমগুলো বিলুপ্ত করি। প্রাতিষ্ঠানিক টিমগুলো বিলুপ্ত করার পর গণশুনানি করার সিদ্ধান্ত নেই। মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করতে ও মানুষ যাতে সেবা পেতে পারে সে জন্যই গণশুনানি করছে দুদক।
×