ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

নিহতদের একজন স্কুল শিক্ষিকা ॥ দগ্ধ ৩, ঢাকা মেডিক্যালে প্রেরণ

গাজীপুরে বয়লার বিস্ফোরণ ॥ আগুনে অঙ্গার ৫

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

গাজীপুরে বয়লার বিস্ফোরণ ॥ আগুনে অঙ্গার ৫

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু, গাজীপুর থেকে ॥ গাজীপুরে টায়ার পুড়িয়ে তেল সংগ্রহের একটি কারখানায় বয়লারের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে সৃষ্ট আগুনে দগ্ধ হয়ে পথচারী এক স্কুল শিক্ষিকাসহ ৫ নিহত এবং তিনজন দগ্ধ হয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় দগ্ধ তিনজনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। নিহতদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলো, স্থানীয় বারইবাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা পথচারী সিদ্দিকা জেবুন্নেসা (৪০), বসুগাঁও গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে ও কারখানার সিকিউরিটি গার্ড মোঃ সেলিম মোল্লা (৪৫) এবং মাদারীপুর জেলার বাঘরিয়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে কাওসার হোসেন (৪০)। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও এলাকাবাসী জানায়, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের পুবাইলের কলেজ গেটের অতুলের টেক এলাকার স্মার্ট মেটাল এ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারখানায় শনিবার বিকেল চারটার দিকে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। কারখানাটিতে কমপক্ষে ৩০/৩৫ জন শ্রমিক কাজ করত। এ কারখানায় গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার পুড়িয়ে কেমিক্যাল (সড়কের কাজে বিটুমিনের সঙ্গে ব্যবহারের জন্য) এবং তার সংগ্রহ করা হয়। আসর নামাজের আজানের পর বিকেল চারটার দিকে বিকট শব্দে কারখানার দু’টি বয়লার পর পর বিস্ফোরণ হয়। প্রায় একই সঙ্গে তেল ভর্তি করে ওই কারখানায় রাখা একটি ট্যাঙ্ক লরিতে আগুন ধরে সেটিও বিস্ফোরিত হয়। প্রচ- বিস্ফোরণে বয়লারগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৪/৫শ’ ফুট দূরে ছিটকে পড়ে। এ সময় স্টিলের স্ট্রাকচারের ওই কারখানা ভবনটিও ধসে পড়ে এবং ছিন্নভিন্ন হয়ে দূরে ছিটকে পড়ে। প্রচ- বিস্ফোরণে ও বাতাসের গতিবেগের কারণে আগুন ওই কারখানা ভবনের চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া ধ্বংস স্তূপে ছড়িয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আগুনে সড়কের পাশের গাছপালাগুলোসহ কারখানায় পার্কিং করে রাখা অপর একটি ট্যাঙ্ক লরি পুড়ে গেছে। আগুন লাগার সময় কয়েকজন শ্রমিক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। ঘটনার সময় কারখানার পার্শ্ববর্তী জয়দেবপুর-পুবাইল সড়কে দিয়ে ঢাকার মতিঝিল এলাকার বাসায় যাবার সময় অটোরিক্সা আরোহী স্কুল শিক্ষিকা অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এবং স্থানীয় ভাদুন এলাকার সিরাজ ফরাজীর ছেলে রিক্সা চালক স্বাধীন (৩০) আহত হয় ও অটো রিক্সাটি পুড়ে যায়। বিস্ফোরণের পরপর এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে গিয়ে কারখানার অগ্নিদগ্ধ সুপারভাইজার বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ এলাকার মৃত ফয়েজ উদ্দিনের ছেলে আব্দুল কাদের (৫৫) ও একই কারখানার সুপারভাইজার নরসিংদী জেলার ঘোড়াশাল থানার চরসিন্দুর থানার ইউনুছ আলীর ছেলে কামাল হোসেনকে (৪৯) গাজীপুরের শহীদ তাজ উদ্দীন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং রিক্সাচালক স্বাধীনকে টঙ্গী হাসপাতালে পাঠায়। এ সময় স্থানীয়রা দ্রুত ছুটে এসে উদ্ধারকাজে যোগ দিলেও আগুনের উত্তাপের কারণে তারা কারখানার কাছে ভিড়তে পারেননি। খবর পেয়ে জয়দেবপুর, টঙ্গী ও কালীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় কারখানা এলাকায় হতে দু’টি এবং ঘটনাস্থল হতে প্রায় দু’শ’ ফুট দূরে জয়দেবপুর-পুবাইল সড়কের উপর হতে তিনটি অঙ্গার লাশ উদ্ধার করে। ধারণা করা হচ্ছে বিস্ফোরণের ভয়াবহতার কারণে আগুনে পুড়ে কারখানার চার কর্মীর দেহ কারখানা থেকে ছিটকে প্রায় দু’শ’ ফুট দূরে গিয়ে পড়ে। লাশগুলো আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়ায় সেগুলোর পরিচয় জানা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তবে ওই কারখানাটির আশপাশে জন বসতি না থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম হয়েছে। এ দিকে রাত হয়ে যাওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সার্চ লাইট জ্বালিয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। রাত পৌনে ১০টায় এরিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলছিল। ঘটনাস্থলের অল্প দূরে নির্মাণাধীন একটি ভবনে শ্রমিকের কাজ করছিলেন মহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, বিস্ফোরণের শব্দ ও বাতাসের গতিবেগের ভয়াবহতার কারণে নির্মাণাধীন ওই ভবনের জানালার অধিকাংশ কাচ ভেঙ্গে গেছে। ঘটনার পরপর অন্যদের সঙ্গে তিনিও ঘটনাস্থল থেকে প্রায় তিনশ’ ফুট দূরে ছিটকে পড়া ওই কারখানার দুই সুপারভাইজারকে অগ্নিদ্বগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। স্থানীয় যুবক এনামুল হাসান, ব্যবসায়ী বাবুল পাঠানসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, কারখানার ধ্বংস স্তূপের নিচে আরও লাশ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ ওই কারখানায় ৩০/৩৫ জন শ্রমিক কাজ করত। দুর্ঘটনার পর তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে হতভাগ্য শ্রমিকরা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বয়লার বিস্ফোরণের শব্দ ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূর থেকে শোনা গেছে। এ ব্যাপারে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের স্থানীয় ৪১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বজলুর রহমান বাছির জানান, হাজী ইমান উদ্দিনের মালিকাধীন ওই কারখানাটি স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় অবৈধভাবে স্থাপিত হয়েছে। এর কার্যক্রম বন্ধের জন্য ইতোপূর্বে একাধিকবার কারখানা কর্তৃপক্ষকে নোটিস দেয়া হলে কারখানা কর্তৃপক্ষ তোয়াক্কা না করে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। শহীদ তাজ উদ্দীন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, অগ্নিদগ্ধদের শরীরের শতকরা ৯০ ভাগ পুড়ে গেছে। তাদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। স্বাধীনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন টঙ্গী হাসপাতালের আরএমও ডাঃ পারভেজ হোসেন। গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আক্তারুজ্জামান লিটন জানান, ঘটনার সময় স্কুল শিক্ষিকা সিদ্দিকা জেবুন্নেসা অটোরিক্সাযোগে কারখানার পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণের সময় তার রিক্সাটিতে হঠাৎ আগুন ধরে যায়। এতে তিনি দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ঘটনায় নিহত ৫ জনের অঙ্গার লাশ রাত ১০টা পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত মৃতদেহগুলো এতটাই পুড়ে গিয়ে বিকৃত হয়ে গেছে যে তাদের চিহ্নিত করাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ধ্বংস স্তূপের নিচে আরও লাশ থাকতে পারে বলে এলাকাবাসী ধারণা করছে। তবে এখনো উদ্ধার কাজ চলছে। তদন্ত কমিটি গঠন- এদিকে, হতাহতের খবর পেয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলম শহীদ তাজ উদ্দীন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায়। শহীদ তাজ উদ্দীন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ রাহেনুল ইসলামকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়ে। তিনি আরও জানান, নিহতদের দাফনের জন্য তার প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার অনুদান ঘোষণা করেন।
×