ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ থেকে অভিযান

রাজধানীর দখল হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধারে নামছেন মন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১২ জানুয়ারি ২০১৬

রাজধানীর দখল হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধারে নামছেন মন্ত্রী

ফিরোজ মান্না ॥ এবার স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালযের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন নিজেই রাজধানীর দখল হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধারে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি তিন দিনের মধ্যে দখল হয়ে যাওয়া সব খাল উদ্ধারের জন্য নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট সব দফতরকে। আজ মঙ্গলবার থেকে মিরপুরের পীরেরবাগ, আমতলা মোড় এবং উত্তর মনিপুরের খাল উদ্ধারের জন্য আভিযান চালানো হবে। একই সঙ্গে মিরপুর থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ভবন পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তার উভয় পাশে ফুটপাথের উপর নির্মিত অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ করা হবে। সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীতে ওয়াসার ২৬ খালের মধ্যে অর্ধেকেরও কম খালের অস্তিত্ব আছে। বাকি খালগুলো গিলে খেয়েছে প্রভাবশালীরা। কোথাও কোথাও আবার গড়ে উঠেছে বস্তি। ঢাকা ওয়াসা অনেক বার এসব খাল উদ্ধারে ব্যবস্থা নিলেও কার্যত তারা কোন খাল উদ্ধার করতে পারেনি। কারণ ওয়াসার মধ্যেই রয়েছে দখলদারদের পক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারী। যদিও এসব খালের ওপর অবৈধ স্থাপনা অপসারণ ওয়াসার নিয়মিত কাজ। কিন্তু এই কাজ এখন বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। অবৈধ স্থাপনা অপসারণের কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিনের মধ্যে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসছে। বেদখল অবৈধ স্থাপনার পিছনে রয়েছে ওয়াসার এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাত। তাদের সহযোগিতায় খালের ওপর ফের স্থাপন হয় অবৈধ স্থাপনা। সরকারী অর্থ খরচ করে সাময়িক সময়ের জন্য খালকে মুক্তি দেয়া হয় মাত্র। বাকি সময় খালকে ঢাকা থাকতে হয় অবৈধ স্থাপনার নিচে অথবা চলে যেতে হয় প্রভাবশালীদের দখলে। ওয়াসার ভেতর থেকে খালের মুক্তি না মিললে একদিন কোন রকমে অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখা খালগুলো বিলীন হবে। সোমবার কয়েকজন মন্ত্রী রাজধানীর খালগুলো পরিদর্শন করে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, নিজেদের প্রয়োজনেই খালগুলো সচল রাখতে হবে। ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, উদ্ধার করার পর আবার তা দখলে রামপুরা, রূপনগর ও কল্যাণপুর খালের ওপরে স্থাপিত অবৈধ স্থাপনা অপসারণের পর আবার ওই সব খালের ওপর অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এই তিন খাল থেকেই ওয়াসা এক শ্রেণীর কর্মকর্তা কর্মচারীসহ প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর কোটি টাকার বণিজ্য হয়েছে। ওয়াসার খাল উদ্ধার নামের কাজ শেষ হওয়ার পরই ধীরে ধীরে এই বাণিজ্য চলতে থাকে। টাকার বিনিময়ে অবৈধ স্থাপনাসহ খালের জায়গাও ছেড়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে উদ্ধার অভিযানে বেশি খরচ দেখিয়ে লুটে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এ বছর খাল উদ্ধারের জন্য ওয়াসার বরাদ্দ রয়েছে ৬ কোটি টাকা। খাল উদ্ধারে থাকেন ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগের কর্মকর্তারা। উদ্ধার অভিযানের সময় তারা বলেন, খালের জায়গা ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। বরং অভিযানে দখল হয়ে যাওয়া খালের ৩০ ফুট পর্যন্ত পাড়ও উদ্ধার করা হবে। অনেকের বাড়ির দেয়াল ও ভবনের অংশ পর্যন্ত ভেঙ্গে দেয়া হয়। টাকার বিনিময়ে কাউকে এক ফুট জায়গাও দেয়া হয়নি। গত সোমবার ওয়াসার তত্ত্বাবধানে রাজধানীর বিভিন্ন খাল সংস্কারের পর এসবের কয়েকটি খাল পরিদর্শন করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ভূমি মন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা। তারা রামচন্দ্রপুর খাল ও কল্যাণপুর খাল পরিদর্শন করেন। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান মন্ত্রীদের বলেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেন। এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আব্দুল মালেক ও রাজউক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীনও পরিদর্শনকালে উপস্থিত ছিলেন। খাল পরিদর্শন শেষে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর খালগুলো থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং পানি প্রবাহ সচল রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। তিনি সংস্কারকৃত খালগুলোতে বর্জ্য না ফেলার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানান। নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এমপি তাঁর বক্তব্যে বলেন, রাজধানীর খালগুলো পুনরুদ্ধার এবং সংস্কারের ক্ষেত্রে ঢাকা ওয়াসা অবিশ্বাস্য ও সাহসী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসব খাল পানি চলাচলের উপযোগী রাখতে মন্ত্রী জনসচেতনতার উপর গুরুত্ব দেন। তিনি জনগণের সহযোগিতার আহ্বান জানান। জানা গেছে, রাজধানীর রূপনগর খালের ৩ কিলোমিটার এলাকায় কয়েক শ’ অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। খালের জায়গা দখল করে তারা বহুতল ভবন নির্মাণ করে আছে। উদ্ধার অভিযান চালানোর আগে অবৈধ দখলদারদের সঙ্গে ওয়াসার কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী তাদের খবর পৌঁছে দেয়। খবর পেয়ে অনেক দখলদার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যাদের সঙ্গে বনিবনা হয়ে যায় ওই এলাকায় অভিযানের দলকে নেয়া হয় না। রূপনগর খালের দুই পারে এ ধরনের শতাধিক বাড়ি রয়েছে-যারা খালের জায়গা দখল করে বহাল তবিয়তে রয়েছে। যে সব দখলদারের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে তাদের জায়গায় ওয়সার ম্যাজিস্ট্রেটকে নেয়া হয় না। কৌশলে অন্য জায়গায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। এভাবে চলছে ওয়সার খাল উদ্ধার বাণিজ্য। এদিকে, মোহাম্মদপুর কাটাসুর খালের দখল হয়ে যাওয়া অংশ উদ্ধার করার সময়ও একই কাজ করা হয়েছে। খালগুলো উদ্ধার করে পানি প্রবাহের উপযোগী করার জন্য ঢাকা ওয়াসা এই কার্যক্রম পরিচালনা করলেও একটি খালেও পানি প্রবাহ হচ্ছে না। এক দিকে বিরাট অঙ্কের টাকা ব্যয় করে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যায় ওয়াসা-অন্যদিকে উদ্ধারকৃত জায়গা আবার কয়েক দিনের মধ্যে বেদলে চলে যায়। খাল উদ্ধার করে ওয়াসা স্থায়ীভাবে সীমানা না দেয়ায় এমন কাজ চলছেই। কোন খালই ওয়াসা উদ্ধার করে ধরে রাখতে পারছে না। প্রতি বছর অভিযানের নামে শুধু ওয়াসার টাকাই খরচ হচ্ছে। আর কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে।
×