ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

এবারের ৫ জানুয়ারির নতুন দৃশ্যপট রাজনীতির অঙ্গনে ছড়িয়েছে সুবাতাসের আবহ

দুই দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে জনমনে স্বস্তি

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৭ জানুয়ারি ২০১৬

দুই দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে জনমনে স্বস্তি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রবাদে আছে- ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়’। ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে পাল্টাপাল্টি সমাবেশকে ঘিরে জনমনে গত বছরের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর বিভীষিকার চিত্র নতুন করে ফিরে এসেছিল। দিনটিকে ঘিরে রাজনীতিতে যে উত্তাপ-উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল, শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়েছে। গত বছর দুই দল ‘কঠোর ও উগ্র’ অবস্থানে থাকলেও এবার তা নেই। বরং ৫ জানুয়ারিতে কঠোর অবস্থানের বদলে উভয় দল থেকেই শান্তি-সমঝোতার আহ্বান জনমনে নিঃসন্দেহে স্বস্তি এনে দিয়েছে। অবসান হয়েছে রাজনৈতিক উত্তেজনার। তবে সদ্য বিদায়ী বছরে দাবানল জ্বললেও নতুন বছরের শুরুতে বিএনপির এমন ইতিবাচক ‘ইউটার্ন’ সত্যিই কী দেশের রাজনীতিতে স্বস্তির সুবাতাস বইবে, নাকি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই তাদের এমন অবস্থান- এ নিয়ে রাজনীতির মাঠে শুরু হয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ। জনমনে সৃষ্ট এই স্বস্তি ঠিক কতদিন থাকবে- সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা। ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ালেও শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচী। উভয় দলের সমাবেশ থেকে একে অপরকে তীব্র সমালোচনা করলেও কোন সহিংসতা ছিল না। গত বছরের মতো বিএনপি তরফে দেয়া হয়নি কোন প্রাণঘাতী কর্মসূচী। ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ ও বিএনপির ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’-এর সমাবেশ ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা ছিল। সে অনুযায়ী দেশব্যাপী নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলবার দুই দলের সমাবেশেই শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। রাজধানীতে যানবাহন কম ছিল, তবে সহিংসতার আতঙ্ক না থাকায় যাতায়াতের কষ্ট মেনে নিয়েছে নগরবাসী। সবমিলিয়ে স্বস্তিতেই কাটল ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি। এ উপলক্ষে কোথাও কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কঠোর অবস্থানের কারণে এর আগে বহু মূল্য দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। বিনা বাধার সমাবেশে অবরোধ-হরতালের মতো প্রাণঘাতীর কর্মসূচীর বদলে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সমঝোতার প্রস্তাব, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে দেশকে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এতে দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের আভাস পাচ্ছেন বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে’ দু’দলের নেতারাই সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশবাসী আগামীতেও প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করেন। গত বছর নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে টানা প্রায় তিন মাস নাশকতা, সহিংসতা ও বীভৎস কায়দায় মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই এবারও জনমনে এই ভয় ছিল। তবে সেই পরিস্থিতি কেটে গিয়ে একে অপরকে সুষ্ঠু রাজনীতি, আলোচনা ও গণতন্ত্রের পথে থাকার আহ্বান জানানোটা গত দুই বছরের অনড় অবস্থার তুলনায় কিছুটা অগ্রগতি বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। দুই দলের সমাবেশেই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের কমতি ছিল না। নেতারা তাঁদের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই বিষোদগার করেছেন পরস্পরের প্রতি। কিন্তু দুই দলের প্রধান বক্তাদের কথায় সহনশীলতার সুর খুঁজে পাওয়া যায়। এটিকে রাজনীতির অঙ্গনে সুবাতাস হিসেবেই গণ্য করছে বিভিন্ন স্তরের মানুষ। রাজনীতি-বিশ্লেষকরাও একে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, দুই দলের অবস্থানের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে ঘুমোটভাব কাটিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তিকর পথে ফিরে এসেছে। এসেছে গণতন্ত্রের পথে- যে পথ দেশ থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। তাঁরা মনে করছেন, দুই দলের নতুন এই অবস্থানের মধ্য দিয়ে আস্থার সঙ্কট কাটার সূচনা হলো। তবে এই সহনশীলতা যেন টিকে থাকে, সংঘাত-সংঘর্ষের পথ থেকে সরে গিয়ে সাংবিধানিক আন্দোলন ও আলোচনার পথ যেন সূচনা হয়। অনেকেই মনে করেন, বিএনপি এবারের ৫ জানুয়ারির জনসভায় দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বক্তৃতা দেশের মানুষকে নিঃসন্দেহে স্বস্তি এনে দিয়েছে। এক বছর আগেও এইদিনে একই উপলক্ষে খালেদা জিয়া যে কর্মসূচীর সূচনা করেছিলেন, তাতে রাজনীতির ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবেই লিপিবদ্ধ থাকবে। টানা তিন মাসের তথাকথিত হরতাল-অবরোধের নামে যেভাবে পেট্রোল বোমা দিয়ে দেশের মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে তা সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না। দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু আর পাঁচ শতাধিক মানুষকে আহত করার দায় বিএনপি কখনোই এড়াতে পারবে না। ইতিহাসের ছাত্ররাও অতীতে বা ভবিষ্যতে এমন আত্মঘাতী রাজনৈতিক কর্মসূচীর উদাহরণ দ্বিতীয়টি খুঁজে পাবে না। তবে ‘ন্যাড়া যে বেলতলায় যেতে চাইছে না’- সে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়েছে এবার ৫ জানুয়ারিতে। বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার হঠাৎ করেই কেন ১৮০ ডিগ্রীতে এই ‘ইউটার্ন’? এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনারও কমতি নেই রাজনীতির মাঠে। জনমনে স্বস্তি আনলেও বিএনপির এমন নমনীয় অবস্থানের পেছনে বড় কোন উদ্দেশ্য বা রাজনৈতিক কৌশল রয়েছে কি না, এ নিয়ে জনমনে সৃষ্ট আশঙ্কা শতভাগ উবে যায়নি। অনেকের মতে, গত বছর ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে বিএনপি-জামায়াত জোট যে ভয়াল তা-ব চালিয়েছে, এতে করে দেশের জনগণ এই জোটকে ভালভাবে নেয়নি। সাংগঠনিকভাবেও ভঙ্গুর দশা দলটির। সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবিতে দলটির নেতাকর্মীদের হতাশার মাত্রাকেই আরও তীব্রতর করেছে। এ অবস্থায় আবার সংঘাত-সাংঘর্ষিক রাজনীতির পথে গেলে দলকেই টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হবে, এমন বাস্তবতা থেকেই বিএনপি আপাতত শান্তিপূর্ণ রাজনীতির পথে হাঁটতে চাইছে। এছাড়া বছরের শেষ সময়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্যে রেখে খালেদা জিয়া জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা থেকে সবার দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নিতেই খালেদা জিয়া এমন নমনীয় অবস্থান নিতে পারেন বলেও অনেকে মনে করেন। বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকও গণমাধ্যমে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা আশার আলো দেখছেন। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দুই বছর পূর্তির দিনে কোন সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবেই সভা-সমাবেশ করেছে। দুই দলের এ নমনীয় আচরণ সত্যিই প্রশংসনীয়। এর মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। দল দুটির এ নমনীয় আচরণ রাজনীতির জন্যও ইতিবাচক। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, শত্রু ভেবে উভয় দল একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার যে মিশনে নেমেছিল সেখান থেকে তারা সরে আসবে। বিএনপির ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমেদও গণমাধ্যমে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় স্বীকার করেছেন, গত বছর দু’দলের যে উগ্রতা ছিল এবার তা নেই। পৌর নির্বাচনকে ‘অসম্পূর্ণ’ বললেও নির্বাচনের পরে খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন জানানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবার একটা সমঝোতার ভাব আছে। দু’দলই সামনে সুন্দর ভবিষ্যত দেখতে চায়। কোন দলই জেদ করছে না। মাত্র ক’দিন আগেই নির্বাচন শেষ হলো। নির্বাচন যা-ই হোক, বিএনপি অংশ নিয়েছিল। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় আন্দোলনের দিকেই এখন তাদের মনোযোগ। গতবার ছিল মুখোমুখি, এবার না। সমাবেশে খালেদা জিয়া কঠোরতার পথ থেকে সরে এসে সরকারের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে বলেছেন, আসুন সংলাপ করে তার মধ্য দিয়ে একটা সমাধান বের করে আনি, গণতন্ত্র আনি। যাতে দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ বের করা যায়। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই। আমরা যদি সকলে মিলে-মিশে থেকে কাজ করি, বাংলাদেশকে আমরা একটি সুন্দর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ রাজনীতি এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আসুন, আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যাই। দেশে নির্বাচন হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনে একটি জীবনও হত্যার প্রয়োজন পড়বে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, খালেদা জিয়া ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দু’জনের বক্তব্যেই ইতিবাচক। তাঁরাও কেউ রাজনীতির মাঠকে গরম করতে উস্কানি বক্তব্য দেননি। এছাড়া দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় পর খালেদা জিয়া মঙ্গলবার এত বড় সমাবেশে বক্তৃতা দিলেন। তিনি এবারও বলেননি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করা হোক কিংবা সরকার অবৈধ। তিনি সরকারের পদত্যাগও দাবি করেননি। তাই খালেদা জিয়ার এবারের বক্তৃতা বিশেষভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এছাড়া এক সপ্তাহ পার হয়নি দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় ভরাডুবি হয়েছে। জনমনে ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল- ৫ জানুয়ারির সমাবেশ থেকে নরম-গরম কর্মসূচী দিতে পারেন খালেদা জিয়া। কিন্তু তা না করে খালেদা জিয়ার নমনীয় ও সমঝোতার আহ্বান সবকিছু হিসাব-নিকাশই পাল্টে দেয়। তবে বিএনপির এটা সত্যিই গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসার প্রচেষ্টা, নাকি রাজনৈতিক কৌশল- এটা সময়েই দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট হবে বলেই মনে করেন তাঁরা।
×