ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আরাফাত মুন্না

আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিলো জনকণ্ঠের মামলাটিও

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ১ জানুয়ারি ২০১৬

আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিলো জনকণ্ঠের মামলাটিও

২০১৫ সালের ২৯ জুলাই সাকা চৌধুরীর আপীলের চূড়ান্ত রায় বহাল রেখে রায় ঘোষণার পর হঠাৎই আদালত অবমাননা সংক্রান্ত একটি আদেশ দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা নেতৃত্বাধীন আপীল বেঞ্চ। ওই আদেশে দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ (এম এ খান মাসুদ) ও নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়কে তলব করেন। একই সঙ্গে আদালত অবমাননার অভিযোগে কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, এই মর্মে রুলও জারি করেন। সাকা চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে এক বিচারপতির সাক্ষাত নিয়ে স্বদেশ রায়ের একটি নিবন্ধকে আদালত অবমাননাকর মনে করে এই আদেশ দেন প্রধান বিচারপতি নিজেই। ৩ আগস্ট তাদের আদালতে উপস্থিত থেকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয় ওই আদেশে। এর পর আলোচনায় চলে আসে জনকণ্ঠের মামলাটি। পরে ৩ আগস্ট জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক আদালতে হাজির হয়ে যখন বলেন, ওই বিচারক আর কেউ নন, খোদ প্রধান বিচারপতি নিজেই এবং এ বিষয়ে তাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণাদিও রয়েছে, তারা এই মামলাটি লড়বেন, তারপর গোটা দেশের আলোচনার মূলেই চলে আসে এই মামলা। পরে প্রধান বিচারপতি জনকণ্ঠের অভিযোগ স্বীকারও করেন। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অবমাননার কোন মামলায় কনটেস্ট করেছে কোন সংবাদ মাধ্যম। এর আগে সবাই গিয়ে শর্ত ছাড়া ক্ষমা চেয়ে এসেছেন। জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক আদালত অবমাননার ওই মামলা মোকাবেলা করেন। যে বিষয়টি নিয়ে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল, তার স্বপক্ষে তথ্য-প্রমাণও আদালতে উপস্থাপন করেছেন তারা। তবে তার পরেও আদালতের সম্মানহানি হয় এমন কোন সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না, আদেশে এমন দাবি করে আদালত তাদের দোষী সাব্যস্ত করে। ১৩ আগস্ট দেয়া ওই রায়ে আদালতের কার্যক্রম চলাকালীন সময় পর্যন্ত এজলাসে জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদককে বসে থাকার নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে আদালত তাদের দশ হাজার টাকা জরিমানা করে, যে জরিমানার টাকা যে কোন দাতব্য সংস্থাকে দান করতে বলা হয়েছে। আদেশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে এই জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে বলা হয় রায়ে। জরিমানা অনাদায়ে জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদককে সাতদিন কারাভোগ করতে হবে এমনটাই বলা হয়েছে আদেশে। পরে জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক জরিমানার ওই টাকা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মুনতাসীর মামুন ফাতেমা ট্রাস্টে দান করেন। কেন এই আদালত অবমাননার অভিযোগ : গত বছরের ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠে ‘সাকার পরিবারের তৎপরতা/পালাবার পথ কমে গেছে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়। এখানে তিনি লিখেন, ’৭১-এর অন্যতম নৃশংস খুনী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। নিষ্পাপ বাঙালীর রক্তে যে গাদ্দারগুলো সব থেকে বেশি হোলি খেলেছিল এই সাকা তাদের একজন। এই যুদ্ধাপরাধীর আপীল বিভাগের রায় ২৯ জুলাই। পিতা মুজিব তোমার কন্যাকে এখানেও ক্রুশে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই যদি না হয়, তা হলে কিভাবে যারা বিচার করছেন সেই বিচারকদের একজনের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে সালাউদ্দিন কাদেরের পরিবারের লোকেরা? তারা কোন পথে বিচারকের কাছে ঢোকে। আইএসআই ও উলফার পথে না অন্য পথে? ভিকটিমের পরিবারের লোকদের কি কখনও কোন বিচারপতি সাক্ষাত দেন। বিচারকের এথিকসে পড়ে। ... ফখরুলের জামিনের বিষয়ে স্বদেশ রায় ওই নিবন্ধে লিখেন, ফখরুলের জামিনের ভেতর দিয়ে বিচারকরা কি বাংলাদেশকে আইএসের পথে অগ্রসর হওয়ার সুবিধা করে দিলেন না? এসব ঘটে কি ফখরুলের টাকা আছে বলে আর যারা জমির আল নিয়ে মাথা ফাটায় ওদের টাকা নেই বলে? এক বিচারপতির বিদেশ যাওয়ার প্ল্যান প্রসঙ্গে তিনি লিখেন, কেন শেখ হাসিনার সরকারকে কোন কোন বিচারপতির এ মুহূর্তের বিশেষ সফর ঠেকাতে ব্যস্ত হতে হয়। সে সফরের উদ্যোক্তা জামায়াত-বিএনপির অর্গানাইজেশন। কেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী আগে গিয়ে সেখানে অবস্থান নেন। কি ঘটেছে সেখানে। ক্যামেরনই পরোক্ষভাবে বলছেন, সকল সন্ত্রাসীর একটি অভয়ারণ্য হয়েছে লন্ডনে। এসব বিষয় আমলে নিয়ে গত ২৯ জুলাই সাকা চৌধুরীর আপীলেও মৃত্যুদ- বহাল রাখার রায়ের পরপরই জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদককে তলব করে আদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে রুলও জারি করেন আপীল বিভাগ। জনকণ্ঠের পক্ষে কনটেস্ট : আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী গত বছরের ৩ আগস্ট জনকণ্ঠের সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ (এম এ খান মাসুদ) এবং নিবন্ধের লেখক নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় আদালতে উপস্থিত হন এবং এ মামলায় তারা কনটেস্ট করবেন জানিয়ে তিন মাসের সময় চান। পরে আদালত এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের জবাব দাখিল করতে নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে গত ৯ ও ১০ আগস্ট শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানির কার্যক্রম : ৯ আগস্ট শুনানির শুরুতেই জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে বেঞ্চ পুনর্গঠনের আবেদন জানানো হয়। জনকণ্ঠের আইনজীবী সালাহউদ্দিন দোলন আদালতে বলেন, যেহেতু অভিযোগ শুধু প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে, তাই ওনি না থেকে বেঞ্চ পুনর্গঠন করার জন্য আবেদন করছি। শুনানি শেষে জনকণ্ঠের এই আবেদনটি খারিজ করে দেন আপীল বিভাগ। এরপর জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদকের পক্ষে দাখিল করা জবাব আদালতে তুলে ধরা শুরু করেন। এরপর আদালত বিরতিতে চলে যায়। বিরতির পর আদালত জানান, যেহেতু এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা তাই এ মামলার শুনানি হবে বৃহত্তর বেঞ্চে। এরপর ১০ আগস্ট বৃহত্তর বেঞ্চে জনকণ্ঠের জবাবের ওপর শুনানি হয়। শুনানির একপর্যায়ে জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদকের পক্ষে দাখিল করা জবাব উপস্থাপন করেন আইনজীবী সালাহউদ্দিন দোলন। তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অন্য এক বিচারপতির কথোপকথনের বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করেন এবং এ সংক্রান্ত সিডিও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ওই কথোপকথনে বলা হয়েছে প্রধান বিচারপতিকে সাকা চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল একজন বিচারপতিকে বেঞ্চে না রাখতে। পরে ওই কথোপকথনের বিষয়টি স্বীকার করেন প্রধান বিচারপতি। এরপর শুনানি শেষে আদালত আদেশের জন্য দিন ঠিক করেন। এছাড়া প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিদেশ সফর সংক্রান্ত বিষয়েও সাক্ষী হাজিরের জন্য জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়। তবে আদালত ওই আবেদনটিও গ্রহণ করেননি। এছাড়া মির্জা ফখরুলের জামিনের বিষয়ে জনকণ্ঠের আইনজীবী সালাহউদ্দিন দোলন বলেন, ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে ‘ফখরুলের টাকা আছে বলেই কি তিনি জামিন পেয়েছেন?’। এখানে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, যাদের বেশি টাকা আছে তারা উচ্চ আদালতে এসে বেশি টাকা খরচ করে ভাল আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন। আর যাদের টাকা নেই তারা ভাল আইনজীবীও নিয়োগ করতে পারেন না। এই দুই দিনই শুনানিতে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্রƒপমূলক বক্তব্য দেন। ১০ আগস্ট শুনানির একপর্যায়ে এ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন এমপি, এ্যাডভোকেট কেএম সাইফুদ্দিন এবং সাবেক অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান জনকণ্ঠের আইনজীবী সালাহউদ্দিন দোলনের ওপর উত্তেজিত হয়ে যান। তারা বিভিন্ন বিদ্রƒপমূলক মন্তব্য করতে থাকেন। পরে জনকণ্ঠের আইনজীবী বিষয়টি আদালতের নজরে আনলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। দুই দিনের শুনানি শেষে ১০ আগস্ট আদেশের জন্য দিন ঠিক করেন আপীল বিভাগ। এর পর ১০ আগস্ট জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদককে দোষী সাবস্ত্য করে রায় দেন সুপ্রীমকোর্ট। জনকণ্ঠের আইনজীবী যা বললেন : জনকণ্ঠের পক্ষের আইনজীবী সালাহউদ্দিন দোলন আদেশের পর সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আদালতকে বলেছিলাম, সত্য লেখায় আদালত অবমাননা হয়নি। তারপরও যেহেতু আদালত রায় দিয়েছেন, সেহেতু রায় মানতেই হবে। আমরা এ রায় মেনে নিয়েছি। পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে জনকণ্ঠের সম্পাদক-নির্বাহী সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তীতে কি কি আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যায়, এ আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ হবে কি হবে না সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আইনজীবী সালাহউদ্দিন দোলন আরও বলেন, শুনানির একপর্যায়ে আদালতে প্রধান বিচারপতি স্বীকার করেছিলেন, ওই কথোপকথনের একপ্রান্তে তিনি ছিলেন। যার অন্যপ্রান্তে আরেকজন বিচারপতি ছিলেন। ওই কথোপকথন স্বীকার করে নেয়ায় আমার আশা ছিল, গত দু’দিন ধরে বলেছিলাম সত্যের ভিত্তিতে রিপোর্ট করা হয়েছে, সেহেতু আমার মক্কেলগণ আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবেন। আদালত অবমাননায় সাব্যস্ত হবেন না। যেহেতু আদালত সেটা গ্রহণ করেনি, সেহেতু কিছুটা হতাশ তো হয়েছি।
×