ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

অনুপ চেটিয়া হস্তান্তর

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১২ নভেম্বর ২০১৫

অনুপ চেটিয়া হস্তান্তর

গাফফার খান চৌধুরী/মশিউর রহমান খান ॥ অবশেষে বহুল আলোচিত ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসম (উলফা)-এর সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া ওরফে গোলাপ বড়ুয়াকে তার দুই সহযোগীসহ ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বন্দীবিনিময় চুক্তির আওতায় তাদের হস্তান্তর করা হয়। দীর্ঘদিন ধরেই অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তরের জল্পনা-কল্পনা চলছিল। অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে হস্তান্তর করা হলো অনুপ চেটিয়া ও তার দুই সহযোগীকে। তবে তিনজনকে হস্তান্তরের প্রেক্ষিতে ভারত থেকে বাংলাদেশের মোস্ট ওয়ান্টেড কাদের ফেরত আনা হচ্ছে বা ভারত সরকার কাদের হস্তান্তর করছে- সে বিষয়ে কোন দেশের তরফ থেকেই কিছুই জানানো হয়নি। ভারতের এই বড়মাপের বিচ্ছিন্নতাবাদীকে ফেরত দেয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফোন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি আঞ্চলিক সন্ত্রাস দমনে শেখ হাসিনার এ কাজে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ও অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। যেভাবে হস্তান্তর ॥ কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বুধবার সকালে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেল থেকে অনুপ চেটিয়া ও তার সহযোগী লক্ষ্মী প্রদীপ গোস্বামী ও বাবুল শর্মাকে ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে দুই দেশের প্রতিনিধিদের তরফ থেকে নিয়মানুযায়ী হস্তান্তরের লিখিত সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তারপরই ৩ জনকে হস্তান্তর করা হয় ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে। এরপর তারাই তাদের ভারতের উদ্দেশে নিয়ে রওনা হন। কারা মহাপরিদর্শকের আগে মিরপুরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অনুপ চেটিয়াকে তার দুই সহযোগীসহ ভারতের কাছে নিয়মানুযায়ী হস্তান্তর করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে জেলের মেয়াদ শেষ হয় তিনজনের। এরপর ২০১৩ সালের ১৩ মে অনুপ চেটিয়া কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য আবেদন করেন। কর্তৃপক্ষ আবেদন আমলে নিয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ শুরু করে। এরপরই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যোগাযোগ চলতে থাকে। সেই যোগাযোগের প্রেক্ষিতেই হস্তান্তরিত হলো অনুপ চেটিয়া ও তার দুই সহযোগী। অনুপ চেটিয়ার আগে উলফার যেসব নেতাকে পুশব্যাক করা হয়েছে ॥ উলফা চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়াকে রাজধানীর ইস্কাটনে, সামরিক শাখার উপপ্রধান রাজু বড়ুয়া মোহাম্মদপুরে, পররাষ্ট্র সচিব শশধর চৌধুরী উত্তরায়, অর্থ সচিব চিত্রবন হাজারিকা ময়মনসিংহে অবস্থান করছিলেন বলে জানা যায়। ২০১০ সালে এই কয়েকজন শীর্ষ উলফা নেতা ছাড়াও সংগঠনটির সংস্কৃতি সচিব প্রণতি ডেকা ও পরেশ বড়ুয়ার পরিবারের সদস্যসহ অন্তত ২৮ জনকে ভারত সীমান্ত দিয়ে পুশব্যাক করা হয়। তাদের অসম পুলিশের অতিথিশালায় ওই সময় রাখা হয়েছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। যদিও বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনকিছুই জানানো হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দীবিনিময় চুক্তি না থাকায় এদের পুশব্যাক করতে হয়েছিল বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দীবিনিময় চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তির পর প্রথমবারের মতো অনুপ চেটিয়াকে তার দুই সহযোগীসহ আনুষ্ঠানিকভাবেই হস্তান্তর করা হলো। যদিও নিরাপত্তার কারণে দুই দেশের তরফ থেকেই বিষয়টি সর্ম্পকে আগাম কোনকিছুই জানানো হয়নি। যেসব কারণে অনুপ চেটিয়া আলোচিত ॥ অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে আটক থাকা সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিদেশী বন্দী। ভারত সরকার উলফার সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালাচ্ছে। সেখানে দীর্ঘদিন ধরেই অনুপ চেটিয়া অনুপস্থিত। তাকে ছাড়া শান্তি আলোচনা পূর্ণাঙ্গ হচ্ছে না বলে আলোচনায় অংশ নেয়া উলফা চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়াসহ অন্য শীর্ষ উলফা নেতারা দাবি করে আসছেন। আলোচনার জন্য অনুপ চেটিয়াকে নানা কারণেই প্রয়োজন বলেও দাবি করেন শান্তি আলোচনায় অংশ নেয়া উলফার শীর্ষ নেতারা। উলফার জন্ম ॥ ভারতের অসম রাজ্যকে একটি স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক দেশ করার লক্ষ্যে সংগঠিত হয় সে রাজ্যেরই কতিপয় বিপ্লবী বলে ঘোষণা দেয়া হয়। বাস্তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পরাজয়ের পর পাকিস্তান ও আমেরিকা ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নাগা ও মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের পাশাপাশি অসমের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের জন্ম দেয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমানের সহায়তায় আইএসআই ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে উলফা গঠন করে। নেপথ্য কারিগর হিসেবে রয়েছেন উলফার চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া, প্রদীপ ওরফে সমীরণ ও সামরিক বিভাগের প্রধান পরেশ বড়ুয়া এবং সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া ওরফে গোলাপ বড়ুয়া। ভারতে উলফার বিরুদ্ধে সেদেশের সেনাবাহিনীর অভিযান ॥ এরপর থেকে আইএসআই’র সহযোগিতা শুরু তাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র যোগান। ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত উলফার বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালে ভারতের সেনাবাহিনী অসমে ‘অপারেশন বজরং’ নামে একটি অভিযান চালায়। সেই অপারেশনে উলফার বেশ কিছু নেতাকর্মী অস্ত্র-গোলাবারুদসহ গ্রেফতার হয়। ওই সময় ভারত সরকার উলফাকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করে সংগঠনটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নিষিদ্ধ হওয়ার পর ভারত সরকার ধারাবাহিকভাবে উলফা সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রাখে। অনুপ চেটিয়া প্রথমবারের মতো ১৯৯১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চালানো অভিযানে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ওই সময় ভারত সরকারের সাধারণ ক্ষমায় তিনি মুক্তি পান। তিনি মুক্তি পেলেও উলফার অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত ছিল। এমন অভিযানের মুখে সংগঠনের অনেক শীর্ষনেতা আত্মগোপনে চলে যেতে থাকেন। ওই সময় অনেকেই পালিয়ে বাংলাদেশে ছদ্মবেশে আত্মগোপন করেন। তাদেরই একজন অনুপ চেটিয়া। তিনি পুরো পরিবারসহ বাংলাদেশে আত্মগোপন করেন। ঢাকায় অনুপ চেটিয়ার আত্মগোপন ॥ রাজধানীর তৎকালীন মোহাম্মদপুর বর্তমানে আদাবর থানাধীন এলাকার একটি বাড়িতে মাসিক ৬ হাজার টাকা ভাড়ায় ২ বছর থাকার চুক্তিতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। ভাড়া নেয়ার সময় তিনি বাড়ির মালিকের কাছে ভুয়া নাম ঠিকানা দেন। আদাবরে বসবাসকালে তিনি নিজেকে বিভিন্ন সময় জন ডেভিড, আহম্মেদ, ডার্ক উইলিয়াম ও আব্দুল আজিজ নামে পরিচয় দিতেন। দীর্ঘদিন এভাবেই প্রকৃত নাম পরিচয় গোপন রেখে আত্মগোপনে ছিলেন। ঢাকায় অনুপ চেটিয়া ও তার দুই সহযোগী গ্রেফতার ॥ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভ করে। ক্ষমতা লাভের পর দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের গ্রেফতারে ঝটিকা অভিযান চালানোর নির্দেশ দেয় সরকার। বিশেষ করে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসী, দাগী অপরাধী ও বিদেশী নাগরিকদের গ্রেফতারে কড়া নির্দেশনা জারি করা হয়। এমন নির্দেশনার পর রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এমন দেশী-বিদেশী অপরাধীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলতে থাকে। এমনই এক অভিযানে ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর তৎকালীন মোহাম্মদপুর থানাধীন বর্তমানে আদাবর থানা এলাকার ঢাকা হাউজিংয়ের ২০ নম্বর ৬ তলা বাড়ির পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার হয় অনুপ চেটিয়া ও তার দুই সহযোগী উলফা নেতা লক্ষ্মী প্রদীপ গোস্বামী ও বাবুল শর্মা। তাদের কাছ থেকে বিদেশী মুদ্রা, অবৈধভাবে বাংলাদেশ প্রবেশের নানা আলামত উদ্ধার হয়। জব্দ করা হয় পাসপোর্টসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র। গ্রেফতারের পর সরকারের নির্দেশে তাদের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়। তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ চলে। কে এই অনুপ চেটিয়া ॥ জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসতে থাকে জন ডেভিড, আহম্মেদ, ডার্ক উইলিয়াম ও আব্দুল আজিজ পরিচয়দানকারী অনুপ চেটিয়ার আসল পরিচয়। জানা যায়, অনেক অজানা তথ্য। অনুপ চেটিয়ার পিতার নাম শিবেন্দ্র নাথ বড়ুয়া। স্ত্রীর নাম প্রমিলা ওরফে মাধুরী। জš§ ১৯৬৭ সালে ভারতের অসম রাজ্যের টিনসুকিয়া জেলার জেরাই গ্রামে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অনুপ চেটিয়ার সাগর ইসলাম ওরফে জিওমিন নামে ২৫Ñ২৬ বছর বয়সী এক পুত্র এবং বানিয়া আক্তার ওরফে বুলি ওরফে বুলু নামে ২০Ñ২১ বছর বয়সী এক এক কন্যা রয়েছে। দুই সন্তানকে দেখভাল করার দায়িত্ব নেয় যুবক ভাস্কর দাস। যিনি প্রায় ১৩ বছর আগে অসম থেকে ঢাকায় আসেন। ভাস্কর দাসকে গৃহকর্মী হিসেবে অনুপ চেটিয়ার বাসায় পাঠান উলফা নেতা মিথিঙ্গা দিয়ামারী। ভাস্কর দাস মিথিঙ্গা দিয়ামারীর ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। বাংলাদেশে ভাস্কর দাসের নাম পরিবর্তন করে দেন পরেশ বড়ুয়া। তিনি তার নাম রাখেন অনিক খান রেংলী। অনুপ চেটিয়ার মেয়ে বুলি ভাস্কর দাসের সঙ্গে ঢাকার একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এদেশের নাগরিক হিসেবে পড়াশুনা করত। বুলির ব্যবহƒত ল্যাপটপটি উলফার বিভিন্ন কাজে ব্যবহƒত হচ্ছিল। অনুপ চেটিয়া গ্রেফতারের পর বাংলাদেশে উলফার কার্যক্রম চালানোর জন্য অফিস খোলা হয়েছিল। বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা বাণিজ্যসহ দলীয় কার্যক্রম ছিল। পরবর্তীতে সরকারের তৎপরতায় সব গুটিয়ে যায়। ঢাকায় মামলা দায়ের ও সাজা ॥ অনুপ চেটিয়া দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মজিবুল হক বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ, পাসপোর্ট আইন, বিদেশী মুদ্রা রাখা ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে পৃথক ৪টি মামলা দায়ের করেন। মামলায় অনুপ চেটিয়ার ১৮ বছরের জেল হয়। বিচারিক কার্যক্রম শেষে ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি আদালত তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায়। এখান থেকে ২০০৩ সালের ১৭ জুন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে তার সাজার মেয়াদ শেষ হয়। এরপর কাশিমপুর কারাগার থেকে ২০০৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহী, সেখান থেকে ২০০৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ জেলা কারাগারে স্থানান্তর করা হয় তাকে। ২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলা কারাগার থেকে তাকে পাঠানো হয় রাজশাহী জেলা কারাগারে। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ২৮ জুন তাকে রাজশাহী জেলা কারাগার থেকে গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেলে রাখা হয়। সেখানে তাকে আরপি সেল (মুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ বন্দী) সেলে রাখা হয়। উলফা সর্ম্পকে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ ॥ ২০১০ সালের ১৭ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার ভৈরব থানাধীন লক্ষ্মীপুর এলাকা থেকে বাংলাদেশী নাগরিক প্রদীপ মারাক (৫৭) ও উলফা নেতা ভারতীয় নাগরিক রঞ্জন চৌধুরী ওরফে মেজর রঞ্জন (৪৭) র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃত রঞ্জন র‌্যাবকে জানায়, তার বাড়ি ভারতের অসম রাজ্যের ধুবড়ী জেলার গৌরীপুর থানাধীন সাংগুমধু শোলমারী গ্রামে। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে ছদ্মবেশে বাংলাদেশের শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী থানাধীন গজনী এলাকায় বসবাস করছিলেন। ছদ্মবেশে অবস্থানকালে তিনি নিজেকে রঞ্জন সিসিম ওরফে রঞ্জন চৌধুরী ওরফে মেজর রঞ্জন ওরফে প্রদীপ রায় ওরফে দ্বীপ জ্যোতি ওরফে রঞ্জু বাড়ৈ ওরফে মাসুদ চৌধুরী নামে পরিচয় দিতেন। ১৯৯৫ সালের জুনে তিনি উলফার শীর্ষ নেতা পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে ভুটানে সাক্ষাত করেন। পরেশ বড়ুয়া তাকে বাংলাদেশে অবস্থানরত উলফার সেক্রেটারি জেনারেল অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের পরামর্শ দেন। ভুটান থেকে ১৯৯৫ সালের জুলাইতে ভারতে ফেরার পথে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। প্রায় এক বছর ভারতের গোহাট্টি জেলে ছিলেন। ১৯৯৬ সালের শেষদিকে ছাড়া পান। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ততদিনে পরেশ বড়ুয়াও বাংলাদেশে আত্মগোপন করেন। তিনি দেখা করেন পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে। পরেশ বড়ুয়া রঞ্জনকে মানিক কোর্চ নামক এক উলফা সদস্যের তত্ত্বাবধানে শেরপুরে পাঠিয়ে দেন। বাংলাদেশ থেকেই তিনি উলফার কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য বাংলাদেশ ও আসামে যাতায়াত করছিলেন। গ্রেফতার এড়িয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম সচল রাখতে তিনি ২০০১ সালে স্থানীয়দের সহযোগিতায় মনিন্দ্র হাগিদরের মেয়ে সাবিত্রী ব্রুমকে বিয়ে করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে উলফার শীর্ষ নেতা পরেশ বড়ুয়া ও শশধর চৌধুরীসহ স্থানীয় উলফা নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের পর শেরপুর সীমান্ত এলাকার কোণ গ্রামে স্ত্রীসহ বসবাস শুরু করেন। পাশাপাশি উলফার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। উলফার শীর্ষ নেতাদের অবস্থান ॥ গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফ থেকে জানা গেছে, উলফার ১৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির ১০ জনকেই বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে। অনুপ চেটিয়া ঢাকায় গ্রেফতার হন। ৩ জন ভুটানে সেনা অভিযানের সময় নিখোঁজ হয়েছেন। বাংলাদেশে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে উলফার শীর্ষ নেতা পরেশ বড়ুয়া পালিয়ে চীন-মিয়ানমার সীমান্তের কাচিন নামের গহীন জঙ্গলে আশ্রয় নেন। সেখানে তার সঙ্গে উলফার ২০ নম্বর ব্যাটালিয়নের দুই ক্যাপ্টেন অন্তু চুদাং ওরফে অন্তু সাউদাং ও পার্থ গগৈসহ বেশ কয়েকজন আত্মগোপন করেন। পরবর্তীতে অন্তু চুদাং গ্রেফতার হয়। তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর অনুপ চেটিয়ার মেয়ে বুলির ল্যাপটপ উলফার বিভিন্ন কাজে ব্যবহƒত হয়ে আসছিল। পরেশ বড়ুয়ার ছেলে অঙ্কুর খান সানলি ওরফে অরুণোদয় ডুহুটিয়া বাংলাদেশে থেকেই অসমে উলফার অনেক কার্যক্রম দেখভাল করতেন। বর্তমানে বাংলাদেশে উলফার সব ধরনের কর্মকা- পুরোপুরি থেমে গেছে। ভারত সরকারের সঙ্গে উলফার বর্তমানে শান্তি আলোচনা চলছে। অনুপ চেটিয়ার বিনিময়ে যাদের ফেরত আনার বিষয়ে আলোচনা চলছে ॥ বাংলাদেশ সরকার অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে ফেরত দিয়ে সর্বোচ্চ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের কাছে বঙ্গবন্ধুর খুনী রিসালদার মুসলেহউদ্দিনসহ দুইজন রয়েছে বলে বাংলাদেশের তরফ থেকে অনাষ্ঠানুনিকভাবে দাবি করা হচ্ছে। যদিও ভারত সরকার বরাবরই তা নাকচ করে আসছে। অনুপ চেটিয়া ও তার দুই সহযোগীকে ভারতে হস্তান্তরের পর বিনিময় হিসেবে ভারতের তিহার জেলে বন্দী ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী দুই সহোদর মুরসালিন ও মুত্তাকিন, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, সাজ্জাদ হোসেনসহ অনেককেই ফেরত আনার আলোচনার কথা শোনা যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে কোন কিছুই জানানো হয়নি।
×