স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে’, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘বসন্ত বাতাসে সইগো’সহ অসংখ্য লোকগানের রচয়িতা শাহ্ আবদুল করিম। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায় অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। বাউল গানের কিংবদন্তি এই শিল্পী ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দারিদ্র্য ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বেড়ে ওঠা এ শিল্পীর সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকে। প্রথিতযশা এই শিল্পীর ষষ্ঠ প্রয়াণবার্ষিকী ছিল শনিবার। এ উপলক্ষে এক স্মরণসভা হয় শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে রবিবার সন্ধ্যায়। ‘স্মরণ : বাউল শাহ্ আবদুল করিম’ শিরোনামে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যৌথভাবে সুবচন নাট্য সংসদ ও ভাটি বাংলা সংস্কৃতি পরিষদ। আলোচনা, গান, প্রামাণ্যচিত্র ও নাট্য প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে বরেণ্য এ শিল্পীকে স্মরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি ছিলেন সুবচন নাট্য সংসদের প্রধান উপদেষ্টা সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীরপ্রতীক), সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও ভাটি বাংলা সংস্কৃতি পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা নেসার আলম মুকুল।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বাউল শাহ্ আবদুল করিমের সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকে। উনার সঙ্গে পরিচয়ের পর একদিন আমাকে বললেন, অনেকে তাঁর গান গায় কিন্তু কেউ ক্রেডিট দেয় না। পরে উনার সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা হয়। অসম্ভব গানবাজ মানুষ ছিলেন তিনি। যে কোন অনুষ্ঠানে আমাকে দেখলেই হাত ধরে পাশে বসাতেন। বাউল করিমকে অত্যন্ত সরল ও অসংসারী উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, স্ত্রী সরলার মৃত্যুর পর তিনি আরও সরল হয়ে যান। তিনি বলতেন, তার গান সরলার। আমি অত্যন্ত গর্বিত এমন মানুষের সংস্পর্শে এসে।
আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, শাহ্ আবদুল করিমের বর্ণাঢ্য সঙ্গীত জীবনের প্রধান প্রেরণা দানকারী নারী তার স্ত্রী আফতাবুন্নেসা। তিনি তাকে আদর করে সরলা নামে ডাকতেন। তিনি বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্ ও দুদু শাহ্’র জীবন দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। দারিদ্র্যতা তাকে কৃষিকাজে শ্রম ব্যয় করতে বাধ্য করে। তথাপি গান সৃষ্টি থেকে তিনি বিরত হননি। স্বশিক্ষিত বাউল শাহ্ আবদুল করিম দেড় সহস্রাধিক গান লিখেছেন ও সুরারোপ করেছেন। তিনি আধ্যাত্মিক ও বাউল গানের দীক্ষা লাভ করেছেন কামাল উদ্দীন, সাধক রশীদ উদ্দীন ও শাহ্ ইব্রাহীম মাস্তান বক্সের কাছ থেকে। তিনি শরিয়তী, মারফতী, নবুয়ত, বেলায়াতসহ সব ধরনের বাউল গান ও গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজীতে অনূদিত হয়েছে। শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী এ বছরের প্রথমদিকে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে বাউল শাহ্ আবদুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এ সব গান শুধু ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। সম্প্রতি এ সময়ের বেশ কয়েকজন শিল্পী তার গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এ পর্যন্ত তার ৬টি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো হলোÑ আফতাব সঙ্গীত, গণসঙ্গীত, কালনীর ঢেউ, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে ও দোলমেলা। সম্প্রতি সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে তার রচনাসমগ্র অমনিবাস’র মোড়ক উন্মোচন হয়েছে। তিনি ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। দ্বিতীয় সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক এ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানে এই বাউল সম্রাটকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। তিনি ২০০০ সালে কথাসাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরী পদক পান। তিনি আজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন। সাউন্ড মেশিন নামের একটি অডিও প্রকাশনা সংস্থা ২০০৬ সালে ‘জীবন্ত কিংবদন্তি : বাউল শাহ্ আবদুল করিম’ নামে বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া তার জনপ্রিয় ১২টি গানের একটি এ্যালবাম প্রকাশ করে। এই এ্যালবামের বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য তার পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হয়। বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিম ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সিলেটের একটি ক্লিনিকে সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আলোচনা শেষে পর্দায় দেখানো হয় শাহ্ আবদুল করিমের জীবন, সঙ্গীত ও দর্শন নিয়ে তথ্যচিত্র ‘ভাটির পুরুষ’। সবশেষে সুবচন নাট্য সংসদ প্রযোজিত ‘মহাজনের নাও’ নাটকের ৮৯তম মঞ্চায়ন হয়। শাহ্ আবদুল করিমকে নিয়ে গীতল এ নাটকটি লিখেছেন শাকুর মজিদ এবং নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী।
শেষ হলো পাঁচ শিল্পীর চিত্রপ্রদর্শনী ‘রূপবন্ধু’ ॥ শিল্পচর্চার সূত্র ধরেই সৃষ্টি হয়েছে তাদের বন্ধুত্ব। চারুশিক্ষার পাঠ নিতে সবাই দীক্ষা নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। শিক্ষাজীবন শেষ হলেও আজও তাঁদের সেই বন্ধন রয়েছে। আর সেই বন্ধনের সূত্র ধরে গড়েছেন শিল্পকলাচর্চা বিষয়ক সংগঠন চারকোন। এই সংগঠনের পাঁচ শিল্পীর যৌথ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে মহাখালীর নিউ ডিওএইচএসের গ্যালারি কসমস। ‘রূপবন্ধ’ু শিরোনামের প্রদর্শনীটিতে অংশ নেয়া শিল্পীরা হলেনÑ নাজমুল আহসান, সালমা জাকিয়া বৃষ্টি, ফারজানা রিপা, আফরোজা জামিল কংকা ও সুলেখা চৌধুরী।
এ্যাক্রিলিক মাধ্যমের আশ্রয়ে নারীর রূপ ও লাবণ্যকে ক্যানভাসে উপস্থাপন করেছেন নাজমুল হাসান। বিমূর্ত আঙ্গিকে এ্যাক্রিলিক মাধ্যমে নগর জীবনের দৃশ্যকাব্য সৃজন করেছেন সালমা জাকিয়া বৃষ্টি। ফারজানা রিপার চিত্রপটে উপস্থাপিত নারীর নিরাপত্তাহীনতার চিত্র। আফরোজা জামিল কংকার ছবিতে উপস্থাপিত হয়েছে নিসর্গের নান্দনিকতা। পলাতক স্বপ্ন শিরোনামে হারিয়ে যাওয়ার শৈশবকে যেন ক্যানভাসে খুঁজে ফিরেছেন সুলেখা চৌধুরী। ৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া দশ দিনব্যাপী এ প্রদর্শনীর শেষ দিন ছিল রবিবার।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: