ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

হাজারীবাগ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২০ মে ২০১৫

হাজারীবাগ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পারিবারিক কলহ আর আর্থিক দ্বন্দ্বের জের ধরে সোমবার রাতে রাজধানীর হাজারীবাগে স্ত্রীকে গলাকেটে হত্যার পর স্ত্রীর ওড়না দিয়ে নিজেই ফাঁসিতে ঝুঁলে আত্মহত্যা করে স্বামী। চামড়া ফ্যাক্টরির এক সুদর্শন শ্রমিকের সঙ্গে প্রেম করে এক শিল্পপতির মেয়ে। এরপর পরিবারের অমতে বিয়ে হয়। বিয়ের চৌদ্দমাসের মাথায় পারিবারিক কলহ আর আর্থিক টানাপোড়েনে সিনেমার মতো স্ত্রীকে হত্যার পর আবেগ সামলাতে না পেরে নিজেও আত্মহত্যা করে স্বামী। সিনেমার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে এমন ঘটনা। এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সোমবার গভীররাতে রাজধানীর হাজারীবাগ থানাধীন গজমহল রোডের ৪৭ নম্বর তিনতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ স্বামী মোহাম্মদ রাসেল (২৫) ও তার স্ত্রী ইফাত আরার (১৯) লাশ উদ্ধার করে। এমন ঘটনার পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এলাকার সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে সিনেমার মতো ঘটনাটি। নিহত রাসেলের পিতার নাম আব্দুল বারেক। বাড়ি বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ থানাধীন পূর্ব রসুলপুর গ্রামে। তিনি পরিবারের সঙ্গে ৪৭ নম্বর গজমহলের ওই বাড়ির নিচতলায় বসবাস করছিলেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গ-ি পেরুলেও আর উচ্চ মাধ্যমিকের গ-ি পেরুনো হয়নি। রাসেলরা পাঁচ ভাই এক বোন। রাসেল চতুর্থ ছিলেন। অভাবের সংসারের হাল ধরতে রাসেল চাকরি নেন হাজারীবাগের একটি চামড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানে। মাসিক প্রায় সাতহাজার টাকা বেতনে চাকরি করছিল রাসেল। পাশেই ৩৯ নম্বর গজমহল রোডে ধনাঢ্য চামড়া ব্যবসায়ী ইফাত আরাদের নিজ বাড়ি। তার পিতা স্থানীয় প্রভাবশালী ও শিল্পপতি হিসেবে পরিচিত সিরাজুল ইসলাম ওরফে হাজী বাবুল। ইফাতরা দুই বোন এক ভাই। সুদর্শন যুবককে প্রতিদিন সেই রাস্তায় যেতে দেখত ইফাত। এসএসসি পাস করার পর ইফাতের আর পড়াশুনা হয়নি। স্বাভাবিক কারণেই অখ- অবসর ছিল ইফাতের। সুদর্শন যুবক রাসেলকে দেখতে দেখতে ভাললাগে ইফাতের। এক পর্যায়ে রাসেলেরও ভাললাগে ইফাতকে। দেখাদেখি চোখাচোখি থেকে প্রেম জমে উঠে। প্রায় চৌদ্দ মাস আগে দু’জনে পালিয়ে বিয়ে করে। স্বাভাবিক কারণেই বিষয়টি মেনে নেয়নি ইফাতের পরিবার। এরপর ইফাত স্বামীর সঙ্গে গজমহল রোডের ওই বাড়িরই তৃতীয় তলায় মাসিক চারহাজার টাকায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করে। বছর না ঘুরতেই আর্থিক সমস্যা দেখা দেয়। কারণ ইফাত ছোটবেলা থেকে যেভাবে আর্থিক সচ্ছলতার মধ্যে বড় হয়েছে, স্বামীর ঘরে তার অভাব ছিল। অভাব ঘুচাতে ইফাত স্বামীকে ব্যবসা করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু রাসেলের কাছে কোন টাকা নেই। বছরখানেক ধরে ইফাতের পিতা মেয়ের বিষয়টি মেনে না নিলেও খানিকটা নমনীয় হন। এরই প্রেক্ষিতে ইফাত তার পিতার কাছ থেকে স্বামীকে তিন লাখ টাকা এনে দেয়। দুই লাখ টাকা ব্যবসার কাজে লাগায়। আর এক লাখ টাকায় ফার্নিচারসহ আরও কিছু জিনিসপত্র কিনে। রাসেল ব্যবসায় উন্নতি করতে পারছিল না। এ নিয়ে প্রায়ই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হতে থাকে। প্রায় দুইমাস আগে ঝগড়ার একপর্যায়ে ইফাত স্বামীর সংসার করবে না বলে জানিয়ে দিয়ে পিতার বাড়িতে বসবাস শুরু করে। সেখান থেকে প্রায়ই পিতার দেয়া তিনলাখ টাকা দাবি করতে থাকে। এদিকে আচমকা সংসার না করার কথায় রাসেল তার স্ত্রী পরকীয়ায় আসক্ত বলে সন্দেহ করতে থাকে। এ নিয়ে দু’জনের মনোমানিল্য চরমে পৌঁছে। ইফাত বার বার তিনলাখ টাকা দাবি করে। রাসেল এ নিয়ে চরম বিরক্ত। ঘটনার দিন সোমবার রাতে রাসেলকে ফোন করে ইফাত টাকা দাবি করে। রাসেল স্ত্রীকে সব টাকা ফেরত দিবে বলে মোবাইল ফোনে জানায়। স্বামীর এমন কথায় বিশ্বাস করে ইফাত তার মা ও বড়বোন সিফাতকে সঙ্গে নিয়ে রাসেলের বাসায় যায়। দরজায় টোকা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসেল ইফাতকে হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দেয়। ইফাতের বোন আর মা স্বামী-স্ত্রীর বিষয় বলে আর ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করেননি। ভেতরে ঢুকার পর ব্যাপক কান্নাকাটি ও মারধরের শব্দ হতে থাকে। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সব কান্নাকাটি আর শব্দ থেমে যায়। এ সময় ইফাতকে তার মা ও বোন ডাকতে থাকেন। এ সময় সেখানে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়। রাসেলের ভাই খোকনের স্ত্রী আসমা আক্তার সাথী জানান, ভালবেসে তারা বিয়ে করেছিল। কিন্তু রাসেল গরিব হওয়ায় বিয়ের পর থেকেই ঝগড়াঝাটি লেগে থাকত। এক পর্যায়ে ইফাতের বাবা রাসেলকে টাকা দিলে চামড়া ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসায় ভাল করতে পারছিল না। তাই টাকা ফেরত চায়। আর তখন থেকেই শুরু হয় স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া। মাস দুয়েক আগে ইফাত স্বামীর সংসার না করার কথা জানিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। ইফাতের পিতা সিরাজুল ইসলাম ওরফে হাজী বাবুল জানান, তারা ভালবেসে বিয়ে করেছিল। রাসেল চামড়া শিল্পের শ্রমিক ছিল। শ্বশুর হিসেবে বিষয়টি খারাপ দেখায়, তিন লাখ টাকা দিয়ে জামাইকে ব্যবসায় নামিয়ে দেই। ব্যবসায় ভাল করতে পারছিল না। টাকা ফেরত দেবে বলে সোমবার মেয়েকে ফোন করে ডেকে নেয়। এরপরই ঘটনাটি ঘটে। পরে স্থানীয়রা সজোরে দরজা ধাক্কা দিলে ছিটকিনি খুলে দরজা ফাঁক হয়ে যায়। ভেতরে ইফাতের জবাই করা লাশ আর রাসেলকে ইফাতের ওড়না দিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। খবর পেয়ে রাতেই পুলিশ লাশ দুইটি উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। এমন ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এ ব্যাপারে হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাঈনুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। প্রেমের বিয়ের পর পারিবারিক কলহ ও আর্থিক দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। ঘটনার পেছনে আরও কোন কারণ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
×