
রাজধানীর আকাশে এখন আর নীলের আধিপত্য নেই। দিনের শুরুতেই সূর্য মুখ লুকোয় ধুলোমাখা কুয়াশার আড়ালে। অফিস টাইমে ট্রাফিকে বসে আপনি যখন বিরক্তিতে মুখ গোমড়া করেন, তখন হয়তো বুঝতেই পারেন না, সেই মুহূর্তে আপনি কী পরিমাণ বিষ গিলছেন।
ধুলা, ধোঁয়া, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, পিএম ২.৫—এমন সব শব্দ যা সাধারণ মানুষ কখনো উচ্চারণও করে না, এখন প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে।
ভোর ৭টা, যাত্রাবাড়ী বাস টার্মিনালের পাশে এক চায়ের দোকান। ধোঁয়ার কুয়াশায় মোড়া শহরটা ভালো করে চোখে পড়ে না। দোকানি মালেক চাচা হাতে ধরা চায়ের কাপে ফুঁ দিতে দিতে বলেন, “এই ধোঁয়ার মধ্যে আর নিশ্বাস নেওয়া যায় না বাবা। বুক ভার হয়ে যায়।”
শহরটার নাম ঢাকা—এক সময় ‘মসজিদের দালানের শহর’, সুরের শহর বলে পরিচিত ছিল। এখন সেটা পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটি হিসেবে। প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার অবস্থান থাকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, ঢাকার বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকণার (PM2.5) মাত্রা অনেক আগেই সহনশীল সীমা অতিক্রম করেছে।
কিন্তু এই বিষাক্ত বাতাসের উৎসগুলো কী?
লালবাগের বিষের ভাঁড়ার
লালবাগের ভিতরে ঢুকলেই গায়ে লাগে ধোঁয়ার কষা গন্ধ। ছোট ছোট গলিতে ছড়ানো আছে অসংখ্য অবৈধ কারখানা—লোহার গলানো, রঙ তৈরি, টায়ার পোড়ানো। দিন-রাত চুল্লি জ্বলছে। এখানেই শাহজাহান কাজ করেন এক ওয়ার্কশপে। “কয়লার দাম বেশি, তাই পুরনো টায়ারই জ্বালাই,” বললেন তিনি।
এই পোড়া টায়ার থেকে বের হয় মারাত্মক রাসায়নিক, যেগুলো শুধু বাতাস নয়, শরীরেও ঢুকে পড়ে নিঃশব্দে।বর্জ্য পোড়ানো সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ, কিন্তু বাস্তবে যেন চোখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। নেই নজরদারি, নেই জবাবদিহিতা।
যানবাহন: সরষের মধ্যে ভূত
বংশাল, দুপুর ১২টা। সিএনজি, বাস, প্রাইভেট কার— সব থেমে আছে, তবে ইঞ্জিন বন্ধ নয়। কালো ধোঁয়ার ঢেউ ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসে।ঢাকার অনেক গণপরিবহন নির্গমন পরীক্ষার তোয়াক্কা না করেই রাস্তায় চলছে। পুরনো ডিজেলচালিত যানগুলো ঢাকার বাতাসে যেন বিষ ঢেলে দিচ্ছে।
একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা জানি কিছু গাড়ি চলারই কথা না। কিন্তু থামাতে গেলেই উপরের ফোন আসে। বাস মালিকদের হাত অনেক লম্বা।”
বুয়েটের পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, “ঢাকার বায়ু দূষণের ৪০ শতাংশের জন্য দায়ী যানবাহনের ধোঁয়া। পুরোনো ডিজেলচালিত বাস-ট্রাকগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর।”
এই ধরণের যানবাহন থেকে নিঃসরণ হয় নাইট্রোজেন অক্সাইডস, কার্বন মনোক্সাইড ও সূক্ষ্ম পার্টিকুলেট ম্যাটার—যা ফুসফুসে জমে থেকে ধীরে ধীরে শরীরকে পঙ্গু করে তোলে।
নির্মাণকাজ: ধুলার সাম্রাজ্য
ঢাকায় ৩৬৫ দিনই চলে নির্মাণকাজ। ভবনের পাইলিং, রাস্তাকাটা, ড্রেন বসানো, ফুটপাত ভাঙা—সব কিছুতেই উড়ছে ধুলা। কিন্তু ধুলা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই।
অনেক জায়গায় দেখা যায়, শ্রমিকেরা কোনো আবরণ ছাড়া বালি ও সিমেন্ট এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিচ্ছেন। এই ধুলা ঢুকে পড়ছে শ্বাসনালীতে। শিশু, বৃদ্ধ, হাঁপানি রোগীদের জন্য এই ধুলা মৃত্যু ফাঁদ।
উত্তরার এক নির্মাণ প্রকল্পের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক বৃদ্ধা বলেন, “আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ছেলে বলছে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে। কিন্তু এই বয়সে সব ফেলে যাবো কোথায়?”
একটি জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার বায়ু দূষণের প্রায় ৩০ শতাংশই আসে নির্মাণসাইটের ধুলা থেকে। অথচ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান নেয় না কোনো ব্যবস্থা—নেই পানি ছিটানো, নেই আবরণ।
ইটভাটা: আগুনে পোড়া বাতাস
ঢাকার চারপাশে—কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, আশুলিয়ায়—শীত এলেই জ্বলে উঠে শত শত ইটভাটা। পুড়ছে কয়লা, কাঠ, পুরনো প্লাস্টিক।বাতাসে মিশছে ঘন ধোঁয়া, যার মধ্যে রয়েছে PM2.5 ও PM10—প্রাণঘাতী বস্তুকণা। এই ধোঁয়া ঢাকাকে ধীরে ধীরে পরিণত করছে এক অদৃশ্য কবরস্থানে।
বর্জ্য পোড়ানো: অন্ধকারে বিষের উৎসব
ঢাকার বস্তি এলাকাগুলোতে সন্ধ্যা হলেই শুরু হয় বর্জ্য পোড়ানো। প্লাস্টিক, রাবার, টায়ার, পলিথিন—সব পোড়ে খোলা জায়গায়। এই ধোঁয়ায় থাকে ডাই-অক্সিন ও ফিউরান—মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিক, যা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
নিঃশব্দ আর্তনাদ: শিশু ও বৃদ্ধেরা বড় শিকার
বায়ু দূষণ এখন নিছক পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটা একটি জনস্বাস্থ্য সংকট। ঢাকার বাতাস সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে শিশু ও বৃদ্ধদের ওপর। শিশুদের ফুসফুস এখনো গঠনের পর্যায়ে থাকে, ফলে ক্ষতি হয় বেশি।
ঢাকা ন্যাশনাল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে বসে আছেন রুনা বেগম, কোলে ছয় বছরের ছেলে সিয়াম—হাঁপানিতে আক্রান্ত। রুনা বলেন, “ডাক্তার বলছে, বাতাসে ধুলো আর ধোঁয়া বেশি। কিন্তু আমরা তো আর শহর ছাড়তে পারি না।” প্রতিদিন ঢাকায় গড়ে হাজারের বেশি মানুষ শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
দূষণ নিয়ন্ত্রণে আছে আইন, নীতিমালা, পরিকল্পনা।
সরকার বলেছিল, পুরোনো গাড়ি চলবে না, নির্মাণসাইটে ধুলো নিয়ন্ত্রণ হবে। কিন্তু বাস্তবে সব কিছুই কাগজে সীমাবদ্ধ। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “আমাদের লোকবল সীমিত, প্রযুক্তি সীমিত, আর চাপ আসে অনেক দিক থেকে। আমরা চেষ্টা করি, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।”
এদিকে সাধারণ মানুষ নিঃশব্দে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে।
আমাদের নিঃশ্বাস, আমাদের অধিকার
ঢাকাকে আমরা বলি আমাদের প্রাণের শহর। কিন্তু শহর কি আমাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু দিচ্ছে? সুস্থ বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া মৌলিক অধিকার। আর এই অধিকারের রক্ষায় আমরা যদি আজ না দাঁড়াই, কাল হয়তো আর সময় থাকবে না।
আমরা যদি সচেতন না হই, যদি রাষ্ট্রকে জবাবদিহি করতে বাধ্য না করি, যদি শিল্প, নির্মাণ ও পরিবহন খাতকে নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তাহলে ঢাকার আকাশে থাকবে শুধু ধোঁয়া।
আবারও ফিরে আসি যাত্রাবাড়ীর সেই চায়ের দোকানে। মালেক চাচা জানালার পাশে বসে চায়ে চুমুক দেন, আর প্রশ্ন করেন,
“এই শহরের বাতাস কি আর কখনো পরিষ্কার হবে, বাবা?”
মিমিয়া