ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ২৮ মার্চ ২০২৪

ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ

ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ

 ঈদুল ফিতরের এখনো ১০-১১ দিন বাকি। এর মধ্যে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। আপনজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে এ বছর ঢাকা ও আশপাশ এলাকা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় দেড়-দুই কোটি মানুষ যাতায়াত করবে। তবে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের একসঙ্গে যাতায়াতের জন্য যথাযথ পরিবহন ব্যবস্থা নেই। যে কোনো উৎসবে একসঙ্গে বেশি যাত্রী পরিবহনের জন্য সড়ক, রেল ও নৌপথের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা দরকার।

কিন্তু আমাদের এখানে সড়কপথে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সেই তুলনায় রেল ও নৌপথ অনেকটা গুরুত্বহীন। অথচ স্থায়ী যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে রেল ও নৌপথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে সড়কপথে বিপুলসংখ্যক যাত্রীর চাপ সামাল দিতে অক্ষম। তাই ঈদ উৎসবে যাত্রী পরিবহনের জন্য সড়ক, রেল ও  নৌপথের সমন্বয়ে একটি ভারসাম্যমূলক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ গণপরিবহন বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষেয় গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবহন ব্যবস্থায় দিন দিন সড়কের ওপর চাপ বাড়ছে।

অথচ সড়কপথ তার সক্ষমতা হারাচ্ছে। ধারণ ক্ষমতার বেশি লোড পরিবহন করলে যত আধুনিক সড়ক করা হোক না কেন তার সক্ষমতা থাকবে না। আমাদের এখানে তাই হচ্ছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের সব মানুষ এখন সড়কপথে যাতায়াত করছে। অথচ এখন নৌপথে বিপুলসংখ্যক মানুষ যাতায়াত করত। এটা এখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। ঈদের সময় মানুষ দ্রুত যাওয়ার জন্য সব সড়ক ও রেলপথের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু সড়ক ও রেলপথের পরিবহনে সেই তুলানায় যাত্রী ধারণ করার সক্ষমতা নেই।

তাই সড়ক ও পথের টিকিট ক্রয়ে যাত্রীদের মধ্যে চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এটা কোনো বিজ্ঞানের মধ্যে পড়ে না। বিজ্ঞান বলে সড়ক, রেল, নৌপথের সমন্বয়ে ভারসাম্যমূলক যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমাদের এখানে একটি মাধ্যমকে গুরুত্ব দিলে অন্য মাধ্যম গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এটা ঠিক না। সারাবিশে^ রেল ও নৌপথ একটি স্থায়ী যোগাযোগমাধ্যম। এটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

এজন্য প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দিয়ে আধুনিক ও দ্রুত গতিগতি নৌযানের তৈরি মাধ্যমে নৌপথকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। না হলে যেকোনো উৎসবে বিপুল যাত্রীর চাপ সড়ক ও রেলপথ সামাল দিতে পারবে না।’ এবার ঈদের দীর্ঘমেয়াদি ছুটি থাকায় যাত্রীদের ঢাকা ছাড়ার ক্ষেত্রে সড়ক ও রেলপথের পাশাপাশি নৌ ও আকাশপথ ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি।   
সড়ক পথে ঢাকা ছাড়বে প্রায় ১ কোটি মানুষ ॥ ঈদুল ফিতর উপলক্ষে এবার সড়ক পথে ঢাকা ছড়বে প্রায় ১ কোটি মানুষ। এর মধ্যে বাস-মিনিবাসে ৩০ লাখ, মোটরসাইকেলে ১২ লাখ, কার-জিপ-মাইক্রোবাসে ৩৪ লাখ এবং বিভিন্ন পন্যবাহী খোলা ট্রাক ও বাসের ছাদে ১৮ লাখসহ ৯৫ লাখ মানুষ সড়কপথে ঢাকা ছাড়বে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতি। অথচ সড়কপথে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের চাপ নিতে অক্ষম।

তাই অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে সৃষ্টি হয় যানজট। তাই এ বছর দেশের ১০টি জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ২১৮ টি স্থান যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪০ স্পটে নজরদারি বাড়ানো পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি সংগঠনগুলোর। 
এ ছাড়া হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে ঈদযাত্রা এবার ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে ৬টি মহাসড়কের দুই শতাধিক স্থান যানজট ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নি করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে প্রায় ৫০টি স্থান, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে প্রায় ৬০টি স্থান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে প্রায় ২০টি স্থান, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৪০ স্থান ও ঢাকা-পাটুরিয়া-আরিচা মহাসড়কে ১০টি স্থানকে যানজটের ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ার কারণে যানজটের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়নি। 
তবে এবার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ৭৫ ভাগের অবস্থাই ভালো, তার পরও ঈদযাত্রায় বিভিন্ন স্থানে যানজটের শঙ্কা রয়েছে। এবারের ঈদে মাঝে একদিন বাদে ১০ দিন ছুটি মিলতে পারে। ফলে ধাপে ধাপে যাত্রীরা যাবেন, এতে স্বস্তির হতে পারে ঈদযাত্রা। তবে ভয় জাগাচ্ছে সেতুর টোলপ্লাজার জট। এছাড়া বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কে ইউটার্নের কারণে যানজট সৃষ্টি হয়। তাই যানজট নিরসন ও ঈদযাত্রা নির্বিঘœ করতে একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে সম্প্রতি ঈদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক এক সভায় সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, এবার ঈদে কিছুটা যানজট হবে। একদম যানজটমুক্ত দাবি করা সমীচীন নয়। হাইওয়ে পুলিশের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। হাইওয়ে পুলিশ ও বিআরটিএর সক্ষমতা বাড়াতে না পারলে কোনো ভালো সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না। উত্তরবঙ্গের প্রবেশপথ এবং গাজীপুর ঠিক থাকলে, ঈদযাত্রার সব ঠিক থাকবে।

হানিফ ফ্লাইওভার থেকে ঢাকায় নির্বিঘেœ প্রবেশের ব্যবস্থা করতে হবে। ফেনী থেকে হানিফ ফ্লাইওভারে আসতে যত সময় লাগে, তার চেয়ে বেশি সময় লাগে ফ্লাইওভার থেকে ঢাকায় ঢুকতে। এখন মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় যে, দুই ঘণ্টা লাগে। ঈদযাত্রায় যাত্রাবাড়ীর যানজট, উত্তরবঙ্গের মহাসড়কের কাজ, গাজীপুরে বিভিন্ন মহাসড়ক, বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম পাশের যানজট, এলেঙ্গার যানজট নিরসনে দৃষ্টি দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। 
ঢাকার লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি বন্ধ করার নির্দেশ ॥ রাজধানী ঢাকায় চলাচল করা লক্কড় ঝক্কড় গাড়িগুলো বাংলাদেশের উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, যখন বিদেশীরা বাংলাদেশে আসে এবং আমাদের লক্কড় ঝক্কড় গাড়ি দেখে, তখন আমাদের খুব লজ্জা হয়। এগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পরিবহন মালিকদের এদিকে নজর দিতে হবে। পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, ঢাকার বাইরে থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ঢাকায় ঢোকে।

আমি তো বলব বাইরে থেকে সিটিতে লক্কড় ঝক্কড় গাড়ি কম আসে। বরং সিটিতেই অনেক লক্কড় ঝক্কড় গাড়ির কারখানা আছে। আমি সেগুলো নিজের চোখে গিয়ে দেখেছি। ঈদের আগে সেগুলোতে রং লাগাতে দেখেছি, যে রং আবার ১০ দিনও থাকে না।
রেলপথে ঢাকা ছাড়বে ৪ লাখ মানুষ ॥ ঈদুল ফিরত উপলক্ষে গত ২৪ মার্চ থেকে রেলওয়ে আন্তঃনগর ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রয় শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিক্রয় করা হয়েছে আগামী ৭ এপ্রিলের যাত্রার অগ্রিম টিকিট। রেলওয়ে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলসহ  প্রতিদিন মোট ৩৩ হাজার ৫০০ টিকিট বিক্রয় করা হয়।

এ ছাড়া ঈদযাত্রার শুরুতে ২৫ শতাংশ দাঁড়ানো টিকিট বিক্রয় করা হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্টেশনে থেকে ট্রেন ছাদে যাত্রী পরিবহন করা হয়। তাই সব মিলিয়ে এবার ঈদ যাত্রায় ৪ লাখ  মানুষ ঢাকা ছাড়বে বলে বেসরকারি সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে। 

রেলওয়ের সূত্র জানায়, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গতবার ৫ দিনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি করা হলেও এবারই প্রথম ৭ দিনের টিকিট বিক্রি করছে রেলওয়ে। ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখী মানুষের এই ট্রেন যাত্রার টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে গত ২৪ মার্চ থেকে। আজ শুক্রবার  ৮ এপ্রিলের টিকিট বিক্রি করা হবে।  ৯ এপ্রিলের টিকিট বিক্রি করা হবে ৩০ মার্চ। যাত্রীদের সুবিধার্থে শতভাগ টিকিট এবার অনলাইনে বিক্রি করা হচ্ছে।
এছাড়া আগামী ৩ এপ্রিল থেকে বিক্রয় শুরু হবে ফিরতি ট্রেনের অগ্রিম টিকিট। প্রথম দিন ৩ এপ্রিল হবে আগামী ১৩ এপ্রিলের ঢাকা ফিরতি ট্রেনের অগ্রিম টিকিট। এভাবে পর্যায়ক্রমে ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ এপ্রিলের টিকিট পাওয়া যাবে যথাক্রমে ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮ এপ্রিল।  এ ছাড়া ঈদুল ফিরত উপলক্ষ্যে এবার আট জোড়া বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করা হবে।

ঈদের পাঁচদিন আগে ঈদ স্পেশাল ট্রেনগুলোর মধ্যে চাঁদপুর ঈদ স্পেশাল ১ ও ৩ চট্টগ্রাম-চাঁদপুর; চাঁদপুর ঈদ স্পেশাল ২ ও ৪ চাঁদপুর-চট্টগ্রাম; ময়মনসিংহ ঈদ স্পেশাল ৫ ও ৬ চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম রুটে; দেওয়ানগঞ্জ ঈদ স্পেশাল ৭ ও ৮ চলবে ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ-ঢাকা চলাচল করবে। ঈদের দুইদিন আগে ৮ ও ৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে দু’টি ঈদ স্পেশাল ৯ ও ১০ নম্বর ট্রেনে চলাচল করবে।  ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদ স্পেশাল ১১ ও ১১ ভৈরববাজার-কিশোরগঞ্জ-ভৈরববাজার এবং শোলাকিয়া ঈদ স্পেশাল ১৩ ও ১৪ ট্রেন ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ রুটে শুধুমাত্র ঈদের দিন চলাচল করবে। এ ছাড়া ঈদের আগে আগামী ৭ ও ৯ এপ্রিল ঈদ স্পেশাল-১৫ ও ১৬ নম্বর ট্রেনে জয়দেবপুর-পার্বতীপুর-জয়দেবপুর রুটের চলাচল করবে বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান।
নৌ-পথে যাবে ৬০ লাখ মানুষ ॥ ঈদ উপলক্ষ্যে নৌপথের যাত্রীদের জন্য আগামী ৬ এপ্রিল থেকে ঢাকা নদীবন্দর সদরঘাট টার্মিনাল থেকে বিশেষ লঞ্চ চলাচল করবে। দক্ষিণাঞ্চলের ৪১টি রুটে চলাচলের জন্য ইতিমধ্যে ১৩০টি লঞ্চ প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা-ট্রাফিক) মো. জয়নাল আবেদীন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবারের মত এবারও ঈদে লঞ্চের স্পেশাল সার্ভিসের ব্যবস্থা থাকবে। বিশেষ করে বরিশাল, চাঁদপুর ও ভোলার ইলিশা রুটের এই স্পেশাল লঞ্চ সার্ভিস পরিচালিত হয়। এখানে আগে যেখানে দুই-চারটি লঞ্চ চলাচল করতো ঈদে এই রুটে চার-আটটি লঞ্চ চলাচল করবে।’ যাত্রীদের চাপ বেশী হলে লঞ্চ সংখ্যা আরও বাড়নো হবে বলে জানান তিনি।

×