ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আর কানে ভাসে না ‘হৈ হৈ কা-, রৈ রৈ’ ব্যাপার...

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী

প্রকাশিত: ০১:২১, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আর কানে ভাসে না ‘হৈ হৈ কা-, রৈ রৈ’ ব্যাপার...

যাত্রাপালার দুই শিল্পী

শীতকাল জুড়েই রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে মানুষের এক সময় বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ ছিল যাত্রাপালা। এলাকায় এলাকায় বসতো মেলা। এসব মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিল যাত্রাপালা। এছাড়া সার্কাস, পুতুলনাচ, জাদু ইত্যাদির পাশাপাশি সব ধরনের নিত্যপণ্যের পশরা বসতো। 
তবে নানা কারণে বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, হাতের মুঠোয় বিনোদনের সহজলভ্যতা, অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আবর্তে পড়ে বাঙালির লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য এই যাত্রাপালা, সার্কাস ও পুতুলনাচ হারিয়ে গেছে। এখন মেলাও বসে না। এখনো কোথাও কোথাও গ্রামীণ মেলা বসলেও তেমন আর জমছে না। এখন সারাদিন কিংবা সন্ধ্যা নামলেই মেলা থেকে লাউড স্পিকারে আর ভেসে আসে না- ‘হৈ হৈ কা-, রৈ রৈ ব্যাপার...অদ্য রজনীর বিশেষ আকর্ষণ...’।
যাত্রাপালা দেখার জন্য দর্শকরা রাতভর বিনিদ্র থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আর অপেক্ষায় প্রহর গোনেন না। শীতে মেলা বসবে, যাত্রাপালা আসবে, সেই প্রতীক্ষায় থাকে না আর গ্রামের মানুষ। এখন যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ মানেই কদর্য নৃত্য-জুয়া-হাউজির ধুন্ধমার কারবার। ফলে যাত্রার কথা মনে হলে পুরান, ইতিহাস, মহর্ষী ব্যক্তিত্ব বা লোকজ সাহিত্যে বিখ্যাত চরিত্রের কথা আর মানস পটে ধরা দেয় না। এখন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে স্বল্প পোশাকে কথিত প্রিন্সেসদের উদ্বাহু-নাচ-গানের অশালীন দৃশ্য। 
মূলত যাত্রাদলের অতি মুনাফালোভী মালিকদের খপ্পরে পড়ে গত তিন দশকে মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে এই শিল্প। দুই দশক আগেও সারাদেশে তিন শতাধিক যাত্রাদল ছিল। কমতে কমতে এখন সর্বোচ্চ টিকে আছে মাত্রা ২০টি। তাও সেগুলো বিচ্ছিন্ন। এখন আর কোথাও ডাক পায় না যাত্রাশিল্পীরা। যাত্রার এই করুণ দশার কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন এই শিল্পের মানুষগুলো। 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন যাত্রাশিল্পের অবক্ষয় এবং বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ অসাধু যাত্রাপালা ব্যবসায়ীদের ‘প্রিন্সেস’ আমদানি আর জুয়া-হাউজি চালু। যাত্রাশিল্পীদের ভাষ্য তাদের কাছেই চিরায়ত যাত্রাপালার মৃত্যু ঘটে। 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাত্রাপালায় অশ্লীলতা ঢুকে পড়ায় সাধারণ দর্শকরা যাত্রাপালা থেকে বিমুখ হয়েছে। তবে সুস্থ যাত্রাপালা দেখতে এখনো দর্শকের অভাব হবে না।
দেশে পুতুলনাচের অবস্থাও বিপন্ন। আর সার্কাস তো দেখা যায় না। অথচ গ্রামবাংলার আবহমানকাল থেকে চলে আসা অন্যতম একটি শৈল্পিক বিনোদনের মাধ্যম হলো যাত্রাপালা। সঙ্গে ছিল সার্কাস-পুতুলনাচ।

যদিও কালের গহবরে তা আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। বর্তমানে যাত্রার নামে যা কিছু টিকে আছে... সেখানে অশ্লীল কিছু নৃত্য, অর্ধনগ্ন নারীর কোমর দোলানো নৃত্য, অশ্লীল সংগীত ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এ কারণে, মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ঐতিহ্যের যাত্রাপালা থেকে। সবখানে দলাদলি আর স্থানীয় রাজনীতির কারণে সংঘাত এড়াতেই এখন আর মেলায় উদ্যোগ নেয় না কেউ। যেখানে মেলা নেই সেখানে যাত্রাপালায় থাকার কথা নয়।

আর বর্তমান প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে যুক্ত। তাই তাদের জীবনযাপনে নিয়ে এসেছে নতুন গতি। জীবন বদলে দেওয়ার এই জাদুর কাঠির সঙ্গে হারিয়ে গেছে জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যের বিনোদন ও সংস্কৃতির লালিত রূপ যাত্রাপালা।
মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী

×