ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কুমারীত্ব পুনরুদ্ধার শল্যচিকিৎসা বেআইনি ঘোষণার দাবি

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ২৯ জানুয়ারি ২০২০

কুমারীত্ব পুনরুদ্ধার শল্যচিকিৎসা বেআইনি ঘোষণার দাবি

অনলাইন ডেস্ক ॥ যুক্তরাজ্যের আন্দোলনকারীরা সরকারের কাছে অনুরোধ করছেন যেন কুমারীত্ব পুনরুদ্ধার শল্যচিকিৎসা বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়। যে নারীরা এই শল্যচিকিৎসার সহায়তা নেন, তাদের বেশিরভাগই রক্ষণশীল পরিবার থেকে আসা মুসলমান নারী। বিয়ের আগে তারা যৌন সম্পর্ক করেছেন, সেটা তাদের স্বামী বা পরিবার বুঝতে পারলে সমাজচ্যুত, এমনকি হত্যাও করতে পারে, এমন আশঙ্কায় নারীরা এই ঝুঁকি নেন। তারা এমন একটি প্রক্রিয়ার সহায়তা নেন, চিকিৎসা ব্যবস্থায় যাকে বলা হয় 'রিভার্জিনাইজ' যার অর্থ পুনরায় কুমারী করে তোলা। এটি 'হাইমেনোপ্লাস্টি' নামেও পরিচিত। এখানে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে যোনি প্রবেশপথের ঝিল্লির একটি স্তর, যেটি অনেকে 'সতীচ্ছদ' বলে বর্ণনা করে থাকেন, সেটি পুনরায় তৈরি করে দেয়া হয়। চিকিৎসায় কোন সুবিধা নেই : যে নারীদের বিয়ের রাতে তাদের সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়, সেখানে অক্ষত যৌনিপর্দা তার কুমারীত্বের প্রমাণ বলে মনে করা হয়। কিন্তু এই অস্ত্রোপচারের কোন চিকিৎসাগত সুবিধা নেই, শুধুমাত্র নারীদের ভীতি এবং লজ্জাকে ব্যবহার করে এটি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন অধিকার কর্মীরা। এ কারণে তারা এ ধরণের অস্ত্রোপচার বন্ধ করার দাবি করছেন। কিন্তু বিপরীতভাবে বলা হয়, এটি নিষিদ্ধ করা হলে যে নারীরা এ ধরণের অস্ত্রোপচারের সহায়তা নিতে বাধ্য হন, সেই মুসলমান নারীদের জন্য বিপদ বাড়িয়ে দেবে। যুক্তরাজ্যের জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিলের (জিএমসি) গাইডলাইন অনুযায়ী, এ ধরণের অস্ত্রোপচারের আগে রোগীদের সম্মতির সময় জিজ্ঞেস করতে হবে যে, তারা কি কোনরকম চাপের কারণে বা অন্য কোন ব্যক্তির চাপ প্রয়োগের ফলে এ ধরণের কাজ করছেন কিনা। ভয়ের মধ্যে বসবাস : মিডল ইস্টার্ন উইমেন এন্ড সোসাইটি অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা হালালেহ তাহেরি বলেছেন, মরক্কোর একজন ছাত্রী লন্ডনে লুকিয়ে আছেন, কারণ তিনি শুনতে পেয়েছিলেন যে, তাকে হত্যা করার জন্য তার বাবা লোক ঠিক করেছে। ২০১৪ সালে পড়াশোনার জন্য লন্ডনে আসার পর, ওই ছাত্রীর সঙ্গে এক ব্যক্তির পরিচয় হয় এবং তারা একত্রে থাকতে শুরু করেন। যখন এই সম্পর্কের কথা জানতে পারেন তার পিতা, তখন তিনি তাকে মরক্কোয় ফিরে আসতে বলেন। সেখানে একটি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে 'কুমারীত্বের' পরীক্ষা করার পর তার পিতা জানতে পারেন, তার যৌনি পর্দা (হাইমেন) আর অক্ষত নেই। এরপরে তিনি পালিয়ে লন্ডনে চলে আসেন। কিন্তু এরপর থেকে তিনি ভয়ে জীবন কাটাচ্ছেন, কারণ তার আশঙ্কা, তার পিতা হয়তো জানতে পারবে যে, তিনি কোথায় বসবাস করছেন। মরক্কোয় জন্ম নেয়া, ৪০ বছর বয়সী একজন সহকারী শিক্ষক বিবিসিকে বলছেন, বিশ বছর বয়সের সময় তাকে একবার এই পরীক্ষাটি করানো হয়। কিন্তু তিনি আর কল্পনাও করতে পারেন না যে, তার ছেলেমেয়ের কখনো এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। ''আমি কখনোই তাদের ক্ষেত্রে এরকম করবো না। আমি তাদের মুক্তভাবে বেঁচে থাকা শেখাতে চেষ্টা করি।'' বিয়ের রাত : সানডে টাইমস পত্রিকার একটি অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে যুক্তরাজ্য জুড়ে অন্তত ২২টি বেসরকারি ক্লিনিক রয়েছে, যারা যৌনি পর্দা পুনরুদ্ধারের অস্ত্রোপচার করে থাকে। প্রায় এক ঘণ্টার একটি অস্ত্রোপচারের জন্য তারা তিন হাজার পাউন্ড পর্যন্ত নিয়ে থাকে। নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, এসব ক্লিনিক মুসলমান নারীদের ভয়কে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করছেন। কারণ বিয়ের রাতে তাদের কুমারীত্ব নেই, জানতে পারলে কি ঘটতে পারে, তা নিয়ে ওই নারীরা ভয় পান। অনেক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে এসব প্রক্রিয়ার বর্ণনা রয়েছে। লন্ডন গায়ানে সেন্টার নারীদের উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইটে লিখেছে, বিয়ের পরে যদি স্বামীরা বুঝতে পারে যে, তাদের যৌনি পর্দা ভেঙ্গে গেছে, তাহলে বিয়েটি ভেঙ্গে যেতে পারে। ওই ক্লিনিকের মন্তব্য জানার জন্য যোগাযোগ করেছে বিবিসি নিউজ, কিন্তু এখনো কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। 'ভয়ঙ্কর চর্চা' যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক বলেছেন, এই 'ভয়ঙ্কর চর্চা' বন্ধ করার পথ খুঁজে বের করার উপায় খুঁজে দেখবেন। কিন্তু কীভাবে সম্ভাব্য একটি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হবে, তা নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি দেশটির স্বাস্থ্য বিষয়ক দপ্তর। মিস তাহেরি বলছেন, ''যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে এই নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটি কার্যকর করা না হলে মেয়েদের মৃত্যুও হতে পারে।'' লন্ডন স্কুল অব মেডিসিন এবং নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. খালিদ খান, যিনি এরকম প্রক্রিয়া নিজের চোখেই দেখেছেন, তিনি বলছেন, একে নিষিদ্ধ করা যথার্থ কাজ হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত রোগীদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে তথ্য দেয়া হচ্ছে, তখন সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারটি প্রত্যেক নারীর ওপরেই থাকা উচিত। ''আমার বিশ্বাস, চিকিৎসকদের আসল উদ্দেশ্য হলো নির্যাতনের হাত থেকে নারীদের রক্ষা করা,'' তিনি বলছেন। মানসিকভাবে সহায়তা: ব্রিটিশ সোসাইটি ফর পেডিয়াট্রিক এন্ড এডোলেসেন্ট গায়নাকোলজির চেয়ারপার্সন নাওমি ক্রুচ মনে করেন, নারী ও শিশুরা এমন একটি প্রক্রিয়ায় নিগৃহীত হচ্ছে, যার চিকিৎসাগত কোন উপকারিতা নেই। তিনি বলছেন, ''চিকিৎসকদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জিএমসির গাইডলাইনে পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে।'' ''চিকিৎসা খাতের একজন পেশাদার ব্যক্তি হিসাবে একটি শপথের মধ্যে আমরা থাকি যে, রোগীদের কোন ক্ষতি করা যাবে না এবং সম্মানজনক সেবা দিতে হবে। কিন্তু এ ধরণের প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া হলে সেটা নিরীক্ষা এবং বিশ্লেষণের জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত।'' জিএমসির শিক্ষা ও মাণ বিষয়ক পরিচালক কোলিন মেলভিল বলেছেন, ''রোগীদের দুর্বলতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি প্রথমেই চিকিৎসকের বিবেচনায় নেয়া উচিত, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'' সম্মতি নিয়ে প্রশ্ন : ''অন্যদের চাপের কারণে যদি কোন রোগী এই প্রক্রিয়াটি করতে চান, তাহলে তার সম্মতি হয়তো স্বেচ্ছায় আসেনি। একজন চিকিৎসক যদি বুঝতে পারেন যে, একটি শিশু বা তরুণী কসমেটিক সহায়তা চান না, তাহলে সেটা আর করা উচিত নয়,'' তিনি বলছেন। যৌনাঙ্গের অন্য আরো কয়েকটি অস্ত্রোপচার, যেমন লিবিয়াপ্লাস্টি (যার মাধ্যমে যৌনাঙ্গের আকার ছোট অথবা পরিবর্তন করা হয়) ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে । যুক্তরাজ্যের সব ধরণের পরিবেশ থেকে আসা তরুণীরা এর মধ্যে রয়েছে। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×