ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংসারের অভাব ঘোচাতে পুরুষের সহযোগী এখন নারী

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ১৯ অক্টোবর ২০১৯

সংসারের অভাব ঘোচাতে পুরুষের সহযোগী এখন নারী

তাহমিন হক ববী ॥ রাষ্ট্র ও সমাজের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি। সরকার দারিদ্র্য হ্রাসে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্জিত গতিশীলতা এবং হতদরিদ্রদের জন্য টেকসই নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা, অতিদরিদ্র ও দুস্থদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও টেস্ট রিলিফ, জিআর ছাড়াও সরকার-উদ্ভাবিত একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রয়ণ, গৃহায়ণ, আদর্শ গ্রাম, গুচ্ছগ্রাম, ঘরে ফেরা প্রভৃতি কর্মসূচীর পাশাপাশি ওএমএস, ফেয়ার প্রাইস কার্ড, ভিজিডি, প্রতিবন্ধীদের জন্য ভাতা, বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা, দুস্থ মহিলা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা, চর জীবিকায়নসহ বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়িত করছেন। সরকারের এ সকল সুযোগ সহযোগিতার পাশাপাশি রয়েছে দুগ্ধ উৎপাদনের গাভী পালন, ছাগল পালন হাঁস মুরগি পালন প্রভৃতি। উল্লেখ্য, ১৭ অক্টোবর ছিল আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস। এবারের স্লোগান ছিল ‘পরিবার, শিশু ও সমাজের ক্ষমতায়ন সকলের অংশগ্রহণে দারিদ্র্য বিমোচন’। বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বিশেষ করে সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি এখন অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশের পথে। দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রামীণজনপদের চিত্র পাল্টিয়ে দিতে সহায়তা করছে। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, পুষ্টির নিরাপত্তা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং নিরাপদ প্রাণী আমিষের নিশ্চয়তার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিক গবাদি পশু পালন, ক্ষুদ্র ব্যবসা একটি সম্ভাবনাময় ও লাভজনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সঙ্গে উপযুক্ত প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং বাণিজ্যিকভিত্তিক দেশী মুরগি ও গরু ছাগল পালন আজ কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনের একটি অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত করেছে। এক সময় দিনমজুর স্বামীরা যা আয় করতেন তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলত না। কোনমতে দিন পার হয়েছে। বন্ধ ছিল ছেলেমেয়ের খেলাপড়া। আজ সেই দিনগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য নির্মূলে উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী জেলার গ্রামীণ জনপদে নারী পুরুষরা গাভী ও ছাগল পালনে উজ্জ্বল সাফল্য বয়ে আনছে। ডিমলা উপজেলার তিস্তা বিধৌত গ্রাম থেকে শহর ঘেষা গ্রামগুলোর চিত্র পাল্টিয়ে দিয়েছে তারা। জীবিকার তাগিদে এক সময় বেশিরভাগ দরিদ্র পরিবারের নারী ও পুরুষরা ভাল কাজের আশায় বিভিন্ন শহরে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। এতে প্রতারিত হতেন অনেকে। ছেলেমেয়েরা ছিল শিক্ষার আলো থেকে অনেক দূরে। কিন্তু এখন সে চিত্র আর নেই বললেই চলে। সংসারের অভাব ঘোচাতে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করছেন নারীরাও। সন্তানরা যাচ্ছে স্কুল কলেজে। তিস্তা নদীর ধারে খগাখড়িবাড়ি মেম্বার পাড়াগ্রামের গৃহবধূ মেরিনা। গাভী পালন করে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ লিটার দুধ বিক্রি করছেন। নিজের পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির চাহিদা মিটিয়েও সংসারের অর্থ যোগান দিচ্ছেন। এই অর্থ থেকে ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চলে। এরপরও দুই বছরের মধ্যে ৫০ হাজার টাকায় এক বিঘা জমি ক্রয় করে চাষাবাদ করছে। এভাবেই গাভী পালন করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে ফেলেছে মেরিনা। মেরিনা বাল্যবিয়ের শিকার। এক সময় দরিদ্রতার কষাঘাতে পাঞ্জরভাঙ্গার কবলে ছিল মেরিনা। তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাবা-মা ১৯৯০ সালে তাকে বিয়ে দেন। বাল্যবিয়ে হওয়ায় তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। বিয়ের সময় স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল। কিন্তু সর্বনাশা তিস্তার ভাঙ্গনে চার বছরেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। অভাব-অনটনে সংসারে প্রতিনিয়ত ঝগড়া-বিবাদ, অশান্তি শুরু হয়। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে পৃথক করে দেয়। মেরিনার কোলজুড়ে আসে এক পুত্রসন্তান। এরপর তার কোলজুড়ে আসে আরও দুই সন্তান। স্বামীর একার আয়ে পাঁচজন মানুষের খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। স্বামীকে সংসারে আর্থিক সহযোগিতার জন্য নিজেই কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর সরকারের সহযোগিতায় পলীশ্রী ঘাতসহনশীল কমিউনিটি গঠনের সদস্য হন। এরপর গাভী পালন ও ব্যবস্থাপনা স¤পর্কে প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৪ সালে হতদরিদ্র সদস্য হিসাবে একটি উন্নত জাতের গাভী পেয়ে যাই। কপাল এতই ভাল ছিল যে আমাকে যে গাভীটি প্রদান করা হয় সেটি সাত দিনের মাথায় একটি বাছুর হয়। এতেই ঘুরে দাঁড়ায় মেরিনা। আজ মেরিনা ৭টি গাভীর মালিক হয়েছেন। প্রতিটি গাভীর দুধ বিক্রি করে আয় হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। মেরিনার সফলতা দেখে ডিমলা উপজেলার শত শত নারী ও পুরুষ গাভী পালনে এগিয়ে আসে। আজ তিস্তা বিধৌত ডিমলা উপজেলায় মাত্র ৫ ভাগ সুদে রূপালী ব্যাংক ও সমবায় অধিদফতর ও বেসরকারী সংস্থা পল্লীশ্রী, এর মাধ্যমে ৫ হাজার গাভী পালন খামার গড়ে উঠেছে। এই খামারের উৎপাদিত দুধ বিক্রি করে ওই সকল হতদরিদ্র পরিবার তাদের দরিদ্রতা দূর করে সফলা নিয়ে এসেছে। অপরদিকে গাভী ও ছাগল পালনে বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাকের সহযোগিতায় নীলফামারী জেলায় ৩৫ হাজার ৪৭২ অতিদরিদ্র পরিবার আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের আওতায় এসেছে। দরিদ্রতা দূরীকরণে গ্রামীণ জনপদে নারী ও পুরুষরা এই প্রকল্পে গাভী ও ছাগল পালনে মডেল হয়েছে। এই সকল পরিবার ১৮ হাজার টাকা মূল্যের একটি গাভী পেয়ে ঋণ পরিশোধে ছাড় পেয়েছে ৯ হাজার টাকা করে! আবার ৯ টাকা ঋণ পরিশোধে সুযোগ পেয়েছে ৩৬ কিস্তিতে। এমন সুযোগ কেউ হাত ছাড়া করেনি। জেলা সদরের চাপড়াসরনজামি ইউনিয়নের সরকারপাড়া ও ইটাখোলা ইউনিয়নের কানিয়ালখাতা পোড়াপাড়া গ্রাম দুটি ছিল দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত। আজ সেই গ্রাম দুটির শতাধিক পরিবার সকলে এই প্রকল্পের আওতায় এসে নিজেদের গড়ে তুলেছে স্বাবলম্বী। পোড়াপাড়া গ্রামের কলাবতী রানী। স্বামী বিমলচন্দ্র রায় ছিলের কৃষি শ্রমিক। মাত্র তিনশতক বসতভিটা ছাড়া কিছুই ছিল না। ভাঙ্গা বসতঘর। তাদের তিনটি ছেলে সন্তান। কলাবতী এই প্রকল্পের আওতায় প্রথমে দুটি গাভী নিয়েছিলেন। গাভীর দুধ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করে ৯টি গাভীর মালিক হয়েছেন। ২০০৯ সালের পর তার দরিদ্রতা দূর হতে থাকে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। আজ তার সেমি পাকা বসতঘর হয়েছে। মেয়ে সন্তান নেই বলে কৌশিকা নামের এক শিশু কন্যাকে নিজের মেয়ে হিসেবে লালন পালন করছেন। এই শিশুটি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। কলাবতী রানী জানান, গাভী পালন করে আজ আমি নিজের পরিবারের দরিদ্রতা দূর করতে সক্ষম হয়েছি। বড় ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে ইপিজেডে চাকরি করছে সে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছেলেটি স্কুলে ও কলেজে পড়ছে। বসতঘর ছিল ভাঙ্গা। সেটি আজ সেমিপাকা ও টিনের ঘর করতে পেরেছি। আবাদি জমির মালিক হয়েছেন ৬০ শতক। এই জমিতে ফলছে ফসল। সরকারপাড়া গ্রামের পারভিন আক্তার। তার স্বামী রশিদুল দিনমজুর। দারিদ্র্য পদে পদে কুড়ে খেতো তার পরিবারকে। তিন সন্তান নিয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখতো। সরকারের দেয়া ফেয়ার প্রাইস কার্ড, ভিজিডি, চাল ছিল তার একমাত্র ভরসা। আজ তিনি একটি গাভীর মাধ্যমে তিনটি গাভী ও ১০টি মুরগি পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। আবাদি জমি নিয়েছে ১০ শতক। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় জেলার এসব পরিবারের গাভী পালনে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার লিটার দুধ বাজারজাত করা হচ্ছে। এ ছাড়া চিলিং পয়েন্টেগুলোকে তারা প্রতিদিন ২০ হাজার লিটার গাভীর দুধ সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছে। গাভী পালনে ঠিক এভাবেই এ জেলার অতিদরিদ্র্য পরিবারগুলো আজ দরিদ্রতা দূরীকরণ করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে চলছেন। এ ব্যাপারে নীলফামারী জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দারিদ্র্য দূরীকরণের সকল পদক্ষেপ এ জেলায় বিদ্যমান। তিনি উল্লেখ করে বলেন রূপকল্প: ২০২১কে সামনে রেখে উন্নয়ন ভাবনাকে বাস্তব রূপান্তরের লক্ষ্যে পরিকল্পনা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আমরা এ নিয়ে সকল সেক্টরে মতবিনিময় করে গ্রামে গ্রামে দারিদ্র্য দূরীকরণে পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করে চলছি। সর্বক্ষেত্রে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় দেশ আজ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এবং উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করবে।
×