ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ১১:৫১, ১৮ অক্টোবর ২০১৯

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ মানুষের জন্য কাজ করতে পেরে আরেক মানুষ এত খুশি হয়! কেউ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। কেউ বিশেষজ্ঞ নার্স। প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। গত কয়েকদিন দলটির কর্মকা- দেখে অভিভূত, শুধু অভিভূতই হতে হলো। তাদের কথাই বলতে চাই শুরুতে। নয় সদস্যের মেডিক্যাল টিম, হ্যাঁ, সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকায় এসেছে। একজন আবার মরোক্কোর। প্রত্যেকেই সমমনা। মানবতার সেবা করতে পারলেই খুশি। অভিন্ন উদ্দেশ্যে গত ১০ অক্টোবর ঢাকায় পা রাখেন তারা। দলে রয়েছেন সার্জিক্যাল অনকলজিস্ট ডাঃ সুজান আলিসা হুকস্ট্রা, রেডিয়েশন অনকলজিস্ট ডাঃ আরুল মাহাদেবান, মেডিক্যাল অনকলজিস্ট ডাঃ সাবরিনা শারমিন খান, সার্জিক্যাল অনকলজিস্ট ডাঃ রাজা আঘজাদি ও মেডিক্যাল অনকলজিস্ট ডাঃ হামিদ লারি। একই দলে আছেন রেজিস্টার্ড নার্স জুলিয়েট এম কোহেন, হসপিস ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার নার্স মার্জোরি ডুগ্যান স্কুনোভার, ফিজিওথেরাপিস্ট পেইন ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ মেরি বার্গ এবং আইটি বিশেষজ্ঞ রোনাল্ড কোহেন। আর সকলকে সংগঠিত করে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন আরেক মহীয়সী নারী এলিজাবেথ ম্যাকলিলান। পার্টনার্স ফর ওয়ার্ল্ড হেলথ নামের একটি সংগঠন পরিচালনা করেন তিনি। অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আহ্বানে বাকি ডাক্তার ও নার্সরা সাড়া দিয়েছেন। সংগঠনটি বাংলাদেশে কাজ করছে রোটারি ক্লাব অব ঢাকা ম্যাভেরিক্সের সঙ্গে। এবার ম্যাভেরিক্সের উদ্যোগে তৃতীয় ক্যান্সার মিশন ও পঞ্চম মেডিক্যাল মিশনের আয়োজন করা হয়। মিশন সফল করতে গত কয়েকদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন বিদেশী ডাক্তার নার্স ও রোটারিয়ানরা। ক্যান্সার নিয়েই মূল কাজ। তাই বিদেশী চিকিৎসক ও নার্সরা বেশি সময় দেন মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। সেখানে বেশ কিছু জটিল সার্জারি করেন তারা। রোগীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশেন। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। দেশীয় চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়, স্কিল ট্রান্সফার, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়াসহ আরও নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় তাদের। একজন ডাক্তার কিংবা নার্স যখন তার পেশার প্রতি সৎ থাকেন, যখন নিজেকে উজার করে দিতে জানেন তখন কত ভাল কিছু ঘটতে পারে তা এক সপ্তাহ ধরে দেখিয়েছেন তারা। আলাদা করে একটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল এক রোগীকে ক্যান্সার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে ওপরে তোলা হবে। কিন্তু কিভাবে তোলা যায়? স্বজনরা ট্রলির খোঁজ করছিলেন। পাচ্ছিলেন না। বিদেশী চিকিৎসক দলের একজন দৃশ্যটি দেখে দৌড়ে কাছে গেলেন। রোগীকে একরকম কোলে নিয়ে লিফটের দিকে ছুটলেন তিনি। তার পিছু পিছু গেলেন রোগীর স্বজনরা। ভাবা যায়? ঢাকা মেডিক্যালেও একই রকম আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেন তারা। মিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, ব্রেস্ট ক্যান্সার বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি। এটা মোটামুটি পরীক্ষিত যে, ঢাকার শিক্ষিত সচেতন অনেক নারী অনেক তরুণী এই রোগটি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নন। এ নিয়ে তাদের অকারণ লজ্জা। ভয়। ফলে শেষ মুহূর্তে তারা যখন রোগটি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তখন আর তেমন কিছু করার থাকে না। এই দুঃখজনক পরিণতি রুখতে ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ ও নিজে নিজে পরীক্ষা করার পদ্ধতি মেয়েদের সামনে তুলে ধরে মেডিক্যাল টিম। এই টিম যুক্তরাষ্ট্র থেকে দামী ও জরুরী মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট নিয়ে এসেছিল। বিভিন্ন হাসপাতালে এগুলো বিনামূল্যে দান করা হয়। এই দানের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার মিশন শেষ হয়েছে। মিশন নিয়ে কথা হচ্ছিল এলিজাবেথ ম্যাকলিলানের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছরই মেডিক্যাল টিম নিয়ে আসি। এখানে কত মানুষ চিকিৎসা বঞ্চিত! তাদের জন্য কিছু করতে পারলে ভাল লাগে। একই মন্ত্রে উজ্জীবিত রোটারিয়ান শেলী বলছিলেন, সারা বছরই এ ধরনের কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করি আমরা। মানবিক মানুষ হিসেবে এটা আমাদের দায়। এ কাজে বিদেশী বন্ধুদের পাশে পেয়ে সবাই খুব কৃতজ্ঞ বলেও জানান তিনি। অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। বৃহস্পতিবার কয়েক ঘণ্টার জন্য ঢাকার অতিথি হয়েছিলেন বিশ্ব ফুটবল সংস্থা ফিফার প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো। নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তার আগমনের খবর দিনভর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। সাধারণের মধ্যেও চলেছে আলোচনা। বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন তারা। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন ফিফা প্রেসিডেন্ট। এ সময় শেখ হাসিনার নাম লেখা একটি জার্সি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীও ফিফা প্রধানের নাম লেখা একটি জার্সি তাকে উপহার দেন। পরে আরও কিছু কর্মসূচীতে যোগ দেন ইনফান্তিনো। কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গেও। ফুটবল ও ক্রিকেট প্রশ্নে বেশ মজার মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ফুটবল খেলে বিশ্বের ২১১টি দেশ। ক্রিকেট খুব বেশি দেশ খেলে না। যে খেলা ১০-১১টি দেশ খেলে, সে খেলায় ভাল করার সম্ভাবনা এমনিতেই বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারছি ক্রিকেটে বাংলাদেশের অনেক সাফল্য আছে। কিন্তু ক্রিকেট তো সারা দুনিয়ায় হাতে গোনা কিছু দেশ খেলে। ফুটবলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক বেশি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এভাবে তার ঝটিকা সফরের ফলে নতুন করে সামনে আসে বাংলাদেশের ফুটবল। অনেকদিন পর এভাবে সামনে আসা। সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠানের কথা বলা যাক এবার। সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজনের শ্রেষ্ঠ সময়টি চলে এসেছে। হেমন্ত এবং শীতকালে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। এ সময় মিলনায়তনের ভেতরে তো বটেই, বাইরেও নিশ্চিন্তে উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। এই যেমন এখন ঢাকায় চলছে গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব। মৌসুমের একেবারে শুরুতে, হ্যাঁ, বেশ বড়সড় উৎসব। গত শুক্রবার শিল্পকলা একাডেমিতে এ উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। এখন বেশ জমজমাট। ১২১ দলের পরিবেশনা। ছয়টি মঞ্চ। কোনটিতে নাটক, কোনটিতে গান বা নাচ। আছে কবিতাও। উৎসবের মূল ভেন্যুটি শিল্পকলা একাডেমি। একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার ও স্টুডিও থিয়েটারে চলছে নাটক। সামনের প্রশস্ত সিঁড়ির নিচে অস্থায়ী মঞ্চ। সেখানে চলছে গান নাচ কবিতা। আলাদা করে কাব্য প্রযোজনা উপভোগ করা যাচ্ছে সঙ্গীত আবৃত্তি ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে। শিল্পকলা একাডেমির বাইরে মহিলা সমিতি মঞ্চেও দেখা যাচ্ছে নাটক। ঢাকার মঞ্চের নামকরা বেশ কয়েকটি দলের নাটক রাখা হয়েছে উৎসবে। কোন কোন নাটক জনপ্রিয় হলেও, নিয়মিত মঞ্চস্থ হয়। এ কারণে নাটকগুলো ঘিরে বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আবার কয়েকটি নাটকের মান অতো ভাল না বলে স্বীকার করে নিয়েছেন আয়োজকরাও। তবে উৎসবে যোগ দেয়া অপার বাংলার দলগুলোর নাটক নিয়ে বিশেষ কৌতূহল দেখা যাচ্ছে। মোট পাঁচটি দল এসেছে নাটক নিয়ে। পার্শ্ববর্তী দেশের নাট্যভাবনা ও সাম্প্রতিক প্রবণতা জানতে মিলনায়নে ভিড় করছেন দর্শক। ঢাকার নাট্যজনদেরও দেখা যাচ্ছে সামনের সারিতে। আগামীকাল শনিবার উৎসব শেষ হবে।
×