ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

নন্দিত সিনেমাওয়ালা হুমায়ূন আহমেদ

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৬ নভেম্বর ২০১৭

নন্দিত সিনেমাওয়ালা হুমায়ূন আহমেদ

১৯৪৮ সালের ১৩ নবেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৩ নবেম্বর, সময়ের ব্যবধান ৬৯ বছর। এই ঊনসত্তর বছরে আমাদের গ্রহ তথা বসবাসের পৃথিবীতে ঘটেছে অসংখ্য কালজয়ী ঘটনা। আমাদের জাতীয় জীবনেও ঘটেছে বহু-বহু ঘটনা। সময়ে সময়ে আমরা এসব স্মরণীয় ঘটনার স্মৃতি মন্থন করি। স্মৃতির দায় কখন কখন আমাদের ব্যক্তিজীবনকেও ওলট-পালট করে দেয়। বিশেষ করে যে ঘটনাগুলো আমাদের ব্যক্তি জীবনকে আলোড়িত করে! কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। আমাদের এই ছোট্ট বাঙালী জীবনে এক গভীর অনুরাগের নাম। তাঁর বেঁচে থাকা ছোট জীবনখানি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে, অনেক কিছু দেখিয়েছে, এমন কৃতজ্ঞচিত্ত আজ বহু বাঙালীর! তাঁর মতো করে সহজ সরল প্রাণঞ্জল ভাষায় সম্ভাবত আর কেউ আমাদের জীবন আঁকতে পারেনি! যে কারণে তিনি পৌঁছেছেন; দেশ-কাল-সমাজ থেকে শুরু করে জটিল মানব জীবনের সকল প্রান্তে। বিনিময়ে অগণিত ভক্তের অফুরন্ত ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন জীবিত-মৃত দু’কালেই! কথাসাহিত্যের সুর ও বাণী হুমায়ূন আহমেদ নিজের মতো করেই সাজিয়েছেন। যারা এই সুর শুনেছেন বানি পড়েছেন তাদের বেশির ভাগই মুগ্ধ হয়েছেন! হুমায়ূন আহমেদ মানুষের জন্য শুধু লিখেই থামেননি লেখার সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা চালিয়েছেন মানুষের আরও কাছে যাবার, অজস্র জীবন নিজের মতো করে দেখার। তাঁর এই চেষ্টায় আমরা তাঁকে দেখেছি নাটক-সিনেমার চিত্রনাট্য লিখে রাত ভোর করতে। তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ অবলম্বনে সত্তরের দশকে নির্মিত হয় টিভি নাটক। অবশ্য এই উপন্যাস যে নাটক কিংবা সিনেমার চিত্রনাট্য হবে তা কিন্তু তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। প্রথম উপন্যাসের পর ক্ষণকালের বিরতি, এরপর আবার যখন শুরু করলেন তখন মানুষের গল্প লেখা তিনি আর থামাননি চালিয়েছেন অন্তিম সয়ন পর্যন্ত; টিভি দর্শকদের জন্য প্রথম নাটক ‘প্রথম প্রহর’ লিখেছেন ১৯৮৩ সালে। এরপর একই দশকে লিখেছেন আরো একাধিক নাটক। ‘এই সব দিন রাত্রি’ ছিল তাঁর লেখা প্রথম ধারাবাহিক। সেই সময়ের টিভি দর্শকদের ভীষণভাবে আলোড়িত করে হুমায়ূন আহমের লেখা এই ধারাবাহিকটি। এরপর ‘বহুব্রীহি’ ‘অয়োময়’ এ সবের ধারাবাহিকতায় নাটক ‘কোথায় কেউ নেই’ দর্শকদের এক রকম পুড়িয়ে মারে। তার সৃষ্টি একাধিক নাটকীয় চরিত্র মানুষের বাস্তব জীবনে শিকড়গারে। তাঁর এই শক্ত প্রভাবে দিনে দিনে নাটকের রাজ্যে তিনি হয়ে ওঠেন এক আলাদা নক্ষত্রের নাম। যার রশ্মি বছরের পর বছর আমাদের পুড়িয়ে মারছে। যদিও এসব ছিল টিভি পর্দায় ছোট গৃহকোণে! ১৯৯৪ সাল। মুক্তি পায় তাঁর লেখা এবং পরিচালনার প্রথম সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’। যখন এই সিনেমা দেশব্যাপী মুক্তি পায় তখন আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধো এক রকম ধূসরস্মৃতি তুল্য। কারণ সময়টা ছিল উনিশ চুরানব্বই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা বা স্বাধিকার আন্দোলন বলে কথা, সর্বোপরি জাতির অস্তিত্ব বলে কথা। হুমায়ূন আহমেদের নিরলস চেষ্টায় আগুনের পরশমণি বাংলার ঘরে ঘরে মুক্তিযুদ্ধের নির্ঘুম রুদ্ধশ্বাসের স্মৃতিকে এক রকম বিদ্যুতের ঝলকানির মতো মনে করিয়ে দেয়। সিনেমার প্রথম কিস্তিতে নিজেকে প্রমাণ করেণ সঙ্গে বুঝিয়ে দেন কতগুলো নির্ঘুম রাত অতিবাহিত করলে একটা সিনেমা বানানো সম্ভব হয়! সিনেমায় রাজকীয় সূচনার পর আবার লেখা লেখি সঙ্গে চলছে ছোট পর্দায় নন্দিত নাটক নির্মাণের দৃঢ় চেষ্টা। প্রথম সিনেমা মুক্তির প্রায় অর্ধযুগ পর। ২০০০ সালে মুক্তি পায় তাঁর দ্বীতিয় সিনেমা ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। বাংলার অসংখ্য মানুষ তাঁর এই সিনেমা দেখে চোখের জল নাকের জল এক করে শ্রাবণের বৃষ্টিতে জলাঞ্জলি দিয়েছে। বাংলার শহর-নগর. গ্রাম-বন্দর সব জনপদেই এই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরেছে। এরপর ‘দুই দুয়ারী’ ‘চন্দ্রকথা’ ‘শ্যামল ছায়া’ ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ ‘আমার আছে জল’ সবশেষ ২০১২ সালে মুক্তিপায় তাঁর নির্মিত শেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ তাঁর নির্মিত সবগুলো সিনেমার নমের সঙ্গে শ্রেষ্ঠ পুরোস্কার তো আছেই সঙ্গে তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত সিনেমাও শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে আসীন হয়েছে। ‘নন্দিত নরকে’ শংখনীল ‘কারাগার’ ‘নিরন্তর’ ‘দূরত্ব’ ‘সাজঘর’ ‘দারুচিনি দ্বীপ’ এ সকল সিনেমা এমটাই দাবি করে। আসলে পুরোস্কারের বাইরে সত্য যে বিবেচনা তা হলো অসংখ্য মানুষ তাঁর সিনেমা দেখে ব্যাপক বিনোদিত এবং আলোড়িত হয়েছে। সাহিত্যের মিশেলে সিনেমা কিভাবে জন নন্দিত করা যায় তা তিনি দেখিয়েছেন। যে কারণে আজ অসংখ্য মানুষের মনে হুমায়ূন আহমেদের সিনেমা নাটক ঘুরে বেড়ায়। প্রতি নিয়ত কেউ না কেউ তাকে খুঁজছে। গত ১৩ নবেম্বর ছিল এই সাহিত্যর বর পুত্রের ঊনসত্তরতম জন্মদিন। বই মেলা, সাহিত্য মেলা, আলোচনা সভা, ইন্টারনেটে দুনিয়ায় বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিল তাঁকে ঘিরে লাখো রাজকীয় সম্ভাসন! গুগোলের বাংলাদেশের ওয়েব পেইজে তাঁর জন্ম দিন উপলক্ষে বিশেষ ডুডল শেয়ার করে। তার সাহিত্য, সিনেমা-নাটক নিয়ে আলোচনা হয়েছে বা হচ্ছে অশেষ। এত এত আলোচনার বাইরে একজন হুমায়ূন সত্তার বহুরূপের আলোকরশ্মি বহু মানুষের জীবনে প্রতি মুহূর্তে তিনি বহমান। হয়তো এটাই তার ক্ষণ জীবনের অসামান্য কৃতিত্ব!
×