ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যার বাড়ি আগুনে পুড়ল সেই টিটু রায়ই গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৫ নভেম্বর ২০১৭

যার বাড়ি আগুনে পুড়ল সেই টিটু রায়ই গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী ॥ যার বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে রংপুরে হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়, সেই টিটু রায়কে গ্রেফতার করা হয়েছে। মঙ্গলবার ভোরে জেলার জলঢাকা উপজেলার গোলনা ইউনিয়নের চিড়াভিজা গোলনা গ্রাম থেকে রংপুর পুলিশ লেখাপড়া না জানা নিরক্ষর টিটু রায়কে গ্রেফতার করে। পরে তাকে রংপুর নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে, অবমাননাকর ফেসবুক স্ট্যাটাসটি গ্রেফতারকৃত টিটু রায়ের নয় বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় লোকজন। টিটুর মাও বলছেন, তার ছেলে লেখাপড়া জানে না। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, টিটু কি আদৌ দোষী? নাকি তাকে অযথা বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে! টিটুকে গ্রেফতারের পর সচেতন মহল এমনটিই ভাবছেন। অন্যদিকে, টিটু রায়কে গ্রেফতারের সময় প্রত্যক্ষদর্শী হরিনাথ রায় জানান, সোমবার সন্ধ্যায় জলঢাকা উপজেলার গোলনা ইউনিয়নের চিড়াভিজা গোলনা গ্রামের আত্মীয় বৈকান্ত চন্দ্র রায়ের ছেলে কৈলাশ চন্দ্র রায়ের বাড়িতে বেড়াতে আসে। মঙ্গলবার ফজরের আজানের আগে চারটি গাড়িতে পুলিশের একটি দল এসে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। টিটু রায়কে গ্রেফতারের বিষয়টি মঙ্গলবার দুপুরের দিকে রংপুর সদর উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামে আগুনে পোড়ানো হিন্দুদের বাড়িঘর পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, টিটু রায়কে নীলফামারী হতে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রথম টিটু রায়ের গ্রেফতারের বিষয়টি প্রকাশিত হলে সাংবাদিকরা এ নিয়ে খোঁজ খবরে মাঠে নেমে পড়ে। তবে পুলিশ এ বিষয়ে কোন তথ্য প্রদানে বিরত থাকে। দৈনিক জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে টিটু রায়কে গ্রেফতারের বিষয়টি বের করে আনা হয়। টিটু রংপুর সদর উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামের খগেন রায়ের ছেলে। টিটুর বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠে গত ২৮ অক্টোবর। এ নিয়ে গত ১০ নবেম্বর জুমার নামাজের পর পাগলাপীরে কয়েক হাজার মানুষ সমবেত হয়ে মানববন্ধন শেষে ওই গ্রামের হিন্দুবাড়িতে হামলা চালিয়ে কয়েকটি বাড়িঘরে আগুন দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হাবিবুর রহমান (৩০) নামে একজন মারা যান। আহত হয় আরও ১১ জন। তবে পুলিশের তদন্তে হিন্দুবাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জামায়াত শিবির জড়িত বলে প্রকাশ পায়। এটা আসলে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা। এজন্য এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। দেশে ষড়যন্ত্র চলছে। তার পরেও যেহেতু টিটু রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যেহেতু তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এ ঘটনায় গঙ্গাচড়া থানার এসআই রেজাউল করিম ও রংপুর কোতোয়ালি থানার এসআই রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছেন। এসব মামলায় দুই হাজারের বেশি লোককে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ গ্রেফতার করেছে ১২৪ জনকে। আর জেলা প্রশাসন গঠন করেছে একটি তদন্ত কমিটি। অবমাননাকর স্ট্যাটাস’র মূল লেখক টিটু নয়, রাকেশ ম-ল ॥ টিটু রায়কে গ্রেফতারের ঘটনায় হিন্দু কমিউনিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরাও টিটুর ফেসবুক দেখেছি। আমাদের মনে হয়েছে লেখাপড়া না জানা টিটুর এটি নয়। আর যে স্ট্যাটাস নিয়ে টিটু রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটি টিটুর নয়। রাকেশ ম-ল নামে এক ব্যক্তি ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর একটি স্ট্যাটাস বাংলাদেশী টিনেজার নামক একটি গ্রুপে শেয়ার দেয়। এই স্ট্যাটাসের স্ক্রীনশট নিয়ে টিটু গত ২৪ অক্টোবর তার ফেসবুক ওয়ানে শেয়ার করে। এরপর কয়েক দফায় টিটু স্ট্যাটাসের স্ক্রীনশট ১৯ বার তার ফেসবুক আইডিতে শেয়ার দেয়। তারা আরও জানায়, টিটুর (ফেসবুক আইডি গফ ঃরঃঁ) ফেসবুক আইডি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ফেসবুক আইডিটি খোলা হয়েছে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। যে পোস্ট নিয়ে এত ঘটনা, সেটি এই প্রোফাইল থেকে দেয়া হয়নি। সেই পোস্টের স্ক্রীনশট আপলোড করা হয়েছে মোঃ টিটু রায়ের ওয়াল থেকে। আসল পোস্টটি করা হয়েছে রাকেশ ম-ল নামের আইডি থেকে। একই স্ক্রীনশট অন্তত ১৯ বার টিটু তার ফেসবুকে শেয়ার দেয়। টিটুর প্রোফাইলের অধিকাংশ ছবি পর্নো এবং বাকিগুলোতে হিন্দুদের দেবদেবীর ছবি। টিটু তার ফেসবুকে নামের শুরুতে গফ যুক্ত করলেও বিভিন্ন সময়ে তার আপলোডকৃত ছবিতে নিজেকে শ্রী টিটু রায় হিসাবে পরিচিত করেছে। তবে টিটু তার ফেসবুক থেকে ছবি আপলোড করা ছাড়া কোন স্ট্যাটাস দেয়নি। এ থেকে বোঝা যায় টিটুর অক্ষরজ্ঞান খুবই কম। এদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ নীলফামারীর ডোমার উপজেলা শাখা। মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় উপজেলার রেলগেট বাজারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের ডোমার উপজেলা শাখার সভাপতি মনোরঞ্জন রায়ের সভাপতিত্বে এ সময় বক্তব্য রাখেন নীলফামারী জেলা শাখার সভাপতি গোড়াচাঁদ অধিকারী, ডোমার উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নিখিল চন্দ্র রায়, ডোমার উপজেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মফিজার রহমান দুলাল, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ডোমার উপজেলা শাখার সভাপতি রামনিবাস আগরওয়ালা, সাধারণ সম্পাদক উজ্জল কাঞ্জিলাল প্রমুখ। বক্তরা তারা বিনা দোষে টিটু রায়কে গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানিয়ে ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে টিটু রায়কে ছেড়ে দেয়া ও মূল দোষী ওই রাকেশ ম-লকে খুঁজে বের করার দাবি জানায়। বক্তরা অভিযোগ করে বলে দেখা যাবে ওই রাকেশ ম-ল নাম ব্যবহার করে ওই ব্যক্তি কোন জামায়াত শিবিরের এজেন্ট কিনা। কারণ সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত শিবির দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও টিটুর মায়ের বক্তব্য ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, শুনেছি টিটু লেখাপড়া জানেন না। তিনি নাকি আট-দশ বছর আগে থেকে বাড়ি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে থাকেন। পুলিশ ঘটনা তদন্ত করছে। টিটুর মা জিতেন বালা বলেন, আমার ছেলে কোনদিনও স্কুলে যায়নি। জীবিকার সন্ধানে দশ বছর আগে এলাকা ছাড়ে টিটু। তবে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তার। এদিকে পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে এই ফেসবুক আইডি টিটুর, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
×