ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

স্থাপনাশিল্পে একুশে আগস্টের নির্মমতার দৃশ্যকল্প

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২২ আগস্ট ২০১৭

স্থাপনাশিল্পে একুশে আগস্টের নির্মমতার দৃশ্যকল্প

মনোয়ার হোসেন ॥ নানা রঙের ছোট ছোট খ-াকার বাক্স দিয়ে গড়া যেন বিশাল এক দেয়াল। সেই দেয়ালের একপাশে সাদা রঙে ইংরেজী হরফে লেখা একুশে আগস্ট। সেই লেখার চারপাশে ছড়িয়ে আছে মানুষের খ-িত হাত, কোথাও বা পড়ে আছে অবিস্ফোরিত গ্রেনেড এবং অজস্র জুতা ও স্যান্ডেল। স্থাপনাটির অপর পাশটিতে শুধুই কালো বর্ণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শোকের আবহ। দশ হাজার বর্গফুটের বিশাল পরিসরে গড়া শিল্পকর্ম ভেতরে প্রবেশ করতেই কানে আসে বেদনার সুর। কখনও ভেসে বেড়ায় গগনবিদারী ভয়াবহ শব্দ। সেই শব্দের মাঝেই চোখে পড়ে সাদা রঙের একটি জিপ। চারপাশ থেকে জিপটি ঘিরে রচিত হয়েছে মানব প্রাচীর। আর ওই জিপটিতেই ছিলেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনা। সেই জিপটির নিচে বইছে রক্তের স্রোতধারা। একটু এগুলে নজরে আসে লাল সুতা ঝুলিয়ে প্রতীকীভাবে সৃষ্ট রক্তবন্যা। সেই রক্তবন্যার চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সমাবেশে যোগ দিয়ে হামলার শিকার হওয়া মানুষের অসংখ্য জুতা ও স্যান্ডেল। এরপর দেখা মেলে জজ মিয়া নামের নাটকের। রক্তে রাঙা কালো কোট পরিহিত এক ব্যক্তিকে দেখা যায় পুতুল নিয়ে খেলছে। কখনও সে টুকরো টুকরো করে ফেলছে পুতুলগুলোকে। পরের দৃশ্যপটে দেখা মেলে বোমায় দুই পা উড়ে যাওয়া নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানকে দুই পাশ থেকে আগলে রাখা দলের দুইকর্মীকে। আর এই আলোকচিত্রটির ঠিক সামনেই বোমা হামলায় আহত এক নারীকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ করে নিভে যায় তার প্রাণস্পন্দন। পরের দৃশ্যে সড়কে জমে থাকা রক্ত পরিষ্কার করতে দেখা যায় দুই ঝাড়ুদারকে। বিশাল স্থাপনাশিল্পটির একেবারে শেষ প্রান্তে দেখা মেলে রক্তে ভেজা সাদা কাপড়ে ঢাকা সারি সারি লাশ। বিয়ন্ড দ্য গ্রেনেড শিরোনামের বিশাল পরিসরের এই স্থাপনাশিল্প প্রদর্শনী দেখতে সোমবার অনেকেই হাজির হয়েছিলেন শিল্পকলা একাডেমির নন্দন মঞ্চের লাগোয়া কালো পিচঢালা সুপরিসর সড়কে। ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের নির্মমতা তুলে ধরা এই শিল্পটি নির্মাণ করেছেন কিউরেটর শিল্পী অভিজিৎ চৌধুরীর নেতৃতে ১৯ সদস্যের শিল্পীদল। নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকীর ভাবনায় গড়া প্রতীকী শিল্পকর্মে একুশে আগস্টের বেদনাবহ স্মৃতি। সেই বিভীষিকাময় সময়কে সাক্ষী করে ঠিক বিকেল ৫টা ২০ মিনিটেই এ প্রদর্শনীর সূচনা হয়। ২৩ আগস্ট পর্যন্তÍ চলমান এ প্রদর্শনী প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত প্রদর্শনীটি। সোমবার বিকেলে ‘বিয়ন্ড দ্য গ্রেনেড’ শীর্ষক স্থাপনা শিল্প প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। শিল্পকলা একাডেমির সচিব জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব মোঃ ইব্রাহীম হোসেন খান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক চিত্রশিল্পী মোঃ মনিরুজ্জামান ও কিউরেটর শিল্পী অভিজিৎ চৌধুরী। উদ্বোধনী বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, যেই চক্রটি পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করেছিল, সেই চক্রটি একুশে আগস্ট নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে। এই শিল্পকর্মটি এক অর্থে সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেই সেদিন বীভৎস গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর এই হামলার মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে চিরতরে শেষ করে দেয়া। এই অশুভ চক্রটিই একসাথে দেশের ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল, নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে, জন্ম দিয়েছে জঙ্গীবাদের। নানা সময়ে তারা নানা রূপে এসব জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে। এই অপশক্তিকে পরাজিত করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা অর্জন করা সম্ভব নয়। এই অশুভ শক্তি দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। তাই তাদের বিরুদ্ধে আপামর মানুষের ক্রোধ ও ঘৃণা অব্যাহত রাখতে হবে। একাডেমির নন্দনমঞ্চের পাশের উন্মুক্ত সড়কের দশ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে আলো ও শব্দের খেলার সঙ্গে নানা অনুষঙ্গে উদ্ভাসিত হয়েছে স্থাপনাশিল্পটি। সাতটি স্তরে গড়া হয়েছে বিশাল শিল্পকর্মটিতে নান্দনিকতায় তুলে ধরা হয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের বিভীষিকাময় ঘটনা। শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গড়া মানবপ্রাচীর, রক্তের স্রোতধারা, পদচিহ্ন-প্রতিবাদ, হাঁটুর নিচ থেকে পা উড়ে যাওয়া আইভি রহমানের নিশ্চল দৃষ্টি, জজ মিয়া নাটক, আলামত উপস্থাপন ও বিভিন্ন হাসপাতালে নিহত আর আহতদের আহাজারির পাশাপাশি ‘বিয়ন্ড দ্য গ্রেনেড’ নামের ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে বর্ণিত হয় সেদিনের ভয়াল চিত্র। এ স্থাপনাশিল্প প্রদর্শনীর ভাবনা ও পরিকল্পনা করেছেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। কিউরেটর হিসেবে আছেন শিল্পী অভিজিৎ চৌধুরী। আর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ জন তরুণ শিল্পীর সঙ্গে এই স্থাপনা শিল্প তৈরিতে অংশ করেছেন দুই জন অতিথি শিল্পী। শিল্পকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পীরা হলেন-মোঃ মনিরুজ্জামান, প্রদ্যোত কুমার দাস, এসএম এহ্সান, আশীষ আচার্য্য, কপিল চন্দ্র রায়, মাধবী সুলতানা, সুমন বিশ্বাস, স্বর্ণা আক্তার, ফারজানা ফেরদৌস, আকাশ চন্দ্র সরকার, শুভ্র তালুকদার, জাহিদুল ইসলাম, কৃষ্ণ কমল ভৌমিক, জয়ন্ত দেবনাথ, মোস্তফা জামিল অরণ্য, রাকিবুল আলম রাকিব ও নিশাত তানজিয়া।
×