ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ॥ দেশপ্রেমের অনন্ত উৎস

প্রকাশিত: ০৭:০২, ১৫ আগস্ট ২০১৭

বঙ্গবন্ধু ॥ দেশপ্রেমের অনন্ত উৎস

খবরের কাগজ তাঁর কারাগারে বন্দী জীবনের প্রতিদিনের সঙ্গী। খবরের কাগজের সংবাদ ধরে ধরে তিনি ছবি আঁকেন বাংলার এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তের। মানুষের কষ্ট হাহাকারে কখনও বেদনায় মন ভরে ওঠে তার। কিন্তু না, পরক্ষণেই কষ্টের গভীরতায় মুক্তির পথ খোঁজেন। তাঁর মন বলে মুক্তি আসবেই। বাংলার দুঃখী নিপীড়িত মানুষের দুঃখ মোচন হবেই। এই প্রত্যয়ী মানুষটি আমাদের প্রাণের মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব তথা বাংলাদেশের প্রতীক। বিশ্ব মানচিত্রে যে বাংলাদেশ, আমরা সকলে যার অধিবাসী সেই বাংলাদেশের প্রতীক তিনি। আজ জাতীয় শোক দিবসে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি তাঁর পরিবারের শাহাদাত বরণকারী সকল সদস্যসহ অন্যান্য সকলকে। যাকে হারানোর বেদনায় আজও শোকাতুর জাতি, তিনি জয় করেছিলেন দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর। মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা কিংবদন্তির মতো। কারাগারের রোজনামচাÑ যেখানে কলমের কালি দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লিখে রাখেন তার চিন্তা দর্শন। সরলতা, নিঃস্বার্থ ভালবাসা একই সঙ্গে উদ্দীপ্ত সাহসী মানুষের প্রতিবিম্ব তিনি তাঁর লেখনীতে। নিজ দেশ এবং একই সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতির গতি প্রকৃতিও প্রবলভাবে নাড়া দেয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, এর টানাপড়েন পাকিস্তান সরকারের মনোভাব এসব নিয়ে তার ভাবনাকে লিখে রাখেন রোজনামচায়। মনের কষ্টিপাথরে যাচাই করেন আশপাশের পরিস্থিতি এবং এর অনুষঙ্গ নানা ধরনের মানুষকে। বাইরের পরিস্থিতি জানার একমাত্র সঙ্গী পত্রিকা পড়েন এবং স্বপ্নের জাল বোনেন ভবিষ্যতের। কলমের কালিতে মেলে ধরেন নিজের মনকে। ঘটনার প্রেক্ষিতে কোনদিন লিখে রাখেন, ‘তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত’ (সূত্র : কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা : ৫৭-৫৮)। লেখেনÑ ‘হায়রে দেশ! হায়রে রাজনীতি! লুমুম্বার হত্যার পেছনে যারা ছিল তারাই আজ ফাঁসির কাষ্ঠে জীবন দিল। কঙ্গোর একজন প্রধানমন্ত্রীসহ চারজন সাবেক মন্ত্রীর প্রকাশ্য জায়গায় ফাঁসি দেয়া হয়েছে। সেখানে ২০ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন। কঙ্গোতে সাম্রাজ্যবাদের দাবা খেলা এখনও চলছে। জেনারেল মোবুতু যে পথ বেছে নিয়েছে সে পথ বড় কণ্টকাকীর্ণ, রক্তের পরিবর্তে রক্তই দিতে হয়। এ কথা ভুললে ভুল হবে। মতের বা পথের মিল না হতে পারে তার জন্য ষড়যন্ত্র করে বিরুদ্ধে দল বা মতের লোককে হত্যা করতে হবে এ বড় ভয়াবহ রাস্তা। এ পাপের ফল অনেককেই ভোগ করতে হয়েছে’ (সূত্র : কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা : ৫৯)। ৬ জুন ১৯৬৬-তে লিখে রাখেন ‘আজাদ যেটুকু সংবাদ পরিবেশন করিতেছে তাহাদিগকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না। আমি একা থাকি, আমার সঙ্গে কাহাকেও মিশতে দেয়া হয় না। একাকী সময় কাটানো যে কত কষ্টকর তাহা যাহারা ভুক্তভোগী নন তারা বুঝতে পারবেন না। আমার নিজের ওপর বিশ্বাস আছে, সহ্য করার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন। ভাবি শুধু আমার সহকর্মীদের কথা। এক একজনকে আলাদা আলাদা জেলে নিয়ে কিভাবে রেখেছে? ত্যাগ বৃথা যাবে না, যায় নাই কোনদিন। নিজে ভোগ নাও করতে পারি, দেখে যেতে নাও পারি তবে ভবিষ্যত বংশধর আজাদী ভোগ করতে পারবে। কারাগারের পাষাণ প্রাচীর আমাকেও পাষাণ করে তুলেছে। এ দেশের লাখ লাখ কোটি কোটি মা-বোনের দোয়া আছে আমাদের ওপর। জয়ী আমরা হবই। ত্যাগের মাধ্যমেই আদর্শের জয় হয়’ (সূত্র : কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা : ৬৮) এ অঞ্চলের মানুষের সরলতা দুর্বলতা তাঁর নখদর্পণে, নেতৃত্বের গুণ দিয়ে সবলতায় সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। উধরষু ঞবষবমৎধঢ়য জুন ৭, ১৯৬৬-তে সাংবাদিক জধষিব কহড়ী ‘ঊধংঃ চধশরংঃধহ’ং ঈধংব’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখান থেকে একটি অংশ বঙ্গবন্ধু তুলে রাখেন তাঁর রোজনামচায়। বঙ্গবন্ধু লেখেন ‘সাংবাদিক জধষিব কহড়ী একটি সত্যকথা লিখেছেন, ওভ জধধিষঢ়রহফর ঈড়হঃরহঁবং ঃড় নবষরাব ঃযধঃ ঃযব ৎবাড়ষঁঃরড়হধৎু ংঢ়রৎরঃ ড়ভ ইবহমধষ রং ংড়সবঃযরহম ড়ভ ধ লড়শব, ঃযব চধশরংঃধহর, ঈধঢ়রঃধষ পড়ঁষফ নব সধশরহম য়ঁরঃব ধ সরংঃধশবং. পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য আমারও মনে হয় ৬ দফা দাবি মেনে নেয়া উচিতÑ শাসক গোষ্ঠীর বিশেষ করে আইয়ুব খান ও তার অনুসারীদের। তা না হলে পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাঙালীর একটি গোঁ আছে, যে জিনিস একবার বুঝতে পারে তার জন্য হাসিমুখে মৃত্যুবরণও করতে পারে। পূর্ব বাংলার বাঙালী এটা বুঝতে পেরেছে যে এদের শোষণ করা হচ্ছে চারদিক দিয়ে। শুধু রাজনৈতিক দিক দিয়েই নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতি দিক দিয়াও (সূত্র : কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা : ৮৯)। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের পথে সুবিধাবাদী মানুষ সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা এবং ষড়যন্ত্রকে বঙ্গবন্ধু সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করেন। রোজনামচার অনেকটা অংশজুড়ে লিখে রাখেন ইতিহাস এবং জীবন ঘনিষ্ঠ সেসব কথা। কারাগারের আঙ্গিনায় এক টুকরো প্রকৃতির বর্ণনা ফুটে ওঠে তার রোজনামচায়। বঙ্গবন্ধু লেখেন ‘দুপুরের দিকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে শুরু করেছে। রৌদ্র একটু উঠবে বলে মনে হয়। বৃষ্টি আর ভাল লাগছে না। একটা উপকার হয়েছে আমার দুর্বার বাগানটার। ছোট মাঠটা সবুজ হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাসগুলো বাতাসের তালে তালে নাচতে থাকে। চমৎকার লাগে, যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না। বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলোকে আমার বড় ভয়, এগুলো না তুললে আসল গাছগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবীদÑ যারা সত্যিকার দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছকে আমার বড় ভয়। আমি লেগেই থাকি কুলাতে না পারলে আরও কয়েকজনকে ডেকে আনি। আজ বিকেলে অনেকগুলো তুললাম. (সূত্র : কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা : ১১৭)। বঙ্গবন্ধুর ওপর একের পর এক মামলা দিয়ে, বিনা বিচারে কারাগারে আটক রেখে পাকিস্তানী শাসকরা মনে করেছিল বাঙালীর আন্দোলনকে, তাদের বাঁচার দাবিকে নিঃশেষ করে ফেলা যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভাবছেন ইতিহাসের অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতার কথা। ভাবছেন তাঁর ওপর জুলুম-নির্যাতন, তাঁর দলের সহকর্মীদের বন্দী করে রেখে জনগণের আকাক্সক্ষাকে মেরে ফেলা যাবে না। মানুষ বঙ্গবন্ধুর তুলে ধরা মুক্ত আগামীর স্বপ্নে একমত। বঙ্গবন্ধু লিখে রাখেন, ‘দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা গেছে, কোন ব্যক্তি জনগণের জন্য এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য কোন প্রোগ্রাম দিয়েছে, যাহা নায্য দাবি বলে জনগণ মেনে নিয়েছে। অত্যাচার করে তাহা দমানো যায় না। যদি সেই ব্যক্তিকে হত্যাও করা যায় কিন্তু দাবি মরে না এবং সে দাবি আদায়ও হয়। যারা ইতিহাসের ছাত্র বা রাজনীতিবিদ, তারা ভাল করে জানেন। জেলের ভেতরে আমি মরে যেতে পারি তবে এ বিশ্বাস নিয়ে মরব। জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার একদিন আদায় করবে’ (সূত্র : কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা : ২৩৯)। মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা যেমন ছিল দিগন্ত বিস্তৃত, তেমনি এ দেশের মানুষও তাঁকে গভীর ভালবাসা দিয়ে গ্রহণ করেছিল আস্থায় বিশ্বাসে। দেশ হবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষম এক সোনার দেশ এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। সেই পথে আজ অগ্রসরমান দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণে অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। আজ বাংলাদেশ অনেক অংশেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে স্পর্শ করেছে। একই সঙ্গে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়তে হবে এমন একটি সমাজ যে সমাজ মানুষকে ভালবাসবে বঙ্গবন্ধুর মতো নিঃস্বার্থ ভালবাসা দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নে যে সমাজ সদা জাগ্রত। বঙ্গবন্ধু যথার্থই বলেছেন, ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই। লেখক : জাতীয় সংসদ সদস্য, লেখক, সমাজকর্মী
×