ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

এইচএসসি পরীক্ষায় ছেলের চেয়ে এগিয়ে মা

প্রকাশিত: ০৩:০৭, ২৩ জুলাই ২০১৭

এইচএসসি পরীক্ষায় ছেলের চেয়ে এগিয়ে মা

নিজস্ব সংবাদদাতা, নাটোর ॥ লেখাপড়ার যে কোনো বয়স নাই তা আবারও প্রমাণ করলেন নাটোরের মা শাহনাজ পারভিন। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় প্রায় ৪২বছর বয়সী ও দুই সন্তানের জননী শাহনাজ পারভিন একই সাথে ২০বছর বয়সী ছেলে রাকিব আমিন সবুজের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। তার এই সাফল্যে পরিবার, কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসী আনন্দিত। শাহনাজ পারভিন নাটোর মহিলা কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে ৪ দশমিক ৮৩ এবং ছেলে রাকিব নাটোর টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে ৩ দশমিক ৬৭ পেয়েছেন। ছেলের চেয়ে মায়ের ফলাফল ভালো হওয়ায় আনন্দের বন্যা বইছে শাহনাজ পারভিনের পরিবারে। মা-ছেলের পাশ করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শাহনাজ পারভিনের বাড়িতে ভিড় করছেন এলাকাবাসী। তবে উচ্চশিক্ষার জন্য তারা সরকারের সকল সহযোগিতা দাবি জানিয়েছেন। শাহনাজ পারভিনের পরিবার জানায়, ১৯৯২ সালে তেলকুপি এলাকার রুহুল আমীনের সাথে বিয়ে হয় তার। এরপর পরিবার নিয়ে শহরের নাটোর শহরের মল্লিকহাটি মধ্যপাড়ায় বসবাস করে আসছেন তিনি। বিয়ের পর ১৯৯৫ সালে স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন তিনি। এরপর অভাবের সংসারের কারণে আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি শাহনাজ পারভিন। এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জননী শাহনাজ স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নার্সের চাকরি করে সংসার পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু লেখাপড়ার গুরুত্ব বুঝে চল্লিশ বছর বয়সেই শাহনাজ পারভিন ২০১৫ সালে নাটোর মহিলা কলেজে কম্পিউটার বিষয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকেই ২০১৫-১৬ শিক্ষা বর্ষে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে ৪দশমিক ৮৩ পয়েন্ট নিয়ে উত্তীর্ণ হয় শাহনাজ পারভিন। মা শাহনাজ পারভিন বলেন, “১৯৯৫ সালে এসএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে পাশ করি। এরপর আর লেখা পড়া করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু যখন বুঝলাম লেখা-পাড়ার কোনো বয়স নাই তখন কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দেই। ভবিষৎতে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভালো কোনো কলেজে ভর্তি হতে চাই। কিন্তু অভাবের সংসারে সাংসারিক কাজ করে লেখাপড়া চালিয়ে নেয়া খুব কঠিনই। তাই সরকারি কোনো সহযোগিতা পেলে লেখাপড়া আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।” এদিকে, শাহনাজ পারভিনের ছেলে রাকিব আমিন সবুজ শহরের নাটোর টেকনিক্যাল এন্ড কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যাল বিষয় নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এবারের পরীক্ষার ফলাফলে মায়ের চেয়ে কম পয়েন্টে ৩দশমিক ৬৭ নিয়ে উত্তীর্ণ হয় সে। ছেলে রাকিব আমিন সবুজ বলেন, “আমার রেজাল্টের চেয়ে মায়ের রেজাল্ট ভালো হওয়ায় খুব খুশি হয়েছি। তাছাড়া মায়ের ফলাফল ভাল হওয়ার কারণে পরিবারের সবাই আনন্দিত।” শাহনাজ পারভিনের ভাই সাংবাদিক কাউছার আহম্মেদ বলেন, “পিতার অভাবের সংসারে অনেক আগেই বোনকে বিয়ে দিয়ে দিই। একদিন হঠাৎ করেই বোন বলেন, পুনারায় লেখাপড়া শুরু করবেন তিনি। এতে আমরাও সায় দেই। পরে নাটোর মহিলা কলেজে কম্পিউটার বিষয়ে ভর্তি করে দিই।” তিনি আরও বলেন, “বোন শাহনাজ স্থানীয় একটি ক্লিনিকে চাকরি করে সংসার পরিচালনা করেন। দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। কলেজের অধ্যক্ষকে বলে ফরম পুরনের টাকাসহ আনুসাঙ্গিক বিষয়ে টাকা কম দিয়েই পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন তিনি। তার অদম্য এই ইচ্ছা শক্তিকে আরও এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের সহযোগিতা চাই।” শাহনাজ পারভিনের স্বামী রুহুল আমীন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “তার স্ত্রী এবং ছেলে এক সাথে পাশ করায় পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। অভাবের সংসারেও যে তারা পাশ করেছে এই জন্য ভালো লাগছে। তার স্ত্রী একটি ক্লিনিকে চাকরি করার পর অবসর সময়ে পড়ালেখা করতেন। তাদের উচ্চ শিক্ষার জন্য আমার প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। তবে অভাবের সংসারে যদি সরকারি কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া গেলে তারা আরও ভালো ফলাফল করবে।” এবিষয়ে নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, “পড়াশোনার কোনো বয়স নাই। তার উদহারণ শাহনাজ বেগম এবং সবুজ। তাদের যে অদম্য মনোবল তারা আরও এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা করি। সরকারি কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন মনে করলে তাদের সকল সহযোগিতা করা হবে।” উল্লেখ্য, গত এসএসসি পরীক্ষায় বাগাতিপাড়ার গালিমপুর এলাকার মা মলি রানী কুন্ডু এবং ছেলে মৃন্ময় কুমার কুন্ডু এক সাথে এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। সে সময় নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন, স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদসহ অন্যরা অভিনন্দন জানিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য তাদের পাশে এসে দাঁড়ান।
×