ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জীবন লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়া শিখা

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২১ জুলাই ২০১৭

জীবন লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়া শিখা

সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রযাত্রা সামগ্রিক অর্থনীতির নিয়ামক। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা থেকে শুরু করে উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে দেশ সফলভাবে নিজেকে প্রমাণ করছে। সর্বসাধারণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ প্রবৃদ্ধিকে যেভাবে গতিশীল করে যাচ্ছে তা দেশের জন্য এক বিরাট শুভযোগ। সমাজের অর্ধাংশ নারীরাও এই অনবদ্য ভূমিকার অংশীদারিত্ব দাবি করতেই পারে। সমাজে নারীরা যদি সার্বিক কর্মকা-ে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হয় তাহলে ছোট্ট পারিবারিক গ-ি পেরিয়ে তা বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনকেও পিছিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশ এখনও কৃষিনির্ভর। সিংহভাগ জনগোষ্ঠী গ্রামে বাস করে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক অপসংস্কারের সঙ্গে আধুনিক কর্মযজ্ঞের দ্বন্দ্ব, বিরোধ, সংঘর্ষ থাকলেও দেশের মানুষ ক্রমান্বয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গতানুগতিক মূল্যবোধ, প্রাচীনপন্থী বিধি-বিধান, সমাজের মূল শেকড়ে গেড়ে বসা হরেক রকমের অব্যবস্থা চলার স্বচ্ছন্দ গতিকে নির্বিঘœ হতে দেয় না অনেক সময়। সেই অবিচ্ছিন্ন সামাজিক অভিশাপের সঙ্গে লড়াই করেও গ্রাম সমাজের নারীরা তাদের সুনির্দিষ্ট গন্তব্যকে বেছে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। বাগেরহাটের বৈঠপুর গ্রামের শিখা তেমনি একজন লড়াকু নারী যে তার পরিবারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে দুই সন্তানসহ সংসারের পুরো দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে বহন করে চলেছে। মানসিক ভারসাম্যহীন পিতা-মাতার সন্তান শিখা। পারিবারিক বন্ধনের শৈথিল্যে শিখাকে সামাজিক অব্যবস্থার বলি হতে হয়েছে। প্রথমত, বাল্যবিয়ের প্রকোপে পড়া শিখা শ্বশুরবাড়িতে আসে মাত্র ১৪ বছর বয়সে। মায়ের বাড়িতেও মেয়ে হিসেবে হরেকরকম বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাকে। যার হাত ধরে স্বামীর ঘরে পা রাখা সেই বিদ্যুতও ছিল কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী। তাই স্বামী হিসেবে কোন দায়বদ্ধতা সে কখনই পালন করতে পারেনি। শিখা জানায়, মাতৃস্নেহ থেকে শুরু করে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা সে পেয়েছে শাশুড়ির কাছ থেকে। এই শাশুড়ি মা-ই বটবৃক্ষের মতো তাকে ছায়া দিয়ে বর্তমান অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে। মাত্র ১৫ বছরে সে অকাল মাতৃত্বের অভিশাপেও জর্জরিত হয় যা বাল্যবিয়ের অনিবার্য পরিণতি। সুন্দর, ফুটফুটে এক পুত্র সন্তানের জননী হয়। স্বামী আগের মতোই ছন্নছাড়া, বেপরোয়া এবং সংসারবিমুখ। দিন মজুরি খাটে কিন্তু তেমন কোন আয়ের নিশ্চয়তা কখনই ছিল না। রাজমিস্ত্রির কাজ জানলেও সেটাকে নিজের আয়ত্তে আনা সম্ভবই হয়নি। মা, স্ত্রী এবং সন্তানের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাবে বিদ্যুতের সংসারে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। সেই দুরাবস্থাকে সামাল দিতে গিয়ে গৃহিণী শিখাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছে বিরূপ পরিস্থিতিতে মোকাবিলা করে। নিরক্ষর শিখা বেঁচে থাকার তাগিদে, স্বামী-সন্তানের মঙ্গলের জন্য হাতের কাছে যা সহজভাবে পেয়েছে তাকেই সম্বল করে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। ইতোমধ্যে কোলের শিশুটি বড় হতে থাকে। স্কুলে পড়ার বয়স হয়। নিজেদের আঙিনায় গড়ে ওঠা এক সমৃদ্ধ বিদ্যানিকেতনে লেখাপড়া করার সুযোগ পায়। শিক্ষাবিদ সামছুউদ্দিন আহমদের স্মরণে তাঁর কৃতী সন্তানরা (৮ জন) সমাজের অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের জন্য নিজস্ব অর্থায়নে ‘সামছুউদ্দিন নাহার ট্রাস্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা বিনা বেতনে শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। ট্রাস্টটি মূলত শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের আওতায় এই সব শিশু-কিশোরের শিক্ষা কার্যক্রমই পরিচালনা করছে না। পাশাপাশি তাদেরকে আধুনিক প্রযুক্তিতে সম্পৃক্তকরণের সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত করা হচ্ছে। সৌভাগ্যক্রমে শিখার ছেলে অপি এখানে শিক্ষা লাভের সুযোগ পাওয়ায় সে অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। শিখা সংসারের অর্থনৈতিক হালটা সামাল দিতে গিয়ে তাকে শাক-সবজি এবং ফলের বাগানসহ বিভিন্ন কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে হয়। হাঁস-মুরগি এবং ছাগল পালন করেও সে সংসারের অনেক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। প্রতিবছর কোরবানীর হাটে তার ২/১টা ছাগল বিক্রি হবেই। বাচ্চাদের সুষম খাদ্য তালিকায় মুরগি, ডিম এসব তাকে কখনও কিনতে হয় না। শাক-সবজি নিজের প্রয়োজন মিটিয়েও বাজারজাত করা সম্ভব হয়। ছোটখাটো একটি কলার বাগানও আছে। সেখানে সন্তানরা পুষ্টিকর কলা খাবার পরও বিক্রি করতে পারে অনেক। ইতোমধ্যে সে আরও একটি কন্যাসন্তানের মা হয়। ছেলেকে যেভাবে লেখাপড়া শিখিয়ে যাচ্ছে মেয়ের বেলায় তার মামান্যতম ফারাক লক্ষ্য করা যায়নি। তার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ছেলের মতো মেয়েটিকেও যোগ্য করে গড়ে তুলতে চায় যাতে সে স্বাবলম্বী হতে পারে। ছেলেটি কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করেছে ৪,২১ গ্রেড পেয়ে। এইচএসসির জন্য সময় নষ্ট না করে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি করিয়ে দেয় ছেলেকে। বিষয় হিসেবে নির্বাচন করা হয় কম্পিউটার বিজ্ঞানকে। শিখার লড়াই চলছে প্রতিনিয়তই। দুই সন্তান মানুষ হওয়া অবধি এই জীবনযুদ্ধ থামানো যাবে না। সম্প্রতি শাশুড়ির মৃত্যু তাকে অনেকটা অসহায় এবং দিশেহারা করলেও মানসিক শক্তির জোরে সে সামনের দিকেই তাকাচ্ছে যেখানে তার দুই সন্তানের ভবিষ্যত জড়িয়ে আছে। এখনও সেভাবে সচ্ছলতার মুখ না দেখলেও শিখা তার স্বামী-সংসারের জন্য যা যা করার দরকার সবকিছু করে যাচ্ছে। মেয়েকে নিয়ে তেমন ভাবছে না। কারণ নিজস্ব আলয়ে যে বিদ্যানিকেতন সেখান থেকেই অর্পি (মেয়ের নাম) এসএসসি পাস করে বেরিয়ে যাবে বলে শিখার বদ্ধমূল ধারণা। মেয়ে শুধু লেখাপড়াই শিখবে না তথ্যপ্রযুক্তিতেও পারদর্শী হওয়ার সুযোগ প্রতিষ্ঠানে থাকায় ভবিষ্যতে জীবন গড়ার সম্ভাবনা খুলে যাবে। শিখা তার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাক, সংসারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত হোক সর্বোপরি ছেলেমেয়ে দু’জনই দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাক। গ্রামের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষরা আজ দেশের সামগ্রিক সমৃদ্ধিতে জোরালো অবদান রাখছে। অর্ধাংশ নারী জাতিও সেই অনবদ্য ভূমিকায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে। শুধু একজন শিখার প্রজ্বলিত বিকিরণ নয় গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে এমন উদ্দীপ্ত শিখা আলো ছড়াতে থাকুক তবেই দেশের অব্যাহত এগিয়ে যাওয়া আরও গতিশীল হবে, প্রবৃদ্ধি সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছাবে। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×