ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জলি রহমান

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ক

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ২১ মে ২০১৭

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ক

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক বর্তমানে শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশ দুটির পারস্পরিক সহযোগিতার হাতও সুদৃঢ়। উভয় দেশ কমনওয়েলথ অব নেশনস, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন, উন্নয়নশীল ৮টি দেশ, জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করা প্রথম দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া অন্যতম। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম দেশ মালয়েশিয়া। বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বড় বাজারও দেশটি। ছয় লাখের বেশি বাংলাদেশী সেখানে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। প্রবাসী বাংলাদেশীরা হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ব্যাপক সফলতার পরিচয় দিচ্ছেন। সেকেন্ড হোম হিসেবে কয়েক হাজার এ্যাপার্টমেন্ট ও ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন বাংলাদেশী বিত্তশালীরা। শুধু হোটেল-রেস্টুরেন্টই নয়, জমি-জমা লিজ নিয়ে কৃষি খামার বা ডেভেলপমেন্ট ব্যবসা, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, হোম সার্ভিস, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, গাড়ি বেচাকেনা বা ভাড়ায় ব্যবসা, আইটি ব্যবসা, ফাস্ট ফুড, কফি সপসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করছেন অনেক বাংলাদেশী। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা গণমাধ্যমে বলেছেন, বর্তমান সময়ে দু’দেশের মধ্যকার বাণিজের পরিমাণ প্রায় আট বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২০৩ মিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালে ছিল মাত্র ৫৬ মিলিয়ন ডলার। যা থেকে দু’দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক আঁচ করা যায়। মালয়েশিয়ায় সম্ভাবনাময় ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন চেইন শপের ফ্যাঞ্চাইজি, ল্যাঙুয়েজ সেন্টার, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অফিস স্থাপন, সেলুন দোকান, কারওয়াশ, রেন্ট-এ কার, সাইবার ক্যাফে, মোবাইল লোড-ফটোকপির দোকান, টেইলারিং শপ, ফলের দোকান, প্রিন্টিং ব্যবসা ইত্যাদি। এ ছাড়াও কিছুটা বড় পরিসরে জমি লিজ নিয়ে সবজি আবাদ/কৃষি খামার, মৎস্য চাষের মতো ব্যবসা করা যায়। উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মালয়েশিয়া। ২০২০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে তারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া। উভয় দেশ তাই নিজেদের মধ্যে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রগুলো ক্রমশ সম্প্রসারিত করছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য ১৮টি অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে তুলেছে। যাতে অবকাঠামোসহ সব ধরনের সমস্যা দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে দেশের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আহ্বানও জানিয়েছেন। সম্প্রতি দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে মালয়েশিয়া। দেশটিতে অধিকহারে শ্রমিক পাঠানোসহ দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছে বাংলাদেশ। দেশ দুটির মধ্যকার এই সভায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল্লাহ হক ও মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে ছিলেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাধারণ সম্পাদক দাতো রামলান ইব্রাহিম। এই সভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ট্রেড গ্যাপ কমানোর জন্য মালয়েশিয়ায় ডিউটিমুক্ত ও কোটামুক্ত পণ্য গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। আর মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিরা মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া দুই দেশই পরস্পরের মধ্যে পর্যটন, সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহীদুল্লাহ হক বাংলাদেশ ও আসিয়ানের মধ্যকার সম্পর্কগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, আসিয়ানের ডায়লগ পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক ভাল ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়া দেশের ব-ইকোনমিতে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেক্সটাইল, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো ও কৃষিভিত্তিক শিল্পের মতো বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার বিনিয়োগে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন যে, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সকল ক্ষেত্রে অগ্রগতি জোরদারে উভয় দেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে নিয়মিত আলোচনায় বসতে সম্মত রয়েছেন। এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। বাংলাদেশ যে প্রবৃদ্ধির পথে হাটছে। সেখানে প্রধান অন্তরায় বিনিয়োগ সঙ্কোচন। তাই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়লে চলতি অর্থবছরেই ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। স্বল্প পুঁজিতে নিরাপত্তার মধ্যেই ব্যবসা করার পরিবেশ আছে মালয়েশিয়ায়। অবশ্য কেউ কেউ হয়রানির শিকারও হচ্ছেন। তবে এর সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। জানা যায়, প্রবাসী বাংলাদেশীরা হোটেল-রস্টুরেন্ট ব্যবসায় ব্যাপক সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক কোম্পানির অধীনে বিজনেস রেসিডেন্স ভিসা করলে পাঁচ বছর পরে মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব (পিআর) পাওয়া যায় সহজেই। ২ বছর পর পর ভিসা নবায়ন করে আজীবন বসবাস করা যায়। ৫ বছর পর স্থায়ী নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়। গত কয়েক বছরে অন্তত ৫ হাজার বাংলাদেশী স্থায়ী নাগরিকত্ব বা মালয়েশিয়ান চধংংঢ়ড়ৎঃ পেয়েছে বলেও জানা যায়। বিশ্বে প্রযুক্তি ও যান্ত্রিক বিকাশ ঘটছে দ্রুত। উন্নত বিশ্ব এবং চীনসহ অনেক উদীয়মান অর্থনীতিতেই শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তাই তারা জনশক্তির বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারকে প্রাধান্য দিচ্ছে। অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনশক্তিকে দক্ষ করে তুলতে না পারলে এক সময় দেশ বৈদেশিক শ্রমবাজার হারাবে। নিম্ন উৎপাদনশীল শ্রমশক্তিকে সময়োপযোগী শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও ইন্টার্নশিপ করিয়ে উচ্চ উৎপাদনশীল জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের যথাপযুক্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা।
×