ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সব হত্যাকাণ্ডেরই ধরন এক

মুক্তমনা মানুষ ও ব্লগার হত্যার নেপথ্যে মৌলবাদী ও জঙ্গী গোষ্ঠী তৎপর

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মুক্তমনা মানুষ ও ব্লগার হত্যার নেপথ্যে মৌলবাদী ও  জঙ্গী গোষ্ঠী তৎপর

গাফফার খান চৌধুরী ॥ য্দ্ধুাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের পরেই ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে। শাহবাগ আন্দোলনের পর হেফাজতে ইসলাম, দাওয়াতে ইসলাম, আনসার আল ইসলাম ও নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তৎপরতা বেড়ে যায়। এসব সংগঠনের কতিপয় নেতার উগ্র মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিছু বিপথগামী সদস্য ব্লগার হত্যায় জড়িয়ে পড়ে। তাদের হাতেই খুন হয় ৮ ব্লগার। সব হত্যাকা-ের ধরন একই। এসব সংগঠনের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধীদের যোগাযোগ দীর্ঘ দিনের। এখন পর্যন্ত খুন হওয়া ও হামলার শিকার হওয়া বিশিষ্ট মানুষ এবং হালে ব্লগার হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে এমন তথ্যই পেয়েছে গোয়েন্দারা। মুক্তমনা মানুষ ও ব্লগার হত্যার সূত্রপাত ॥ য্দ্ধুাপরাধী ও তাদের ছত্রছায়ায় থাকা উগ্র মৌলবাদী ও জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো স্বাধীনতার পর থেকেই মুক্তমনা মানুষদের হত্যার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে কবি শামসুর রাহমান (প্রয়াত), ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেখক হুমায়ুন আজাদকে হত্যাচেষ্টা হয়। পরবর্তীতে হুমায়ুন আজাদ ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট জামার্নিতে মারা যান। এছাড়া ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর অধ্যাপক ড. ইউনূসকে হত্যাচেষ্টা হয়। ২০০৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এসএ তাহেরকে হত্যা করা হয়। আগের হত্যাকা-গুলোর সঙ্গে হুজি জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন জড়িত। তদন্ত সংস্থার তথ্য ॥ তদন্তকারী সূত্রগুলো বলছে, ২০১৩ সালে ব্লগার হত্যা শুরু হয়। এর প্রধান কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় ব্লগার হত্যা। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকার পল্লবীতে ব্লগার প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন, উত্তরায় আফিস মহিউদ্দিনকে হত্যাচেষ্টা, বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দ্বীপ হত্যা, সাভারে আশরাফুল আলম হত্যা, গোপীবাগে বিশ্বত্রাণকর্তা দাবিদার কথিত পীর লুৎফুর রহমান ফারুকী ও ছেলেসহ ৬ জনকে জবাই করে হত্যা, তেজগাঁওয়ের পূর্ব রাজাবাজারে চ্যানেল আইয়ের শান্তির পথে ও কাফেলা নামক ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুুরুল ইসলাম ফারুকীকে জবাই করে হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শফিউল আলম হত্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে লেখক অভিজিত রায় হত্যা, রমনার হাতিরঝিল বেগুনবাড়ীতে ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা, সিলেটের সুবিদবাজারে অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা এবং খিলগাঁওয়ে নীলাদ্রি চ্যাটার্জী নিলয়কে হত্যা করা হয়। প্রতিটি হত্যাকা-ের ধরন একই। সবাইকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকা-ের মধ্যে রাজীব হত্যায় ৫ জন, দ্বীপ হত্যাকারী মেজবাহ, বাবু হত্যাকা-ে ১ জন ও অনন্ত হত্যায় ১ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। তারা নিষিদ্ধ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায় তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে জবানবন্দীতে উঠে এসেছে। এটি হত্যাকারীদের ইমানি দায়িত্ব ছিল। সেই ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই তারা হত্যাকা-গুলো ঘটিয়েছে। এর জন্য হত্যাকারীরা অনুতপ্ত নয়। ব্লগার হত্যার সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নানাভাবেই যোগসূত্র থাকার বিষয়ে তথ্য বেরিয়ে আসছে। আর হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে দাওয়া’তে ইসলামের কর্মকা-কে সমর্থন বা এ সংগঠনটির সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ হয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আনসার আল ইসলামসহ উগ্র মৌলবাদী ও বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে। নানা দিক থেকেই হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা ইমানি দাবির সঙ্গে হত্যাকা-ের যোগসূত্রতা মিলে যাচ্ছে। যেভাবে হেফাজতে ইসলাম আলোচনায় আসে ॥ ২০১০ সালে নারীনীতি ও ফতোয়া সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের রায় বাতিলের দাবির প্রেক্ষিতে সংগঠনটি জোরালোভাবে মাঠে নামে। এরপরই আলোচনায় আসতে থাকে হেফাজতে ইসলাম। এদিকে কালের আবর্তে সংগঠনটির আমির হন চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুস উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফী। গঠিত হয় কেন্দ্রীয় কমিটি। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়ও কমিটি গঠিত হয়। গণজাগরণ মঞ্চ ও হেফাজতে ইসলামের তৎপরতা ॥ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়। এর প্রেক্ষিতে ব্লগারদের নাস্তিক ও ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে মাঠ গরম করে বিএনপি ঘরানার একটি দৈনিক পত্রিকা। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী পালনের নামে হাজার হাজার পবিত্র কোরান শরীফ পুড়ানো, হাজারখানেক দোকানপাট, শত শত যানবাহন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, ট্রাফিক পুলিশসহ অফিস পুড়িয়ে দেয়া, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে আগুন দেয়া, শত শত গাছ কেটে ফেলাসহ মতিঝিল এলাকায় রণক্ষেত্র পরিণত করা হয়। তাতে মদদ দেয় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট (বর্তমানে ২০ দলীয় জোট)। সরকার পতনের ডাক দেয়া হয় হেফাজতের সমাবেশ থেকে। রাত আড়াইটা পর্যন্ত মতিঝিলে অবস্থান করে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা ইমানি দাবি না মানা পর্যন্ত অবস্থান নেয়ার ঘোষণা দেয়। তদন্তকারী সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণ ॥ ইমানি দাবির মধ্যে আল্লাহ, রাসুল (সা) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করা। কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা)-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা। ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার দাবিগুলো পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে কতিপয় উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তি কর্তৃক নেতিবাচকভাবে প্রচারিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে। আনসার আল ইসলাম ॥ তদন্তকারী সূত্রে জানা গেছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হওয়ার পর জঙ্গী সংগঠনটি আনসার আল ইসলাম আবার আনসার বাংলা নাম ধারণ করে। বিশেষ করে ব্লগার বাবু, অভিজিৎ, নিলয়, অনন্ত ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিউল ইসলাম হত্যার পর দায় আনসার আল ইসলাম ও আনসার বাংলা সংগঠনের নামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি আসে। মূলত হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা ইমানি দাবির মধ্যে ব্লগারদের বিষয়েও বলা হয়। সেই সূত্রধরেই ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আনসার আল ইসলামের সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্র, যারা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে জড়িত তারা জড়িয়ে পড়ে। জড়িতদের মধ্যে ছাত্র শিবিরের সমর্থক ও সক্রিয় কর্মীও রয়েছে। এছাড়া নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমুদ্দীন রাহমানীর বয়ানে উদ্ধুদ্ধ হয়ে কতিপয় কওমী মাদ্রাসার ছাত্র ব্লগার হত্যায় জড়িয়ে পড়ে। শুধু বয়ান নয়, কিছু কওমী মাদ্রাসার কতিপয় ছাত্র ও শিক্ষকের উগ্র মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েও ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটেছে। যেমনটি ঘটেছে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকা-ের বেলায়। হত্যায় জড়িত ৫ জনের মধ্যে ৪ জনই কওমী মাদ্রাসার ছাত্র। ঘটনাস্থল থেকে হাতেনাতে ধরা পড়ে দুই মাদ্রাসাছাত্র। তাদের একজন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার। হেফাজতে ইসলামের বক্তব্য ॥ সংগঠনটির ঢাকা মহানগর কমিটির মিডিয়া সেলের প্রধান আহলুল্লাহ ওয়াছেল জনকণ্ঠকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা ইমানি দাবির সঙ্গে ব্লগার হত্যার কোন যোগসূত্র নেই। তারা দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের হত্যাকা- দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের পথকে বাধাগ্রস্ত করছে। কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা দল অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এসব হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। হেফাজতের তরফ থেকে ব্লগারদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছিল। ইসলাম কোন শুধু খুন নয়, কোন প্রকার অনৈতিক কর্মকা-কেই সমর্থন করে না। গণতান্ত্রিক দেশে কারও আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার নেই। হেফাজতে ইসলাম কখনই তা সমর্থন করে না। ব্লগার হত্যার পর আনসার বাংলা বা আনসার আল ইসলাম নামের যেসব সংগঠনের নামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে তার জানা নেই। কোন বিশেষ গোষ্ঠীও হত্যার পর বেনামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিতে পারে। তবে দাওয়া’তে ইসলাম বা আনসার ইসলাম নামের কোন সংগঠনের সঙ্গে হেফাজতের ইসলামের কোন যোগাযোগ নেই।
×