
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির এক গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সামরিক শাসন বিরোধী গণআন্দোলনে ছাত্র সমাজ ছিল অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্র রাজনীতি কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব?
ছাত্র রাজনীতির আদর্শিক লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়, শিক্ষার মানোন্নয়ন, আবাসন সংকট নিরসন ও ফি হ্রাসের মতো বাস্তব সমস্যা সমাধানে সক্রিয় থাকা। বাস্তবে, অনেক সময় ছাত্র রাজনীতি সহিংসতা, চাঁদাবাজি, দলীয় প্রভাব, এবং টেন্ডারবাজির মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং রাজনীতির প্রতি তাদের আগ্রহ ও আস্থা হারিয়ে ফেলে।
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রাকিব বলেন,“শিক্ষার্থীরাই জাতির ভবিষ্যৎ, তাই রাজনীতি সম্পর্কে তাদের সচেতনতা থাকা জরুরি। গণতান্ত্রিক অধিকার অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক সংগঠনে যুক্ত হতে পারে। আমরা শিক্ষার্থীবান্ধব, সচেতন ও মূল্যবোধভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি জসিমউদ্দিন ভাই ও সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম রুবেল ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক ধারার রাজনীতি ছড়িয়ে দিতে নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি—যেমন ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ও কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট।
আমরা বিশ্বাস করি, সহিংসতা নয়—সচেতনতা, অংশগ্রহণ ও উন্নয়নের মাধ্যমেই প্রকৃত ছাত্ররাজনীতি গড়ে ওঠে। ইনশাআল্লাহ, এই ধারা আমরা বজায় রাখবো।”
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল রাজিব হোসেন দাবি করেন, তাদের সংগঠন সব সময় শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করে আসছে এবং ভবিষ্যতেও শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ছাত্র অধিকার পরিষদের সহ সভাপতি কাওছার আলী মনে করেন, “বর্তমানে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। একক দখলদারিত্বের পরিবর্তে এখন অনেক ছাত্র সংগঠন সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তবে এটি টেকসই করতে হলে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।”
অন্যদিকে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক লিখন ইসলাম মনে করেন, “বর্তমান ছাত্র রাজনীতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আতঙ্কের নাম। এটি এখন দলীয় নেতাদের আদেশ পালনে ব্যস্ত, শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নয়।” তার মতে, ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, প্রতিটি সফল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা, কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন এককভাবে নয়।
একই মত প্রকাশ করেন শিক্ষার্থী শামস উদ্দিন। তার অভিযোগ, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নিজেদের কর্মসূচিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে টেনে নিয়ে যায়, যা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘন করে। এছাড়াও সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী ফরহাদ পাটোয়ারী বলেন,“ছাত্ররাজনীতি হলো নেতৃত্ব গড়ার পথ। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদল শিক্ষার্থীদের মাঝে ইতিবাচক রাজনীতির ধারা গড়ে তুলতে কাজ করছে। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করছি, রাজনীতি মানেই শুধু মিছিল নয়—এটা শিক্ষার্থীবান্ধব, সচেতন ও গঠনমূলক কাজের ক্ষেত্রও হতে পারে।”
সব মতামত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির কিছু অংশ শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি হাতে নিলেও পুরো কাঠামো এখনো দলীয় প্রভাব, লেজুড়বৃত্তি থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি।
এ থেকে উত্তরণের পথ হতে পারে, নিয়মিত, অবাধ ও নিরপেক্ষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশ; শুধুমাত্র নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ছাত্র রাজনীতি; এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সহনশীলতা ও গঠনমূলক প্রতিযোগিতা।
শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় রাজনীতি অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তা যেন হয় আদর্শিক, গণতান্ত্রিক ও শিক্ষার্থীবান্ধব—এই প্রত্যাশাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
রিফাত