ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ জুন ২০২৪, ৩ আষাঢ় ১৪৩১

লন্ডনের চিঠি ॥ ভোটে ‘ভেটো’

সাগর রহমান

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ২৫ মে ২০২৪

লন্ডনের চিঠি ॥ ভোটে ‘ভেটো’

.

গত মে রাত সাড়ে দশটার সময় মনে পড়ল লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে ভোট দিতে ভুলে গেছি। নিজের এই অনাগরিকসুলভ কাজে নিজের ওপর অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছি। বিরক্ত হয়ে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করতে লাগলাম মনে মনে। আজ সারাদিন খুব সকাল থেকে স্কুলে ছিলাম। স্কুলের পরে অভিভাবক মিটিং ছিল কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু তারপরও অন্তত তিনটি ঘণ্টা ছিল, যে সময়ে গিয়ে অনায়াসে ভোট দিয়ে আসা যেত। অর্থাৎ, ব্যস্ত থাকার অজুহাত ধোপে টিকে না। দুষলে দুষতে হয় আমার রাজনীতিবিমুখতা কিংবা বরাবরের ভুলোমনাকে। কিন্তু আসলেই কি সব দোষ আমার? আবার চেষ্টা করলাম একটা অজুহাত দাঁড় করাতে।

এত বড় একটা নির্বাচন, অথচ কোথাও একটি পোস্টার, ফেস্টুন, মিছিল, মিটিং, গাড়িবহর, মোটর, শোভাযাত্রা, ব্যানার, ধরপাকড়, জনসভা, পথসভা, উঠোন বৈঠক, গোল-মিটিং, সংবর্ধনা সভা, হঠাৎ সভা, চা-বিস্কুট-পান-তামাক খাওয়ানো, মারামারি, হানাহানি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, স্টাফরুমে উত্তপ্ত আলোচনা, চা-দোকানের সরগরম, দেওয়াল লিখন, অমুক ভাইয়ের চরিত্রকে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা বানানোর চেষ্টা, প্রার্থীদের নরম-গরম শ্লীল-অশ্লীল, সভ্য-অসভ্য কথার চালাচালি, পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি, নির্বাচন কমিশনারের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান, কেন্দ্র দখল, রাতের অন্ধকারে ভোট প্রদান, জালভোট, জালভোট গণনা এবং এসবের সম্মিলনে একরত্তি গণ-উত্তেজনা গণ-হিস্টিরিয়া নেই-  কেমন নির্বাচন! মাসখানেক আগে বাসায় একটা চিঠি এসেছিল-  বাসায় আমরা যারা ভোটার আছি তাদের নাম-ধাম-সাকিন ঠিক আছে কি না, স্রেফ তার একটি পরীক্ষা হিসেবে। বলা হয়েছে, যদি সব ঠিক থাকে তবে আমাদের আর কিছু করার নেই। শুধু যথাসময়ে ভোট দিতে গেলেই চলবে।

আর না হলে একটি নাম্বারে বা অনলাইনের একটি লিংকে যোগাযোগ করে তথ্য হালনাগাদ করতে হবে। আমাদের জন্য তথ্যগুলো সব ঠিক ছিল। সুতরাং, চিঠি পড়ে রেখে দিলাম এবং সে চিঠি সপ্তাহ পরিক্রমায় আরও অনেক কাগজের ভিড়ে যথানিয়মে হারিয়ে গেছে। এদিকে একটি সাদামাটা চিঠি পাঠিয়েই কর্তৃপক্ষ হাত ধুয়ে ফেলেছে। এরপর আর কোনো খোঁজ-খবরই নেই। ভোটার হিসেবে আমাদের একটা মান-ইজ্জতও তো আছে, না কি! সুতরাং, যে নির্বাচনে আমাকে সম্মাানিত ভোটার হিসেবে কোনো ইজ্জত দেওয়া হয়নি সে নির্বাচনে নাইবা গেলাম। তারও ওপরে যে নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র খুঁজতে রীতিমতো- গুগলম্যাপের সাহায্য নেওয়া লাগে সেটা বোধহয় কর্তৃপক্ষ চুপিচুপিই সেরে ফেলতে চায়। সুতরাং, এমন একটি বালখিল্য অভিমানকে ঢাল হিসেবে দাঁড় করিয়ে সান্ত¡না পেতে চাইলাম, কিন্তু মন তাতে পুরো সায় দিল না। নাগরিক হিসেবে নাগরিক কর্তব্য করাটা দরকার ছিল। কাজটা ঠিক হয়নি আমার।

পরদিন পত্রিকায় জানলাম, নাহ, আমি একা নই। লন্ডনের প্রতি একশোজন নাগরিকের অন্তত ষাট ভাগ নাগরিক আমার মতো মেয়র নির্বাচনে ভোট দিতে যায়নি। মাত্র চল্লিশ দশমিক পাঁচ ভাগ মানুষ নির্বাচনে ভোট দিতে গেছে, যেটি গত দুই হাজার একুশ সালের মেয়র নির্বাচনের তুলনায় এক দশমিক পাঁচ ভাগ কম। কিন্তু পরিস্থিতি কেন? ব্রিটেনকে বলা হয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার। একটি অঞ্চলের অর্ধেকেরও কম মানুষ যদি ভোট দিতে যায় তবে সে ভোটে যিনি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন তিনি আসলে বড় জোর এক-চতুর্থাংশের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। একে চাইলে ব্যর্থ গণতন্ত্র বলা যায় নাকি? রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং রাজনীতি বিজ্ঞানে যেহেতু মূর্খ, তাই এসব বড় বড় বুলি কপচানো বাদ দিয়ে ঠিক করলাম, আমাদের স্টাফরুমে ব্রিটেনের মানুষের ভোটের প্রতি অনীহার আলোচনাটা একটু তুলে দেওয়া যাক। দেখি শিক্ষকরা নিয়ে কী ভাবছেন। স্টাফরুমে আমরা মোট চারজন।

ক্লাসের ফাঁকে বসে আছি। জাতিতে একজন ব্রিটিশ, একজন আফ্রিকান, একজন ইন্ডিয়ান, অন্যজন আমি। আফ্রিকান এবং ইন্ডিয়ান বললাম বটে, তবে এখান থেকে দুইজনের এদেশেই জন্ম। আমি কেবল বড় বেলায় এদেশে এসেছি, ইংরেজি বলার মাথার মধ্যে আগে ট্রান্সলেশান করে নিতে হয়। প্রথম সুযোগেই ভোটের আলোচনা তুলে ফেললাম। স্পষ্ট দেখলাম তিনজনই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন এবং প্রবল অবিশ্বাস নিয়ে জানলাম যে, তিনজনের একজনও ভোট দিতে যাননি। না, তারা কেউই আমার মতো নির্বাচনের কথাটা ভুলে যাননি কিংবা অন্য কোনো অজুহাতের কারণেও তাদের ওই অনাগরিকসুলভ আচরণ নয়।

তাদের না যাওয়ার কারণটা অনেকটাই সোজাসাপ্টা। ব্রিটিশ ভদ্রলোক প্রথম বাক্যেই বললেন, হু কেয়ারস? ভোট দিতে কেন যাননিÑ সেটা আরেকটু বিস্তারিত জানতে গেলে তিনি বেশ অট্টহাসি দিয়ে খোঁচা দিলেন, তোমার কি ধারণা আমার আর করার মতো আকর্ষণীয় কিছু নেই? ভদ্রলোক এখনো ত্রিশ পার হননি। আমাদের বাকি তিনজনের তুলনায় অনেকটাই বয়স কম। সুতরাং, তার থেকে আরও কিছু শোনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু উনি আলোচনায় অংশ নিতে অপারগতা বোঝালেন তার সামনে থাকা বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতা কাটাকুটিতে ডুবে গিয়ে। আফ্রিকান ভদ্রলোক বিজ্ঞের হাসি হাসতে হাসতে বললেন, কাকে ভোট  দেব? সব সমান। ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত সব সাধু। সব সমান করাপ্টেড। তারপর তিনি গত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কীর্তিকলাপ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক যে চতুর কৌশলে তার স্ত্রীর কর ফাঁকি দেওয়াটাকে এড়িয়ে গেছেন- সেসব, ইইউ ভোট নিয়ে তামাশা, এমন বিষয়-আশয় নিয়ে বেশ দীর্ঘ আলাপচারিতা চালিয়ে গেলেন। আর ইন্ডিয়ান ভদ্রমহিলা তার ব্যাগ থেকে একটি ছোট্ট কৌটা বের করে তার ভেতরে রাখা বাদাম জাতীয় কিছু আস্তে করে চিবুতে চিবুতে বললেন- স্যার, যারা নির্বাচিত হওয়ার তারা আগেই ঠিক করা থাকে। শুধু কেবল তোমার-আমার উপস্থিতির মাধ্যমে ওটিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা। এক সময় খুব আগ্রহ করে যেতাম। এখন আর যাই না। আমার হাজ ব্যান্ড অবশ্য যায়। তবে আমার কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর এত বড় অনাস্থা সূচক অভিযোগ, অথচ তিনি দেখলাম দিব্যি হাসিমুখে কথাটা বলে তার বাদাম চিবুনোতে মন দিলেন।

বলাবাহুল্য, এরপরে আর উৎসাহব্যঞ্জক আলোচনা চলে না। দমে গেলাম। আফ্রিকান ভদ্রলোকের বোধ হয় আমার মুখ দেখে মায়াই হলো। জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের দেশের নির্বাচনের কথা বলো। ওখানে মানুষের আগ্রহ আছে? বিপুল উৎসাহ নিয়ে বললাম, আগ্রহ আছে মানে! ভোটের চেয়ে বড় উৎসব আমাদের আর কিছু নেই। ওই সময় আমরা সব নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাই। জীবনযাপনের চব্বিশ ঘণ্টার একটি ঘণ্টাও আলোচনা ছাড়া আমরা থাকতে পারি না। এসব সাধারণ কথাবার্তা বলা শেষ করে বেশ গর্বের সঙ্গে যোগ করলামÑ সারাবিশ্বে মুহূর্তে আমাদের চেয়ে রাজনীতিমনস্ক আর কোনো জাতি আছে বলে মনে করি না। ব্রিটিশ ভদ্রলোক এতক্ষণ তার কাজ করে যাচ্ছিলেন। এবারে চকিতে আমার দিকে তাকালেন। অন্য দুইজনেরও দৃষ্টি আমার দিকে। আমি গা করলাম না যদিও, তবে কেন জানি মনে হলো তিনজনের চোখের দৃষ্টিই একটি আপ্তবাক্য স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছে আমাকে টু মেনি কুক, স্পয়েল দ্য ব্রুথ।

২৪ মে ২০২৪ 

[email protected]

×