ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া কানাডায় আসা বিপজ্জনক

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ২০ এপ্রিল ২০২৪

যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া কানাডায় আসা বিপজ্জনক

বিগত দু’এক বছরে এত বাংলাদেশী কানাডা এসেছেন

বিগত দু’এক বছরে এত বাংলাদেশী কানাডা এসেছেন, যা আগে কখনো লক্ষ্য করা যায়নি। তাদের সবাই বলা চলে টরন্টোর বাংলাদেশী অধ্যুষিত অঞ্চলে অবস্থান করছেন।  ইদানীং সেই অঞ্চলে গেলে মনেই হয় না যে, আমি কানাডার কোনো শহরে এসেছি। বরং মনে হবে সিলেটের বিয়ানীবাজার বা অন্য কোনো অঞ্চলে এসেছি।

সুদূরপ্রবাসে এত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশীকে  দেখে অবশ্য ভালোই লাগে। তবে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত যদি তারা সকলেই দীর্ঘ মেয়াদে থাকার মতো বৈধ স্ট্যাটাস নিয়ে এখানে আসতে পারতেন। উল্লেখ্য, স্ট্যাটাস নিয়ে আসা বলতে শুধু ইমিগ্রেশন বা স্টুডেন্ট হিসেবে আসাকেই বোঝায়। কেননা, এভাবে আসতে পারলে শুরু থেকেই বৈধ কাগজপত্র নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে থাকার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। অন্য কোনোভাবে, এমনকি ভিজিট ভিসা নিয়ে এলেও সেরকম সুযোগ পাওয়া যায় না। এভাবে আসাকে কখনই বৈধ স্ট্যাটাস পাওয়া বলার সুযোগ নেই। 
তাদের সবাই কোনোরকমে একটি ভিজিট ভিসা সংগ্রহ করে এখানে এসে রিফিউজি হিসেবে থাকার জন্য আবেদন করে বসে আছেন। কানাডা যেহেতু নীতিগতভাবে রিফিউজি এবং রাজনৈতিক আশ্রয়কে গুরুত্ব দেয়, তাই অনেকে এই ধরনের ভুক্তভোগী না হয়েও এ সুযোগ নিয়ে কানাডায় থাকার চেষ্টা করেন। একবার কানাডা এসে রিফিউজি বা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলে এবং সেই আবেদন গৃহীত হলে আবেদনকারীরা বৈধ কানাডিয়ানের মতোই বসবাস করতে পারেন।

আবেদনপত্র গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আবেদনকারীকে ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তারা বৈধভাবে কাজ করতে পারেন। তাদের কানাডিয়ানদের মতো বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধাও থাকে। সামর্থ্য থাকলে চাইলে বাড়ি-গাড়িও করতে পারেন। মোটকথা, একজন কানাডিয়ান যেভাবে জীবনযাপন করেন, তারাও সেভাবেই জীবনযাপন করতে পারবেন। পার্থক্য হচ্ছে, তারা কানাডার বাইরে যেতে পারবেন না বা তাদের নিকটাত্মীয় কানাডা আসার জন্য ভিসা পেতে সমস্যার সম্মুখীন হবেন, যতদিন তার আবেদন নিষ্পত্তি না হবে।   
অনেকেই ভাবতে পারেন, তাহলে সমস্যা কোথায়। সমস্যা হচ্ছে, চরম অনিশ্চয়তা। অতীত অভিজ্ঞতা বলে যে, এভাবে যারা রিজিউজি আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন তাদের অধিকাংশের আবেদনই বাতিল হয়। বাতিল হওয়া আবেদনকারীকে কানাডা থেকে ডিপোর্ট করা হয়। যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে বের করে দেওয়া। তখনো অনেকে আপিল করাসহ নানা ফন্দিফিকির করে বা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে আরও কয়েক বছর থেকে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

এভাবে কয়েক বছর থেকে এখানে একরকম স্থায়ী হয়ে গেছে এবং এখানকার অর্থনীতি ও কমিউনিটিতে অবদান রাখতে শুরু করেছে মর্মে যুক্তি দিয়ে আবেদনের সিদ্ধান্তটি পক্ষে আনার শেষ চেষ্টা করেন। এভাবে শেষ চেষ্টা করে সৌভাগ্যবান দু’একজন কানাডায় স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি পেলেও, অধিকাংশের কানাডা থেকে ফিরে যেতে হয়। এমনও দেখা গেছে যে, এভাবে পাঁচ থেকে সাত বছর বৃথা চেষ্টা করার পরও অনেকের আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়েছে এবং তাদের ফিরে যেতে হয়েছে।

এমনিতেই রিফিউজি বা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নিষ্পত্তি হতে প্রায় দুই থেকে তিন বছর সময় লাগে। তারপরও প্রাথমিক সিদ্ধান্ত বিপক্ষে গেলে সেটি নিয়ে চেষ্টা চলিয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত আরও তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লেগে যায়। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ থেকে সাত বছর। এই দীর্ঘ সময় থাকতে হয় ভয়ংকর এক অনিশ্চয়তার মধ্যে। 
এই অনিশ্চিত জীবন একদিকে যেমন এভাবে যিনি কানাডা এসেছেন তার নিজের জন্য, অন্যদিকে তার পরিবারের জন্যও বটে। নিজের জন্য এ কারণে যে, প্রতিটা দিন তাকে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়। এই কাজে সহযোগিতা করার জন্য নিয়োজিত আইনজীবী বা ইমিগ্রেশন কনসালটেন্টকে ভালো অঙ্কের ফির জোগান দিতে হয়। কানাডায় কাজের সুযোগও খুব যে ভালো, তা বলা যাবে না।

যদিও এরকম আবেদনকারীরা একটি  বৈধ ওয়ার্ক পারমিট পান, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বৈধ কানাডিয়ান স্ট্যাটাস ব্যতিরেকে শুধু নামমাত্র ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে মানসম্পন্ন কোনো কাজ জোগার করা সম্ভব হয় না। সামান্য যে কাজ পাওয়া যায়, উপার্জন দিয়ে নিজের খরচ মেটানোই কষ্টকর। পরিচিত দু’একজন দেশ থেকে কষ্টার্জিত অর্থ এনে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করে চলেছেন। তার ওপর দেশের বাইরে যাওয়ার কোনোরকম সুযোগ থাকে না।

দেশে বাবা-মা বা পরিবারের আপনজন কেউ অসুস্থ হলেও দেখতে যাওয়ার সুযোগ হয় না। পক্ষান্তরে, পরিবারকেও এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। কারণ, পরিবারের অন্যান্য সদস্য যারা সংগত কারণে তার সঙ্গে কানাডা আসতে পারেনি, তারা প্রতি মুহূর্ত অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে পার করেন। তারা জানে না কবে সেই আবেদনকারীর আবেদনের সন্তোষজনক সুরাহা হবে এবং তারপরই কানাডা আসার সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

এমনকি অনেকের বৈধভাবে কানাডায় আসার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এখানে আসার উদ্দেশ্যে ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন না। কেননা, পরিবারের প্রধান সদস্যের রিফিউজি বা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পরিবারের অন্য সদস্যদের ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমার পরিচিত দু’একজন ইতোমধ্যে এভাবে ভিসার জন্য আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।

বাংলাদেশ থেকে যারা এভাবে কানাডায় এসেছেন, তারা নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলার পাশাপাশি দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণœ করছেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে থেকে এসে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে সেই অনুমতি পাওয়ার প্রায় কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা, বাংলাদেশে এখন সেরকম রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে না। অনেকেই এরকম রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে ইতোমধ্যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন এবং সেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ মাধ্যমেও।

তাছাড়াও অনেক আবেদনকারী বানানো এবং মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে তাদের আবেদনপত্র সাজিয়ে থাকেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই ভুল প্রমাণ হয়ে থাকে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। ফলে, সব তথ্য সকলের জানা। এখন অসত্য তথ্য প্রদান করে সহজে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। একান্তই থাম্বরুলের কারণে বা বিচারকের সহানুভূতির কারণে দু’একজনের রিফিউজির আবেদন মঞ্জুর হলেও, অধিকাংশের আবেদন প্রমাণ করা কষ্টকর হয়।

এর ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে খারাপ ধারণা হয় এবং এখানকার ইমিগ্রেশন এবং ভিসা অফিস ভাবতে শুরু করে যে, বাংলাদেশের আবেদনকারীদের অধিকাংশ তথ্য সত্য নয়। এর ফলে আগামীতে যারা নিজ যোগ্যতায় এবং প্রয়োজনের তাগিদে কানাডায় আসতে চাইবেন, তাদেরও ভিসা পেতে অনেক সমস্যা হবে। ইতোমধ্যে এখানকার বাংলাদেশী মালিকানাধীন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, কানাডার ভিসা নিয়ে আসার পথে ট্রানজিট কান্ট্রি থেকে অনেককে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এসব খবর নিশ্চয়ই আগামীতে ভিসা প্রার্থীদের জন্য সুখকর হবে না। 
যারা এভাবে কানাডায় এসে রিফিউজির জন্য আবেদন করেছেন, তারা যে সব নিজের সিদ্ধান্তে করেছেন, তেমন নয়। একশ্রেণির প্রবাসী বাংলাদেশী আইনজীবী, ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, একটি সংঘবদ্ধ চক্র কানাডা এবং বাংলাদেশ থেকে কিছু মানুষকে ভুলভাবে বুঝিয়ে এ পথে ঠেলে দিয়েছে কিছু অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে। এভাবে কানাডায় আসার পরিণতি যে হতে পারে বিপজ্জনক, তা তাদের সেভাবে বোঝানোই হয়নি।

অনেকেই এরকম বিপদে পড়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বুদ্ধি পরামর্শের জন্য। এভাবে আসার কারণে যে আমাদের কোনোরকম বুদ্ধি পরামর্শ দেওয়ার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ভবিষ্যতে হতাশ করার মতো অবস্থার সৃষ্টি করাও সমীচীন নয়। অথচ কানাডায় বৈধ স্ট্যাটাস নিয়ে আসার সুযোগ তো একেবারে কম নেই। বর্তমানে স্কিল ওয়ার্কার ক্যাটাগরিতে আসার সুযোগ সীমিত করে ফেললেও অন্যান্য প্রভিন্সে প্রভিন্সিয়াল নমিনেশন ক্যাটাগরিতে এখনো আসার যথেষ্ট সুযোগ আছে এবং অনেকে আসছেনও।

তাছাড়াও কানাডা সরকার ছাত্র হিসেবে এখানে পড়তে আসার সুযোগ অবারিত করেছিল। ছাত্ররা এখানে পড়তে এসে যাতে নিজেরাই অধ্যয়নের খরচের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেরাই উপার্জন করতে পারে, সেজন্য ওয়ার্ক পারমিটও দিতে শুরু করেছিল। এমনকি বিবাহিত ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে সঙ্গী হিসেবে স্বামী বা স্ত্রী যাতে এখানে আসতে পারে, সেজন্য তাকে ওয়ার্ক পারমিটসহ দীর্ঘমেয়াদি ভিসা দিতে শুরু করেছিল।

এমনকি অধ্যয়ন শেষে যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারে, সেজন্য এক্সপ্রেস এন্ট্রি সিস্টেমও চালু করেছিল। সম্প্রতি অধিক সংখ্যক আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীর বিষয়ে কিছু বিরূপ সমালোচনা হওয়ায় সরকার কিছু সুযোগ-সুবিধা কমালেও, গ্র্যাজুয়েট অর্থাৎ মাস্টার্স পর্যায়ে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধাগুলো এখনো আগের মতোই আছে। 
এসব সহজ এবং বৈধ পথ থাকা সত্ত্বেও কিছু বাংলাদেশী কেন যে বাঁকাপথে কানাডায় আসার চেষ্টা করছে, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। এভাবে কানাডায় আসার চেষ্টা আর সাগর পারি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছার যে চেষ্টা, তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এভাবে কানাডায় আসার চেষ্টায় কতজন সফল হবেন, আর কতজন ব্যর্থ হবেন, তা কেউ জানে না। হাতেগোনা কয়েকজন সফল হলেও অধিকাংশই যে ব্যর্থ হবেন, তা সহজেই অনুমেয়।

কেননা, সম্প্রতি অধিকমাত্রায় আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রী এবং রিফিউজি চলে আসায় সরকার বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে এবং যথেষ্ট চাপের মধ্যে আছে। আবার সৌভাগ্যবান যে কয়জন থাকার বৈধ অনুমতি পাবেন, তারাও খুব যে ভালো কিছু করতে পারবেন সে সম্ভাবনাও খুব কম। কেননা, এভাবে রিফিউজি হয়ে এসে এখানে খুব বেশিদূর এগোনো যায় না।

গত শতাব্দীর আশি এবং নব্বইয়ের দশকে অনেক যোগ্য বাংলাদেশী এভাবে রিফিউজি হিসেবে কানাডায় এসে খুব বেশিকিছু করতে সক্ষম হননি। এ কারণেই যেনতেন উপায়ে কানাডায় আসার চিন্তা পরিহার করা উচিত। কেননা, এই ধরনের সিদ্ধান্ত হতে পারে বিপজ্জনক।

 
লেখক :  সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার
টরন্টো, কানাডা

[email protected]

×