ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে মৃত্যুর মিছিল

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৩৮, ২০ এপ্রিল ২০২৪

সড়কে মৃত্যুর মিছিল

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রতিদিন খবরের কাগজ দেখলে চোখে পড়ে সড়কে মৃত্যুর মিছিলের খবর, যা খুবই দুঃখজনক। সম্প্রতি বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক সড়কে ঝালকাঠি জেলার গাবখান সেতুতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সিমেন্টবোঝাই একটি ট্রাক পাঁচটি যানবাহনের ওপর উঠে পড়লে নারী-শিশুসহ ১৪ জন নিহত ও অন্তত ১৫ জন আহত হন। কেন এটা ঘটল।

হালকা যান চালানোর লাইসেন্সধারী আনাড়ি চালকের হাতে ভারী যান চালানোর দায়িত্ব দেওয়ায় এই বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ফরিদপুরে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত হন। সড়ক নিরাপত্তায় কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট, শত শত সুপারিশ, টাস্কফোর্স কেন কাজে আসছে না- এটা এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম তিন মাসের চেয়ে এ বছর দুর্ঘটনা ৪৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি ৩০ শতাংশ বেড়েছে। যা খুবই হতাশাজনক। এসব নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার। 
সড়ক মানে মৃত্যুর মিছিল। এই মৃত্যুর মিছিল নিয়ে জাতি খুবই উদ্বিগ্ন। সড়ক দুর্ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর ঈদ, পূজাসহ অন্যান্য সামাজিক উৎসব এলে সড়কে প্রাণহানির সংখ্যা অনেকগুণ বেড়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জীবনে এক আতঙ্ক। নিরাপদ সড়ক আমরা সবাই চাচ্ছি। কিন্তু পরিবহনের সঙ্গে যারা জড়িত তারা চাচ্ছে কিনা সন্দেহ আছে।

যদি চাইত তাহলে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা এত বৃদ্ধি পেত না। ঘর থেকে যাওয়ার উদ্দেশে বের হলে মনে হয় যে, আর বাড়ি ফিরব কিনা সন্দেহ। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর হাজার হাজার লোক নিহত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার খবর প্রতিদিন আমাদের আহত, ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে। দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন। সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এক জরিপে এই তথ্য প্রকাশ পায়।

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক, ক্ষত সৃষ্টি করে না। আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে ওই পরিবারকে। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয়। যার ক্ষতি কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়া যায় না। ফলে, ওই পরিবারের যে কি করুণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা বলে শেষ করা যায় না।

যারা পঙ্গু হয়ে যায়, তাদের পরিবারকে আজীবন তার বোঝা বহন করে চলতে হয়। গণমাধ্যমে জানতে পারি, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে গড়ে বাংলাদেশের জিডিপির শতকরা দেড় ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা পাঁচ হাজার কোটি টাকার সমান। বিগত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। আর দুর্ঘটনাজনিত কারণে মামলার সংখ্যা লাখের কাছাকাছি। কিন্তু বিচার খুব একটা কার্যকর হয়নি। 

সড়ক দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশ ঘটে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে। ১০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রতিযোগিতার মনোভাব ও যাত্রীর অসাবধানতা দায়ী। সড়কে ফিটনেসবিহীন অনেক গাড়ি চলমান, যা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনার অন্য কারণগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে- ট্রাফিক বিধি লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত মাল বোঝাই,  চালকদের ওভারটেকিং, বিরতিবিহীন লম্বা সময়কাল গাড়ি চালানো, অধিকাংশ গাড়ির চালকের বিআরটিএ কর্তৃক লাইসেন্স নেই, দূরপাল্লার সড়ক ও জনবহুল এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়কের বেহাল দশা।
এছাড়াও চালকের লাইসেন্স পাওয়ার সিস্টেমে দুর্বলতা এবং তাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। আইনের বাস্তব প্রয়োগ সড়কে তেমন কার্যকর হতে দেখা যায় না। চালকরা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আটক হওয়ার পর প্রভাবশালীদের চাপে জামিনে মুক্ত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনার বলি হচ্ছে মানুষ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।

লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা কম নয়, এটাও একটি কারণ সড়ক দুর্ঘটনার। বিআরটিএ কর্তৃক লাইসেন্সবিহীন কোনো চালক গাড়ি চালাতে পারবে না, এটা নিশ্চিত করতে পারলেই অনেক দুর্ঘটনা কমে যাবে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই। পুলিশ মাঝেমধ্যে গাড়ি থামিয়ে শুধু মাদক আছে কি না তা চেক করে থাকে। কিন্তু সড়কে বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করতে হবে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটিই কমে আসতে পারে।

সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে দেশের সকল বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা উচিত। এর পাশাপাশি পরিবহন মালিক, চালক, যাত্রী ও পথচারীদের সচেতন করার লক্ষ্যে লিফলেট, পোস্টার ও স্টিকার বিতরণ করতে হবে। সড়কে নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন এবং যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে। যাতে গাড়ি চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে ভয় পায়।

পরিবহনের সঙ্গে জড়িত সকলের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে মানুষের জীবনের মূল্য, পেশাগত দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। এছাড়াও দালাল বা তদবিরের মাধ্যমে ড্রাইভিংয়ের ভুয়া লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করতে হবে।  
দুর্ঘটনা ঘটলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে দোষীদের শাস্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। সমাজের যে শ্রেণির মানুষই দুর্ঘটনার শিকার হোক না কেন, প্রত্যেক মানুষের জীবন আমাদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোনো একটি দুর্ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইনের দুর্বলতার কারণে সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমছে না।

বরং সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শোচনীয় অবস্থা থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য সরকার আইনের সংশোধনপূর্বক তা প্রয়োগের মাধ্যমে সড়কে নিরাপদ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। এছাড়াও পুলিশকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালকরাই যে দায়ী তা নয়, রাস্তার পাশের দোকান, হাটবাজার ও স্কুল প্রতিষ্ঠা, অনেক সময় যাত্রী, পথচারী, শিশুদের দৌড়ে রাস্তা পার হওয়াও দায়ী। 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

×