ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মশার ভয়ংকর হয়ে ওঠার রহস্য

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ২৮ মার্চ ২০২৪

মশার ভয়ংকর হয়ে ওঠার রহস্য

মশার ঘনত্ব ও দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে

মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর ভাইরাস ও প্যাথোজেন বহনকারী কিউলেক্স ও এডিস মশার ঘনত্ব ও দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে ভয়ংকর রোগ ও অসস্তিকর পরিস্থিতি। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গসহ সবাই শঙ্কিত। এক্ষেত্রে পলিসিগত কাঠামোর বিনির্মাণ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আগে পরিষ্কারভাবে বুঝে নিতে হবে যে, বর্তমানে কিউলেক্স ও এডিস প্রজাতির মশাই এই নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করে চলছে।

তাহলে এডিস মশার ইকোলোজি ও কিউলেক্স মশার ইকোলোজি অর্থাৎ এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র এবং কিউলেক্স মশার প্রজনন ও বেড়ে ওঠার পরিবেশের ভিন্নতা কেমন। তাদের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার পরিবেশের ওপর নির্ভর করে নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রয়োগ করতে হবে। এডিস মশা নিয়ে এতবেশি আলোচনা হয়েছে যে, এই মশার ডিমপাড়া হতে শুরু করে ডিমের স্থায়িত্ব ও ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়ে পিউপাতে পরিণত হতে কত সময়ের প্রয়োজন ও এতে কি ধরনের পরিবেশের প্রযোজন হয়, তা প্রায় সবারই জানা।

তারপরও বলছি, এই মশা ছায়াযুক্ত স্থির পানিতে যে কোনো সূক্ষ্ম বাহনের ওপর ডিম পারে। পানি অবশ্যই স্বচ্ছ পরিষ্কার কিন্তু ব্যকটেরিয়াযুক্ত হতে হবে। একইভাবে আর্টিফিসিয়াল পানিযুক্ত কনটেনার, নারিকেল মালাই, টায়ার, ফুলের টব, নির্মাণাধীন বাড়ির নিচে জমানো পানি, গ্যারেজে গাড়ি ধোয়ার স্থানে জমে থাকা পানি, গাছের ছিদ্রের মধ্যে পাতার গোড়ায় (লিফ এক্সেলে) ব্যাম্বো স্ট্রাম্প প্রভৃতি স্থানে এডিস মশা বংশ বিস্তার করতে পারে। 
অপরদিকে কিউলেক্স মশা জৈবিকভাবেই দূষিত পানিতে প্রজনন ও বংশবিস্তার ঘটায়। এই মশা সাধারণত ঘোড়া ও গোশালায় মনের আনন্দে প্রজনন ঘটায় ও জীবন অতিবাহিত করে। একইভাবে খোলা পায়খানা, সেপটিক ট্যাংক, ফ্লাডেড পিট ল্যাট্রিন, বন্ধ নালা, ম্যানহোল দূষিত লেক প্রভৃতি জায়গা এই মশার উত্তম প্রজনন স্থান। পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, এডিস ও কিউলেক্স মশার উপদ্রব হতে পরিত্রাণের জন্য তাদের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার উৎস বিনষ্ট করতে হবে।
চিহ্নিত স্থানগুলো পরিপূর্ণভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও শুষ্ক রাখতে হবে। রাখতে হবে দূষণমুক্ত। এডিস মশা যেমন পরিচ্ছন্ন পরিবেশের জমানো পানিতে  পাওয়া যায়, উল্টোদিকে কিউলেক্স দূষিত পরিবেশের জমানো পানিতে পাওয়া যায়। এখন যদি ঢাকা শহরের কথাই চিন্তা করি, তাহলে বাস্তবতা কি দেখতে পাই। যে সকল পাবলিক প্লেসে গণশৌচাগার আছে, সেখানে পরিবেশ কতটা কিউলেক্সের প্রজননের জন্য উপযোগী।

যে ড্রেন ও ডিচেসগুলো ব্লক হয়ে পরিত্যক্ত ময়লা আবর্জনার ভাগারে পরিণত হয়েছে, সেখানে যে শুধু কিউলেক্স মশাই তৈরি  হচ্ছে তা নয়, জন্ম নিচ্ছে অন্যান্য প্যাথোজেন ও রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু। যে লেকগুলোতে বহুদিন বন্ধ পানি রয়েছে এবং সাধারণ জনগণ নির্দ্বিধায় ময়লা-আর্বজনা ফেলছে, সেই লেকগুলো কিউলেক্স মশা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। যেমন ভাবে বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত গাড়ি, রেলের পরিত্যক্ত বগি, পরিত্যক্ত ও নির্মাণাধীন ইমারত পরিণত হয়েছে এডিস মশার কারখানায়। এই প্রজনন ক্ষেত্রগুলো দিন দিন বাড়ছেই।
এবার আসি মশক দমন পদ্ধতিতে। মশার টেকসই দমন পদ্ধতির নাম হলো আইভিএম বা ইন্টিগ্রেটেড ভেকটর ম্যানেজমেন্ট বা সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। যে পদ্ধতির মধ্যে সকল দমন পদ্ধতির একটি সমন্বয় থাকবে। অর্থাৎ শুধুই রাসায়নিক পদ্ধতি কখনই টেকসই পদ্ধতি হতে পারে না। রাসায়নিক পদ্ধতি অনেক পদ্ধতির মধ্যে একটি যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি হতে পারে।

কিন্তু একমাত্র পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করলে তা হবে অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমরা মশা দমন পদ্ধতি হিসাবে শুধুই কীটনাশক (লার্ভিসাইড ও এডালটিসাইড) প্রয়োগেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। যার ফলে, মশার দমন না হয়ে বৃদ্ধি হচ্ছে। যার প্রতিফলন ২০২৩ সালের প্রি-মুনসন ও মুনসন-এ সি.ডি.সি কর্তৃক পরিচালিত লার্ভার বি আই এবং এইচ আই-এর ঘনত্ব হতে সুস্পষ্ট। আর এই লার্ভিসাইড ও এডালটিসাইড শুধুই এডিস মশা দমনের জন্যই করা হচ্ছে। কিউলেক্স মশাকে তেমন গুরুত্ব না দেওয়ায় তার আধিক্যে আমরা এখন দিশেহারা। বিষয়টি নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করলে ভয়াবহ ফল লক্ষণীয়।

কীটনাশক প্রয়োগ যদি যথাযথ ডোজ অর্থাৎ এলডি-৫০ বা এল সি ৫০-এর সঠিক মান পরিমাপ না করেই প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তা কখনই  কাক্সিক্ষত ফল দেবে না, বরং বিপরীত ফল প্রদান করবে। মূল্যমানগুলো নির্ধারণ ও নির্দিষ্টকরণ নির্ভর করে কীটনাশক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তদারকির ওপর, প্রয়োগকারীর অসাবধনতা বা অজ্ঞতার কারণে, প্রয়োগে ব্যবহৃত মেশিনের সঠিক ক্যালিব্রেশনের অভাবে, প্রয়োগের সঠিক সময় নির্ধারণের অভাবে, প্রয়োগের সঠিক স্থানের অভাবে ও প্রয়োগের গতি প্রকৃতির ওপর আর সর্বোপরি জলবায়ুর পরিবর্তন। এখন এই লিথাল ডোজ যদি ওপরের কারণগুলোর জন্য সাব-লেথাল ডোজে পরিণত হয়, তাহলে যে ভয়ংকর পরিণতির সৃষ্টি হবে তা হলো- 
ক্সমশা প্রতিরোধী হয়ে উঠবে এবং ওই কীটনাশকে আর মশা মারা যাবে না। 
ক্সমশার শরীরবৃত্তীয় নানা রকম পরিবর্তন  সাধিত হবে। যেমনÑ যে মশাগুলো সাধারণত এন্ডোফিলিক আচরণের ছিল, তারা এক্সোফিলিক  হয়ে উঠবে। অর্থাৎ যারা রক্তপান করে আবাসভবনের ভেতরে বিশ্রাম করত, তারা কীটনাশক প্রয়োগের সময়ের বিপরীতে আবাসভবনের বাইরে অবস্থান নেবে, আবার প্রয়োজনে আবাসভবনের ভেতরে অবস্থান নেবে। তাদের ডিম পাড়ার স্থান ও সময় দুটোই পরিবর্তন করবে। তাদের মিলিত হওয়ার সময় ও স্থানও পরিবর্তন করবে। 
ক্সমশার শরীরে কীটনাশকের সাব-লেথাল ডোজ ডি টক্সিফায়িং এনজাইমের সৃষ্টি করে কীটনাশকের বিষক্রিয়া নষ্ট করে দেবে। এই মশার পরবর্তী বংশধর আর ওই কীটনাশকের দ্বারা কোনোভাবেই মারা যাবে না। 
ক্সওই সাব লেথাল ডোজে মশা মারা না গেলেও যে প্রাকৃতিক শত্রু আছে, তারা মারা গিয়ে মশা শত্রু মুক্ত হয়ে যাবে। যাতে করে মশার ঘনত্ব দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পাবে।
ক্সমশার শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের ফলে মশার মধ্যে বেড়ে ওঠা ভাইরাসও তারা চারিত্রিক পরিবর্তন বা জিন মিউটেশন ঘটিয়ে স্বচ্ছন্দে পরিবেশে শক্তি সঞ্চয় দ্বিগুণ করে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দেবে।
জলবায়ুর পরিবর্তনও মশা এবং ভাইরাসের দি¦গুণ উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। যার ফলে, এই ধরনের করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বড়ই পরিতাপের বিষয় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে দেশে কোনো উন্নত গবেষণাগার ও গবেষক তৈরির বিষয়টি আমরা বেমালুম ভুলে আছি।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম বরাবরই এই ধরনের জাতীয় জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ইস্যুগুলো নিয়ে সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। তাই জনস্বাস্থ্যবিষয়ক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যথাযর্থ কর্তৃপক্ষ আমলে নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে নিপসমকে ‘সেন্টার ফর এক্সেলেন্সি অব এলিমিনেশন অব ভেকটর বর্ন ডিজিজেস’ ঘোষণা করার জোর প্রস্তাব করছি।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কীটতত্ত্ব বিভাগ 
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী

×