ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

মাহে রমজানে মহানবী (সা.) ও জিব্রাইল (আ.)-এর কথোপকথন

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ২৮ মার্চ ২০২৪

মাহে রমজানে মহানবী (সা.) ও জিব্রাইল (আ.)-এর কথোপকথন

প্রসঙ্গ ইসলাম

ফেরেশতা জাতির ওপর বিশ্বাস রাখা ইমানের একটি আবশ্যকীয় অংশ। নূরের তৈরি অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ফেরেশতা জাতি মহান আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টির অপার নিদর্শন। তাদের মধ্যে আল্লাহর নৈকট্য ও দায়িত্বপূর্ণ পদ বিবেচনায় মর্যাদার তারতম্য রয়েছে। প্রধান চারজন ফেরেশতার মধ্যে হজরত জিবরাঈল (আ.) এর নাম সবার শীর্ষে। জিবরাঈল তার প্রসিদ্ধ নাম হলেও পবিত্র কুরআনে আরও অনেক সম্মানিত উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে তাকে।

যেমন সুরা শুয়ারার ১৯৫ নম্বর আয়াতে তাকে ‘রুহুল আমিন’ অর্থাৎ সৎ-আত্মা, সুরা মারিয়ামের ১৯ নম্বর আয়াতে ‘রসুলু রব্বিকি’ তথা তোমার রবের বার্তাবাহক উপাধিতে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নবী (সা.) একবার জিবরাঈল (আ.)-কে উদ্দেশ করে বললেন, ভাই জিবরাঈল! আপনি কি আপনার রব মহান আল্লাহকে কখনো দেখেছেন? এ কথা শুনতেই হজরত জিবরাঈল (আ.) চমকে উঠলেন। বললেন, আমি এবং মহান আল্লাহর মাঝে ৭০টি নূরের পর্দা রয়েছে। আমি যদি এর সামান্য কাছেও যাই, পুড়ে ভস্ম হয়ে যাব। (মু’জামুল আওসাত, হাদিস : ৬৪০৭) ।
ছোট্ট বয়সে যখন নবীজি (সা.) মা হালিমা সাদিয়া (রা.)-এর ঘরের সদস্য হয়ে বনি সাদ গোত্রে অবস্থানরত ছিলেন, তখন জিবরাঈল (আ.) বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করে জমজমের পানি দিয়ে তাঁর পবিত্র আত্মা ধৌত করেন। এই ছিল জিবরাঈল (আ.)-এর সঙ্গে নবীজি (সা.)-এর প্রথম সাক্ষাৎ। তারপর জাবালে নূর পর্বতের হেরা গুহায় অতর্কিত দর্শন। রজনিটি ছিল ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ রমজান পবিত্র শবে কদরের প্রহর।

মহানবী আল্লাহ তায়ালার জিকিরে এবং বিশ^বাসীর ফিকিরে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল (আ.) হাজির হয়ে তিনবার বুকের মাঝে তাঁকে সজোরে জাপটে ধরেন। বিকট আকৃতির অবয়ব আর এমন আচমকা পরিস্থিতির জন্য নবীজি  মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি কিছুটা হকচকিত হয়ে পড়লেন, তাঁর শরীরে জ্বর চলে এলো। মা খাদিজা পরদিন তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সা.) মহান প্রভুর সান্নিধ্য অর্জনে মিরাজের সফরে গেলে জিবরাঈল (আ.) ছিলেন তাঁর একান্ত সফরসঙ্গী। বদরের যুদ্ধের সময়ও নবীজির পাশাপাশি থেকে যুদ্ধের সঙ্গী ছিলেন এ মহান ফেরেশতা। মাহে রমজানে তাঁরা দুজন একে অপরকে কুরআন খতম করে শোনাতেন। এ ছাড়া পবিত্র কুরআন এবং ওহি নাজিলের স্বার্থে অজস্রবার নবীজির কাছে তিনি আসা-যাওয়া করেছেন। নবীজির বিষণœতার সময় সান্ত¡না দানকারী এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শদাতা হিসেবে তার বিশেষ নামডাক রয়েছে।
পবিত্র কুরআনে হজরত জিবরাঈল (আ.)-এর কিছু  বৈশিষ্ট্যের বিবরণ রয়েছে। সুরা নাজমের পঞ্চম আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, তাঁকে (প্রিয় নবীজিকে) কুরআন শিখিয়েছে এক শক্তিশালী ফেরেশতা অর্থাৎ জিবরাঈল (আ.)। জিবরাঈল ছিলেন প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী। এ বিষয়টি কুরআনে কয়েক জায়গায় উদ্ধৃত হয়েছে। সর্বোপরি লুত (আ.)-এর জাতিকে ডানায় করে আসমানে উঠিয়ে সেখান  থেকে উল্টিয়ে দেওয়ার ঘটনা এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

এ বরকতময় ফেরেশতা মহান আল্লাহর বড় নিদর্শনাবলির অন্যতম। সুরা নাজমের ১৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, যখন তিনি অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) তাঁর রবের বড় নিদর্শনাবলি থেকে অন্যতম নিদর্শন দেখলেন। আর তা ছিল জিবরাঈল (আ.)-এর প্রকৃত অবস্থার দর্শন। 
পবিত্র কুরআনে ইমানদারদের সঙ্গে এই মহান  ফেরেশতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আলোচনা রয়েছে। যেমনÑ কদরের রাতে জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বাহিনী নিয়ে জমিনে অবতরণ করেন এবং ইবাদতকারীদের সঙ্গে সালাম ও মোসাফাহা করেন। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, যারা জিবরাঈল (আ.)-এর শত্রু, তারা মহান আল্লাহর শত্রু। এ ছাড়া হাদিসে এসেছে, যখন মহান আল্লাহ কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরাঈল (আ.)-কে ডেকে বলেন, ‘আমি অমুক বান্দাকে ভালোবাসি, তুমিও তাকে ভালোবাসো এবং জমিনের বুকে ঘোষণা করে দাও যেন সব মাখলুক তাকে ভালোবাসে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৪০)।

পবিত্র কুরআনে জিবরাঈল (আ.)-এর বৈশিষ্ট্যের বর্ণনায় এসেছে যে তিনি ‘মর্ত’ অর্থাৎ আসমানবাসীদের কাছে একজন অনুসরণীয় ও মান্যবর ব্যক্তিত্ব। অর্থাৎ সবাই তাকে মেনে চলে। একই আয়াতের  শেষাংশে তার অপর একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ এসেছে যে, তিনি নিতান্তই বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন। কেনই বা হবেন না, ওহি তথা পবিত্র কুরআন ও মহান আল্লাহর প্রত্যাদেশগুলো নবীদের কাছে অবতীর্ণ করার জন্য মহান আল্লাহ তো তাকেই নির্বাচন করেছিলেন।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) জিবরাইল (আ.) কে চারবার আসল আকৃতিতে দেখেছেন। প্রথমবার তিনি যখন হেরা গুহায় অবস্থান করছিলেন, তিনি হজরত জিবরাঈল (আ.) তার আসল আকৃতি দেখানোর অনুরোধ করেন। হুজুরের অনুরোধের প্রেক্ষিতে তিনি তার আসল আকৃতি ধারণ করে  দেখান। দ্বিতীয়বার মেরাজ শরীফের ঘটনায় তাকে আসল আকৃতিতে দেখেছেন অর্থাৎ ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ নামক সেই ঊর্ধ্ব জগতে।

তৃতীয়বার মক্কায় ‘আজয়াদ’ নামক স্থানে  দেখেছেন। এই ঘটনা নবুয়াত প্রাপ্তির নিকটবর্তী সময়ে সংঘটিত হয়েছিল। চতুর্থবার হুজুরের শ্রদ্বেয় চাচা হজরত আবু হামজা (রা.) যখন অনুরোধ করেছিলেন যে, আমি হজরত জিবরাঈল (আ.) কে তার আসল আকৃতি সহকারে দেখতে চাই। তখন প্রথম, হুজুর (সা.) তাকে নিষেধ করলেন  যে, আপনি তাকে দেখতে পারবেন না। কিন্তু তিনি আবারও আরজ করলেন যে, আপনি অনুগ্রহ করে দেখিয়ে দিন। তখন হুজুর (সা.) বললেন : আপনি বসুন।

হজরত হামজা (রা.) তার পাশে বসে গেলেন। এ সময়ে হজরত জিবরাঈল (আ.) অবতরণ করেন। হুজুর (সা.) হজরত হামজা (রা.) কে বললেন ঐ যে চেয়ে দেখুন। তিনি দৃষ্টি উঠিয়ে দেখলেন। হজরত জিবরাঈল (আ.) এর দেহ সবুজাভ পাথরের ন্যায় চমকাচ্ছিল। হজরত হামজা (রা.) এই ঔজ্জ্বল্য সহ্য করতে না পেরে বেঁহুশ হয়ে পড়ে গেলেন।- (ইতিহাসের দুর্লভ ঘটনাবলি)। 
হজরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম, এমন সময় সাদা ধবধবে কাপড় ও মিশমিশে কালো কেশধারী একজন লোক আমাদের কাছে হাজির হলেন। তার মধ্যে (আগন্তুকের ন্যায়) ভ্রমণের কোনো চিহ্নও দেখা যাচ্ছিল না। অথচ আমাদের মধ্যে কেউ তাকে চিনতেও পারল না। স্থানীয় হলে আমরা তাকে নিশ্চয়ই চিনতাম। তিনি নবী করিম (সা.)-এর কাছে এসে বসলেন।

অতঃপর রাসুল (সা.)-এর দুই জানুর সঙ্গে নিজের দুই জানু মিশিয়ে এবং নিজের দুই হাত তাঁর দুই ঊরুর ওপর রেখে বললেন, হে মুহাম্মদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন, (ইসলাম কী?) রাসুল (সা.) উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর রাসুলÑ এ ঘোষণা করবে, নামাজ কায়েম করবে, জাকাত দেবে, রমজানের রোজা রাখবে এবং বায়তুল্লায় হজ করবে। যদি তুমি সেখানে পৌঁছতে সমর্থ হও, এটাই হলো ইসলাম।’ তিনি বললেন, ‘ঠিক বলেছেন।’ তার প্রশ্নোত্তরে আমরা আশ্চর্যবোধ করলাম।

(অজ্ঞ লোকের মতো) প্রশ্নও করছেন আবার (বিজ্ঞের মতো) তার সমর্থনও করছেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে বলুন, ইমান কাকে বলে?’ হুজুর (সা.) উত্তর করলেন, ‘আল্লাহতে বিশ্বাস করবে এবং তাঁর ফেরেশতাগণে, তাঁর কিতাবসমূহে, তাঁর নবী-রাসুলগণে ও পরকালে বিশ্বাস করবে এবং তকদিরে, তার ভালো ও মন্দতে বিশ্বাস করবে।’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।

এখন আমাকে বলুন কিয়ামত সম্পর্কে (তা কবে হবে)।’ রাসুল (সা.) উত্তরে বললেন, ‘এ বিষয়ে যাঁকে প্রশ্ন করা হচ্ছে তিনি তার অপেক্ষা অধিক কিছু জানেন না, যিনি প্রশ্ন করেছেন তার চেয়ে।’ (অর্থাৎ আমি আপনার থেকে অধিক কিছু জানি না)। তিনি বললেন, ‘বাঁদি (দাসী) তার মালিককে জন্ম দেবে এবং (এককালের) উলঙ্গ পা, উলঙ্গ শরীর দরিদ্র মেষপালকদের (পরবর্তীকালে) দালানকোঠা নিয়ে পরস্পর গর্ব করতে দেখবে।’

হজরত ওমর (রা.) বলেন, অতঃপর লোকটি চলে গেল এবং আমি অনেকক্ষণ তথায় অপেক্ষা করলাম। এ সময় হুজুর (সা.) আমাকে বললেন, ‘ওমর! চিনলে প্রশ্নকারী লোকটি কে?’ আমি বললাম, (জি না, হুজুর)। আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই তা জানেন। হুজুর বললেন, ‘তিনি হচ্ছেন হজরত জিবরাঈল (আ.)। তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি তোমাদের কাছে এসেছিলেন।’ - (বুখারী, মুসলিম)।
হজরত জিবরাঈল (আ.) ২৪ হাজার বার দুনিয়াতে হুজুর (সা.) এর দরবারে এসেছিলেন, এক সাক্ষাতে হুজুর (সা.) জিবরাঈল (আ.) কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে জিবরাঈল! আমার ইন্তেকালের পরে তুমি কতবার দুনিয়াতে আসবে? তিনি বললেন, ১০ বার আসব এবং প্রতিবারই একটি করে জিনিস তুলে নেব।

তারমধ্যে ১. বরকত তুলে নেব। ২. ইবাদত থেকে মজা তুলে নেব। ৩. পরস্পর মহব্বত তুলে নেব। ৫. হক বিচার তুলে নেব। ৬. ছবর (ধৈর্য) তুলে নেব। ৭. আলেম থেকে সত্য কথা তুলে নেব অর্থাৎ একদল আলেম জানা সত্ত্বেও হক কথা বলবে না। ৮. ধনীদের সৎ সাহস উঠিয়ে নেব ৯. ইমানদার থাকবে না / ইমান উঠে যাবে। ১০. কারীদের কাছ থেকে কুরআনের তেলাওয়াত তুলে নেব/ অর্থাৎ কুরআনকে উঠিয়ে নেব।
আফসোস আমাদের সমাজে আর মাত্র সর্বশেষ ৯ ও ১০ নম্বরটি বাকি রয়েছে, যেদিন এ দুটি উঠে যাবে সেদিনই হবে শেষ সময়। আল্লাহ এ ভয়ানক সময়ে তুমি আমাদের হেফাজত কর। 

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×