
নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বছর পর্যন্ত ছিলেন সরকারের চোখে একজন ‘অপরাধী’। তবে সময় বদলেছে। সেই ড. ইউনূস আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে। প্যারিস অলিম্পিক চলাকালীন দেশে গণবিক্ষোভ যখন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছিল, তখন প্যারিসে অবস্থান করছিলেন ড. ইউনূস। দেশজুড়ে দমন-পীড়ন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা চলছিল বহু বছর ধরে। এমন এক সময়েই শুরু হয় ছাত্রদের আন্দোলন।
শুরুটা ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে। পরে তা রূপ নেয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক সর্বজনীন আন্দোলনে। প্রায় ১,৪০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে রাস্তায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার তখন গণধিকৃত। শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে ছাত্রনেতারা বারবার অনুরোধ করেন ড. ইউনূসকে দেশে ফিরে নেতৃত্ব দিতে। শুরুতে তিনি আপত্তি জানালেও শেষ পর্যন্ত সম্মত হন। দেশে ফিরে দায়িত্ব নেন ‘চিফ অ্যাডভাইজার টু দ্য গভর্নমেন্ট’ হিসেবে—একটি অস্থায়ী পদ। সংসদ বিলুপ্ত হওয়ায় তিনিই এখন রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান ব্যক্তি।
বর্তমানে তিনি বসবাস করছেন ঢাকার সুরক্ষিত এলাকা যমুনা গেস্ট হাউসে। Deseret News-এর প্রতিনিধি জে. ইভেনসেনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, “আমার দায়িত্ব এখন একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ তৈরি করা।”
তিনি যোগ করেন, “দেশের প্রশাসন এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত যে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই আমি সরকারি কার্যক্রমে ডিজিটাল মাধ্যম চালুর ওপর জোর দিচ্ছি, যাতে ঘুষ-দুর্নীতির সুযোগ কমে।”
‘জুলাই সনদ’: একটি ঐতিহাসিক রোডম্যাপ
নির্বাচনের আগে স্থায়ী সংস্কার নিশ্চিত করতে তিনি গঠন করেছেন ১৫টি রিফর্ম কমিশন। এসব কমিশন বিচার বিভাগ, পুলিশ, ব্যাংক খাত এবং সংবিধান সংস্কার নিয়ে সুপারিশ দিয়েছে।
ড. ইউনূস জানান, “এই সব সুপারিশ নিয়ে আমরা সব রাজনৈতিক দলের কাছে আলোচনা করছি। তারা কোন কোন সুপারিশে একমত তা লিখিতভাবে জানাবে। এরপর এই সমঝোতাকে ‘জুলাই সনদ’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে।”
এই সনদকে নির্বাচনের আগে একটি স্বচ্ছ ও জনমুখী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান তিনি। জনগণ যাতে জানতে পারে, কোন দল কোন সংস্কারে সম্মত হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিশ্রুতি না রাখলে জবাবদিহি করতে পারে।
সেনাবাহিনী ও রাজনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া
মাত্র কিছুদিন আগে সেনাবাহিনীর প্রধান ড. ইউনূসের সংস্কার কার্যক্রমের গতি নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ নিয়ে ড. ইউনূস পদত্যাগের কথা চিন্তা করলেও তার মন্ত্রিসভা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাকে সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে আনে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দ্রুত নির্বাচন চায়, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, অভিযোগ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করার
সম্প্রতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তদন্ত চলছে, দলটি কি না সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দিয়েছে এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে। ড. ইউনূস বলেন, “তারা দেশের জন্য শুধু দুর্নীতিই করেনি, বরং বিভ্রান্তি ও ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছে।”
সাবেক ক্ষমতাসীন দলের নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহিংসতার আশঙ্কা কম। বরং একে একটি ন্যায্য ও অনিবার্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন
ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে একটি নতুন বাংলাদেশ তৈরি করা। পুরোনো বাংলাদেশে আর ফিরে যাওয়া যাবে না।”
মিমিয়া