ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঘন কুয়াশায় শাহজালালে বিমানজট ॥ ৩৩ ফ্লাইটের সিডিউল বিপর্যয়

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭

ঘন কুয়াশায় শাহজালালে বিমানজট ॥ ৩৩ ফ্লাইটের সিডিউল বিপর্যয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এক সপ্তাহের মাথায় ফের ঘন কুয়াশায় অচলাবস্থা দেশের সব বিমানবন্দরে। মঙ্গলবার রাত সোয়া বারোটা থেকে বুধবার সকাল সোয়া দশটা পর্যন্ত এ অচলাবস্থা চলে। এ সময় দেশী বিদেশী অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মোট ৩৩ ফ্লাইট সিডিউল বিপর্যয়ের শিকার হয়। ওঠানামা করতে না পেরে ডাইভার্ট হয়েছে পাঁচটি, বিলম্বের শিকার হয়েছে ৯, বাতিল করতে হয়েছে ৫, রি-সিডিউল করতে হয়েছে ১৪ ফ্লাইট। এর মাশুল দিতে হয়েছে হাজারো যাত্রীকে। অনেকে নির্ধাতির ফ্লাইট ধরতেও ব্যর্থ হয়েছেন। বেলা সোয়া দশটার দিকে কুয়াশা কিছুটা কমায় ভিজিবিলিটি বাড়লে ফ্লাইট নামতে থাকে। দু’তিন মিনিট পর পর ফ্লাইট নামতে থাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরের এয়ারসাইটে দেখা দেয় বিমানজট। পরিস্থিতি অনেকটাই ছিল রাজপথের যানজটের মতোই ছিল। এ সময় হাজার হাজার যাত্রী আটকা পড়ে বিমানবন্দরে। এক সঙ্গে কমপক্ষে দশ হাজার যাত্রী শাহজালালে আটকা পড়ায় তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। চরম অনিশ্চয়তায় হাজার হাজার যাত্রী আটকা পড়ায় বিপাকে পড়ে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। আইএটিএ রুলস অনুযায়ী ৬ ঘণ্টার বেশি ফ্লাইট বিলম্ব হলে যাত্রীদের হোটেলে নিয়ে খাবার নিশ্চিত করা বাধ্যবাধকতা থাকলেও বুধবার অধিকাংশ যাত্রীই বঞ্চিত হয়েছেন এ অধিকার থেকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা উপবাস আর ন্যূনতম তথ্য সেবা না পাওয়ায় এক পর্যায়ে যাত্রীরা বিশৃৃঙ্খল ও মারমুখী হয়ে ওঠে। তখন এপিবিএন সদস্যরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালায়। এপিবিএন সিনিয়র এএসপি মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, হাজার হাজার যাত্রী নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খেতে হয়েছে। শাহজালালের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম জানিয়েছেন, ঘন কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। এটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এখানে মানুষের হাত নেই। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতি থাকতে পারে আরও দু’দিন। ফলে আজ বৃহস্পতি ও শুক্রবারও একই পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়ে গেছে। এ অবস্থা শুধু শাহজালাল নয়, সিলেট চট্টগ্রাম যশোর কক্সবাজার ও সৈয়দপুরে যাত্রীরা ফ্লাইট বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। সিভিল এভিয়েশন জানিয়েছে, শুধু কুয়াশা থাকলেই এমন বিপর্যয় দেখা দেয় না। এভিয়েশন ভিজিবিলিটি মারাত্মক কমে যাওয়ার কারণে এমন বিপর্যয়কর অবস্থা নেমে আসে। এটা প্রতিবছরই ঘটে। এবার একটু বেশি ঘটছে। মঙ্গলবার রাত এগারোটা থেকে কুয়াশা বাড়তেই থাকে আর ভিজিবিলিটি কমতে থাকে। এক পর্যায়ে তা এক হাজারের নিচে নেমে আসে। সাধারণত তিন হাজার মিটারের নিচে ভিজিবিলিটি থাকলে অতিরিক্ত সতর্কতা জারি করতে হয় বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ শেখ শাহজাহান আলম। যদিও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী বলেছেন, এটা সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বব্যাপী। তবে হিথ্রো জেএফকে ও দুবাই বিমানবন্দরসহ অনেক এয়ারপোর্টেই কুয়াশার মাঝেও উন্নতমানের প্রযুক্তিনির্ভর ফ্লাইট টেক অফ ও ল্যান্ড করার ব্যবস্থা রয়েছে। যার ফলে সেখানে ৮ মিটার ভিজিবিলিটির মাঝেও উড়োজাহাজ ওঠানামা করতে পারে। বিমানবন্দর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, জানুয়ারি পর্যন্ত কুয়াশার এই প্রকোপ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কুয়াশার কারণে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট চলাচলের বিপর্যয় ক্রমশই বাড়ছে। এদিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমি লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। বুধবার মধ্যরাত থেকেও বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ফের সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। বুধবার সকালে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, আগের রাত বারোটা থেকেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। রাত সোয়া বারোটায় থাইল্যান্ড থেকে আসা টিজি’র একটি ফ্লাইট ঢাকার কাছাকাছি এসেও নামতে পারেনি। ঘন কুয়াশার মাঝে অবতরণের সিগন্যাল না পেয়ে ব্যাঙ্ককে ফিরে যায়। একইভাবে বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত মোট ৩৩টি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের সময়সূচী পরিবর্তন হয়েছে। শুধু রানওয়ে ঠিকমতো দেখা না যাওয়ায় ২৪টি ফ্লাইটের জন্য নতুন সময়সূচী নির্ধারণ করতে হয়েছে। এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) তারিক আহমেদ জানান, দেশে প্রবেশের জন্য অপেক্ষমাণ সাতটি ফ্লাইট ও দেশ ছেড়ে যাওয়ার মতো ১৭টি ফ্লাইটের নতুন সূচী নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ ভারি কুয়াশার কারণে রানওয়ে দেখাই যাচ্ছিল না। এছাড়া নয়টি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের সময়সূচী পরিবর্তন বা পুনর্বিন্যাস করতে হয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা একেএম রেজাউল করিম বুধবার সকালে বলেন, কুয়াশার কারণে রাত ১২টা ৪০ থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত সব ধরনের ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখতে বাধ্য হন তারা। কুয়াশা কমার পর বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়। বেলা ১০টার পর থেকে আন্তর্জাতিক রুটেও চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু হয়। যে সময় শাহজালালে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ ছিল, ওই দশ ঘণ্টায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটের অন্তত ২০ ফ্লাইট নামার সূচী ছিল বিমানবন্দরের ওয়েবসাইটে। এর মধ্যে অন্তত ছয়টি ফ্লাইট ঢাকায় নামতে না পেরে অন্য বিমানবন্দরে চলে যায়। রাত বারোটা ৫৫ মিনিটে সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট ঢাকায় নামতে না পেরে কলকাতায় অবতরণ করে। চীনা একটি কার্গো বিমান রাত বারোটা ৫০ মিনিটে ঢাকায় নামতে না পেরে চলে যায় মান্দালয়ে। গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইট ভোর ৪টায় ঢাকায় নামতে না পরে কলকাতা চলে যায়। ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইট ঢাকার বদলে চট্টগ্রামে অবতরণ করে। এছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, চায়না সাউদার্ন, এমিরেটস, মালিন্দো এয়ার, কুয়েত এয়ার ও এয়ার এশিয়ার ফ্লাইটও নির্ধারিত সময়ে ঢাকা ছাড়তে পারেনি। রেজাউল করিম জানান, বাংলাদেশ সফররত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমকে নিয়ে একটি ভিভিআইপি ফ্লাইট সকাল সোয়া দশটার দিকে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হয়। বেলা এগারোটার দিকে ফ্লাইট ওঠানামা স্বাভাবিক হয়ে আসে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক আলী আহসান বাবু জানান, ঘন কুয়াশার কারণে বিমানের পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশী এয়ারলাইন্সও সমস্যায় পড়েছে। বিমানের বিজি ০৩৯ ফ্লাইটটি রাত সোয়া একটায় রিয়াদের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও কুয়াশায় যাত্রা বিলম্বিত হওয়ায় তা ছেড়ে যায় বেলা সাড়ে এগারোটার পরে। কলকাতা থেকে বিজি ০৯৬ ফ্লাইটটি সকাল সাড়ে দশটায় শাহজালালে পৌঁছানোর কথা থাকলেও সেটি বিলম্বিত হয়। বিমানের বিজি ৪১১ ফ্লাইটটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যায় নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা পর, সকাল সাড়ে নয়টায়। ঢাকা থেকে কক্সবাজারের বিজি ৪৩৩ ফ্লাইটটিও সকাল সাড়ে ৮টার বদলে দুই ঘণ্টা পর যাত্রা করে। এছাড়া কুয়ালামপুর থেকে সকালে ঢাকায় আসা বিজি ০৮৭ ফ্লাইটের পাইলটকেও কুয়াশার কারণে বাড়তি সময় কাটাতে হয় আকাশে। ফ্লাইট সিডিউল বিপর্যয়ের দরুন হাজার হাজার যাত্রী চরম দুর্ভোগে পড়ে। ওপরের বহির্গামী চেকইনস কাউন্টার ও নিচের আগমনী হলের আশপাশ বেল্ট এরিয়া ও ইমিগ্রেশন পয়েন্টে হাজার যাত্রী দর্শনার্থীকে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। কুয়াশা কমে যাওয়ায় ভিজিবিলিটি বাড়াতে থাকায় প্রায় একই সময়ে ফ্লাইট ওঠানামা করতে থাকে। এতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। প্রতিটি এয়ারলাইন্সকেই দায়িত্ব পালনে হিমশিম খেতে হয়। টানা দশ ঘণ্টাব্যাপী এয়ারপোর্টে অপেক্ষায় থাকা হাসনা হেনা বলেন, রাত বারোটায় এমিরেটসের দুবাই যাওয়ার জন্য তিন ঘণ্টা আগে আসি। সেই ফ্লাইটের বোডিংকার্ড হাতে পাই সকাল ৯টায়। এ সময়টা শুধু দাঁড়িয়ে আর হেঁটে কাটাতে হয়েছে। হাজার হাজার যাত্রী বসার মতো কোন উপযুক্ত চেয়ার বা অন্য কিছু ছিল না। কিছু সময় একটা ট্রলিতে বসে উঠে দাঁড়িয়েছি। এক পর্যায়ে আমি টয়লেট থেকে এসে দেখি সেটাও কে জানি নিয়ে গেছে। আর উপায় কি? সুমন নামের এক যুবক জানান, কুয়াশার কারণে এ বিপর্যয় এটা সবাই জানে। এটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কিন্তু এ জন্য কি আটকে পড়া যাত্রীদের জন্য ন্যূনতম সেবা পরামর্শ দেয়া হবে না? কোন্ ফ্লাইট কখন ছাড়বে কখন আসবে এতটুকু তথ্যও জানার অধিকার নেই যাত্রীদের? গতরাত থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত এ প্রশ্নের উত্তর কারোর কাছ থেকেই পাওয়া যায়নি। কোন নিরাপত্তা কর্মী বা কোন এয়ারলাইন্সের কাউকে পাওয়া যায়নি। কেউ কোন তথ্য দিতে পারছে না। কাউকে পাওয়া যায়নি। গোটা বিমানবন্দরের কোথাও নেই তথ্য প্রদানের সুব্যবস্থা। এ প্রতিনিধি সকাল নয়টায় শাহজালালের নিচতলায় গিয়ে দেখতে পান বিপুলসংখ্যক যাত্রী ইমিগ্রেশন বেল্ট ও কনকর্স এরিয়ায় গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো। হাঁটার কোন জায়গা ছিল না। সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করছে। বিশেষ করে সবারই একটাই জানার ছিল, ‘ফ্লাইট কখন যাবে কখন আসবে।’ কারোর কাছ থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে যাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে কর্তৃপক্ষকে গালাগালি করতে থাকে। এ সময় এপিবিএন এএসপি মিজান সেখানে গিয়ে তাদের শান্ত করতে চাইলে তারা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তিনি যখন সাহসিকতার সঙ্গে বেশ সজোরে বলতে থাকেন ঘন কুয়াশার কারণে এমন বিপর্যয় হয়েছে। কুয়াশা কেটে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এ সময় তিনি প্রাথমিক কিছু তথ্যাবলী উপস্থাপন করলে তারা শান্ত হন। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলার দরুন যাত্রীরা মারমুখী হয়ে ওঠে। গোটা বিমানবন্দরের কোথাও কোন তথ্য সেবা বা অনুসন্ধান দেখা যায়নি। যাত্রীদের দেখভাল করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের ও সিভিল এভিয়েশনের। বুধবার এদের কাউকেই দেখা যায়নি। জানতে চাইলে বিমানের মহাব্যবস্থাক নুরুল ইসলাম হাওলাদার জনকণ্ঠকে বলেন, রাত থেকে দৌড়াচ্ছি। কিভাবে সামাল দেব? এক সঙ্গে যদি ১৫ ফ্লাইট নামে তাহলে তাদের কিভাবে সেবা দেব? দাঁড়ানোর জায়গাই তো নেই। এদের লাগেজ দেব নাকি ওপরের চেকইন সেবা দেব? অবশ্য যাত্রীদের দেখভাল করার দায়িত্ব নিজ নিজ এয়ারলাইন্সের। এ বিষয়ে পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম বলেন, এটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এমন অবস্থায় ডিসরাপশন হবেই। তবে যাত্রীদের খাওয়া দাওয়া ও অনান্য সেবা দেয়ার দায়িত্ব এয়ারলাইন্সেরই। তারা হয়ত সেটা না দেয়ায় যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তথ্য কেন্দ্র না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনবলের অভাবে এটা চালু করা যাচ্ছে না। তবে এটা খুব শীঘ্রই চালু হবে। কাজ চলছে। যদি ফ্লাইট ইনফরমেশন সার্ভিস চালু রয়েছে।
×