ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তি চুক্তি নিয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতির পরস্পরবিরোধী বক্তব্য

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

শান্তি চুক্তি নিয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতির পরস্পরবিরোধী বক্তব্য

নিখিল মানখিন ॥ পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে চলছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। সরকার বলছে, সরকারী উদ্যোগগুলোর মধ্যে পৃথক মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন কমিটি, কমিশন ও টাস্কফোর্স গঠন, আইন প্রণয়ন, কিছুসংখ্যক সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার, ভারত প্রত্যাগত পরিবার এবং শান্তিবাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসন এবং চলমান আলোচনা উল্লেখযোগ্য । জেএসএস বলছে, দীর্ঘ সময় গতিহীন থাকায় সরকারী উদ্যোগগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে পাহাড়ীরা। বর্তমান সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন মৌলিক অগ্রগতি হয়নি। চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি বর্তমান সরকারের আমলে কেবল একের পর এক প্রতিশ্রুতি প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে আর কালক্ষেপণ মেনে নেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে জেএসএস। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিরাজমান পরিস্থিতি নিরসনের লক্ষ্যে-১৯৯৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতির কয়েক দফা সংলাপের পর সরকার গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটির পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত চুক্তি ৪ (চার) খন্ডে বিভক্ত। ক খন্ডে ৪ (চারটি), খ খন্ডে ৩৫ (পঁয়ত্রিশটি), গ খন্ডে ১৪ (চৌদ্দটি) এবং ঘ খন্ডে ১৯ (উনিশটি) সর্বমোট ৭২ (বাহাত্তরটি) ধারা রয়েছে। চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি পুরোপুরি বাস্তবায়িত : সরকার ॥ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ক খন্ডের ধারা, ১, ২, ৩ ও ৪, ‘খ’ খন্ডের ১, ২, ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ২০,২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ও ৩৩; ‘গ’ খন্ডের ১, ৭, ৮, ৯, ১০, ১২, ১৪ এবং ‘ঘ’ খ-ের ১, ৫, ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৯ ধারা মোট ৪৮ টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। আর ‘খ’ খন্ডের ৪ (ঘ), ৯, ১৯, ২৪, ২৭, ৩৪, ‘গ’ খন্ডের ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ‘ঘ’ খন্ডের ৪, ৬, ১৭, ১৮ নম্বর মোট ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ‘খ’ খন্ডের ২৬, ২৯, ৩৫; ‘গ’ খন্ডের ১১, ১৩ ‘ঘ’ খন্ডের ২, ৩, ৭, ৯, নম্বর ধারা মোট ৯টি ধারা বাস্তবান চলমান রয়েছে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে সরকার। সরকার পক্ষ বলছে, শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারাই ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চুক্তির বাকি ধারা বাস্তবায়ন করতে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলের লোক সরকারী চাকরি পেতে পারে, এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিভিন্ন নীতি ও আইন শিথিল করা হয়েছে। ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, এডিবি, ড্যানিডা, ইইউ, সিডা ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগির সহায়তায় পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন মেয়াদী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের মধ্য দিয়ে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। শান্তি ও উন্নয়নের পথ কখনই মসৃণ নয়। সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই দশক পূর্ণ হলো। পার্বত্য শান্তি চুক্তির অধিকাংশ ধারা পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং কয়েকটি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যে ধারাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। ‘ক’ খন্ডে ৪টি, ‘খ’ খন্ডে ৩৫টি, ‘গ’ খন্ডে ১৪টি এবং ‘ঘ’ খন্ডে ১৯টি অর্থাৎ সর্বমোট ৭২টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে মোট ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত, ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। চুক্তির অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার চুক্তির শর্তগুলো বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখায়নি। ফলে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শান্তি চুক্তির অবাস্তবায়িত ধারাগুলো বাস্তবায়ন এবং পার্বত্য এলাকার সর্বস্তরের জনগণের উন্নয়নে নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বর্তমানে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো অবাস্তবায়িত : পার্বত্য জনসংহতি সমিতি ॥ তবে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পার্বত্য জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ। তারা অভিযোগ করেন, সময়সূচী ভিত্তিক পরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণার মধ্য দিয়ে চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে বর্তমান সরকারের কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এ বিষয়ে বলেন, দেশ বিদেশের জনমতকে বিভ্রান্ত করতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে ‘অসত্য’ বক্তব্য প্রচার করে আসছে। বস্তুত মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। দু’-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো অবাস্তবায়িত রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের মধ্যে দায়সারা উদ্যোগ, চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে গড়িমসি এবং চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে অসত্য তথ্য প্রচার জুম্ম জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছে। এমন কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে, সরকার জুম্ম জনগণসহ পার্বত্যবাসীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় চরমভাবে অনাগ্রহী। সরকার নিজেই এখন চুক্তিবিরোধী হয়ে উঠেছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। জুম্ম জনগণের পিঠ আজ দেয়ালে ঠেকে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের যেকোন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা অভিযোগ করেন, প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেও শেখ হাসিনার সরকার চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকার একের পর এক চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। চুক্তির ২০ বছরেও জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট তথা জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব সংরক্ষণ নিশ্চিত হয়নি। চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইনসমূহ সংশোধন করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী ও বাঙালী স্থায়ী অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ গঠিত হয়নি। তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, মাধ্যমিক শিক্ষা, উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের হস্তান্তর করা হয়নি। সেটেলার বাঙালী, অস্থায়ী ব্যক্তি ও কোম্পানি, সেনাবাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভূমি বেদখল বন্ধ হয়নি এবং ফলে পার্বতাঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি। অপারেশন উত্তরণসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবত সেনাশাসনের অবসান হয়নি। ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের জায়গা জমি প্রত্যার্পণপূর্বক যথাযথ পুনর্বাসন প্রদান করা হয়নি। আর সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ও অত্যন্ত নাজুক। পার্বত্যবাসী বিশেষত জুম্ম জনগণ নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত এক চরম বাস্তবতার মুখোমুখি কঠিন জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। জুম্ম জনগণ এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে আজ সংকল্পবদ্ধ। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই বলে জানান সন্তু লারমা।
×