ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে অঙ্গ সংযোজনে এবারও ক্যাম্প বসেছে আগারগাঁওয়ে

কৃত্রিম পা লাগিয়ে দু’পায়ে ভর করে হাঁটার আনন্দে আত্মহারা হোসনে আরা

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১০ অক্টোবর ২০১৭

কৃত্রিম পা লাগিয়ে দু’পায়ে ভর করে হাঁটার আনন্দে আত্মহারা হোসনে আরা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) চলছে বিকলাঙ্গ ব্যক্তিদের কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন। রবিবার পঙ্গু হাসপাতালের নিচতলায় দেখ গেল, প্রায় ৪০ বিকলাঙ্গ ব্যক্তি অপেক্ষারত। ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, ছোট-বড় নানা যন্ত্রে ঠাসা একটি কক্ষ। টুং টাং শব্দ। রীতিমতো একটি কারখানা। কৃত্রিম পা তৈরির কারখানা। কক্ষে সবাই পা বানানোর কাজে ব্যস্ত। বাইরের একটি স্থানেও চলছে একই কাজ। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে রাসায়নিকের গন্ধ। কেউ মাপ নিচ্ছেন, কেউ নক্সা বানাচ্ছেন। কেউ খোলস তৈরি করছেন। কেউ বা ওই খোলসে যন্ত্রাংশ স্থাপন করছেন। আবার কেউ কেউ মানুষের হাঁটুর সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন কারখানায় তৈরি করা কৃত্রিম পা। এই কৃত্রিম পায়ে ভর করে হাঁটছেন একেকজন। হাঁটতে শুরু করতেই তাদের চোখ-মুখে ঝিলিক দেয় আনন্দ রাশি। নতুন করে জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দে বিভোর সবাই। বিশ্বে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন সংস্থা হিসেবে ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী খ্যাতি পেয়েছে ভারতীয় জয়পুর ফুটওয়্যার। মঈন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জয়পুর ফুটওয়্যারের সহযোগিতায় পঙ্গু হাসপাতালে তৃতীয়বারের মতো এ সংস্থাটি বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের সাহায্যার্থে ১৫ দিনের ক্যাম্পের মাধ্যমে পঙ্গু হাসপাতালে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করছে। গত বছর ‘জয়পুর ফুটওয়্যার’ বাংলাদেশের ১ হাজার ৪০০ প্রতিবন্ধীকে চিকিৎসার মাধ্যমে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করেছে। এ বছরের ক্যাম্প শুরু হয়েছে ২১ সেপ্টেম্বর থেকে। চলবে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত। এবার ১৪ টেকনিশিয়ানের একটি দল ভারত থেকে এসেছেন জয়পুর ফুটওয়্যারের সঙ্গে। মূলত, তাদের তত্ত্বাবধায়নে চলছে বিকলাঙ্গদের কৃত্রিম পা সংযোজন ব্যবস্থা। রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে যে কোন প্রতিবন্ধী এখানে উপস্থিত হয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে বিনামূল্যে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করতে পারছেন। অপেক্ষারত একজন হোসনে আরা। তিনি ফেসবুকে এ সংস্থাটির বিজ্ঞাপন দেখে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছেন। বি-বাড়িয়া থেকে আগত হোসনে আরা বর্তমানে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে ফার্মগেটের একটি আবাসিক হোস্টেলে আছেন। স্বপ্ন তার আকাশ ছুঁই ছুঁই। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে হাসপাতালে এসেছেন তিনি। হোসনে আরা জনকণ্ঠকে জানালেন, ‘মাত্র পাঁচ বছর বয়সে আমি আমার পা হারিয়েছি। এখন এক পা’তেই ভরসা। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে ভাল চিকিৎসাও হয়নি। যার ফলে হাঁটু থেকে পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তবুও দমে থামিনি আমি। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি।’ স্ক্র্যাচ নিয়ে চলাফেরা করা হোসনে আরা এখানে এসে তার কৃত্রিম পা পেয়েছেন। কিভাবে তিনি কৃত্রিম পায়ে ভর করে হাঁটবেন তাও শিখিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। আবার দুই পায়ে চলাফেরা করতে পারবেন হোসনে আরা এ আশা নিয়েই খুশি মনে হাসপাতাল ছাড়লেন তিনি। এ বছর ক্যাম্পে হোসনে আরার মতো ৩০০ প্রতিবন্ধী তাদের কৃত্রিম পা পেয়েছেন বলে জনকণ্ঠকে জানান, ভগবান মহাবীর বিকলাঙ্গ সহায়তা সমিতির মিডিয়া এ্যাডভাইজার জয়পুর প্রকাশ। তিনি জানান, ‘আমার টার্গেট ছিল প্রতিদিন ১৫ জনকে এ সহায়তা প্রদান করব। কিন্তু প্রতিদিন ২০-২৫ ব্যক্তি আসছেন। ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে এ কার্যক্রম। এবারের ক্যাম্পে আমরা ৭০০ প্রতিবন্ধীকে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের টার্গেট নিয়েছি।’ ভারতের জয়পুরের ভগবান মহাবীর বিকলাঙ্গ সহায়তা সমিতি ২০১৩ সালের রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণকারীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। তারা রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর ৫০০ জনকে কৃত্রিম পা সংযোজন করে দেয় বিনামূল্যে। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ক্যাম্পের মাধ্যমে ৬০০ জনকে এ সেবা দেয়া হয়। বিকলাঙ্গদের সহযোগিতা প্রসঙ্গে মঈন ফাউন্ডেশনের পরিচালক সাদিয়া মঈদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বিকলাঙ্গদের সহযোগিতার উদ্দেশে আমরা বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ফাউন্ডেশন ভারতের জয়পুরের ভগবান মহাবীর বিকলাঙ্গ সহায়তা সমিতির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তারা ঢাকায় আসে। বিভিন্ন সংস্থা ও পরিচিতদের কাছ থেকে ডোনেশন নিয়ে আমরা প্রতিবছর একটি ক্যাম্পের আয়োজন করি। যদিও প্রচুর বিকলাঙ্গ আমাদের এখানে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের জন্য আসেন। কিন্তু আমাদের সাধ্য সীমিত হওয়ায় অনেককে পরবর্তী বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বিগত তিন বছরে আমরা প্রায় দুই হাজার বিকলাঙ্গকে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করেছি।’ ‘আন্ডার প্রিভিলেজড চিলড্রেনস’ এডুকেশনাল প্রোগ্রামস (ইউসেপ) বাংলাদেশ এবং এ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের যৌথ সহযোগিতায় প্রতিবছর এ ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। ইউসেপ বিকলাঙ্গদের দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে এবং এ্যাপেক্স তাদের কৃত্রিম পা বিনামূল্যে প্রদান করে। বিনামূল্যে কৃত্রিম পা সংযোজন ক্যাম্পের আহ্বায়ক পঙ্গু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ শহীদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, কৃত্রিম পা সংযোজন হওয়া ব্যক্তিরা এখন স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে, দৌড়াতে, বসতে, সাঁতার কাটতে, উঁচু-নিচু রাস্তায়, এমনকি গাছেও উঠতে পারবেন। তিনি বলেন, এসব বিকলাঙ্গ বিনামূল্যে কৃত্রিম পা সংযোজনের উদ্দেশে প্রায় প্রতিবছরই এখানে উপস্থিত হন। তবে বছরের অন্যান্য সময়েও তারা এ বিষয়ে খোঁজ নিতে আসেন।’
×