ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধের ইঙ্গিত দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে উৎকণ্ঠা

ইয়াবার আগ্রাসন ঠেকাতে কঠোর আইন তৈরি ও প্রয়োগের বিকল্প নেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৭ জুলাই ২০১৭

 ইয়াবার আগ্রাসন ঠেকাতে কঠোর আইন তৈরি ও প্রয়োগের বিকল্প নেই

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মরণনেশা ইয়াবার আগ্রাসনে দেশের যুব সমাজসহ বিশাল একটি অংশ যখন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এবং সীমান্ত পাহারার কার্যক্রম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরা যখন কোনভাবেই এ ভয়াল নেশার চালানের পর চালান আসা রোধে সফলতা পাচ্ছেন না তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিলেন ‘ইয়াবা মহামারি আকার ধারণ করেছে।’ মন্ত্রীর এ বক্তব্য সাধুবাদ কুড়িয়েছে। কিন্তু এ আগ্রাসন রোধে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের স্থল সীমানা বিভাজনের নদী ‘নাফ নদী’তে বাংলাদেশী জেলেদের মাছ ধরা বন্ধের যে উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন তা নিয়ে সংশয়ের উদ্রেক করেছে সেখানকার সহ¯্রাধিক মৎস্য আহরণকারীর মধ্যে। উখিয়ার বালুখালি থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত নাফ নদীর বিস্তৃতি। উভয় দেশের জেলেরা স্ব স্ব সীমারেখার অভ্যন্তরে নাফ নদীতে মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ইয়াবা পাচার হয়ে আসা রুটের মধ্যে এ নদীও অন্যতম হওয়ায় এতে মৎস্য আহরণ তথা নৌ চলাচল বন্ধের চিন্তাভাবনা চলছে বলে মন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন শনিবার চট্টগ্রামে র‌্যাব সেভেন আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে। গণমাধ্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ইয়াবার দংশন থেকে দেশকে বাঁচাতে দীর্ঘ সময়জুড়ে সরকারের সকল মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। সরকার পক্ষে বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা ইয়াবাবিরোধী অভিযানে তৎপর। প্রতিনিয়ত যে হারে ইয়াবার চালান আসছে এর কিছু পরিমাণ মাত্র ধরা পড়ছে। অবশিষ্ট চালান কখনও ফাঁকফোকরে, কখনও বোঝাপড়ার মাধ্যমে গন্তব্যে যে পৌঁছে যাচ্ছে একথা অস্বীকার করার কোন জো নেই। ফলে দেশের যুব সমাজসহ বড় একটি অংশ ইয়াবা সেবন করছে এবং নতুন নতুন পর্যায়ে আগ্রহী হচ্ছে। এ আগ্রাসন রোধে নাফ নদীতে জেলেদের মাছ ধরা বন্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সুফল আসবে কিনা তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, নদী ও সাগর পথ নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা বিভাজিত। এ দু’পথেই প্রতিনিয়ত ইয়াবার চালান আসছে। বড় বড় চালান আসছে মিয়ানমারের মংডু ও সিটওয়ে বন্দর হয়ে। এসব মাদকের অবৈধ চালান আসছে টেকনাফের স্থলবন্দর হয়ে। এ বন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে মৎস্যসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেমন আমদানি হয়ে থাকে, অনুরূপভাবে বাংলাদেশ থেকেও বিভিন্ন ধরনের পণ্য মিয়ানমারে রফতানি হয়ে থাকে। ফলে বৈধ রুটে অবৈধ পণ্যের মধ্যে ইয়াবার চালানও ঢুকছে প্রতিনিয়ত। কাঠের নৌকা, ট্রলার, ইঞ্জিনচালিত বোটসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযানে আমদানি পণ্য এসে থাকে। এর অভ্যন্তরে এসব চালান লুক্কায়িত থাকে বিশেষভাবে। তন্মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মৎস্য বোঝাই ড্রাম অন্যতম। মিয়ানমারের সিটওয়ে ও মংডু বন্দর দিয়ে কক্সবাজার ও টেকনাফের চোরাচালানি চক্র এসব চালান নিয়ে আসে দেশের ওই স্থল বন্দরে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সরকারী পর্যায়ে সকল সংস্থার সঙ্গে নানাভাবে বোঝাপড়া বা তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ চালান খালাস হয়ে চট্টগ্রাম এসে তা বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে ইয়াবা নিয়ে যে বক্তব্য বেরিয়ে এসেছে তা শতভাগ সত্য। তিনি সোজাসাপ্টা স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশে কোন মাদক তৈরি না হলেও বিভিন্ন ধরনের মাদক বিভিন্নভাবে আসছে। তিনি এও বলেছেন, ইয়াবার চালান রোধে মিয়ানমার সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করেও এ পর্যন্ত কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। ফলে প্রতীয়মান হয় যে সে দেশের সরকারী পর্যায়ের বিভিন্ন মহল ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মন্ত্রী বিষয়টি একেবারে পুরোপুরি না হলেও যা স্পষ্ট করেছেন তা প্রমাণ করছে ইয়াবা আসার নেপথ্যের ঘটনা। বর্তমানে ইয়াবা এদেশের জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথা হয়ে আছে। সরকারী পর্যায়ে মন্ত্রীর এ ধরনের উদ্বেগের বিপরীতে প্রশ্ন উঠেছে নাফ নদীতে জেলেদের মাছ আহরণ বন্ধ করা হলে ইয়াবার চালান আসা আদৌ রোধ হবে কিনা। কেননা, বিশাল সমুদ্রপথে ট্রলারসহ বিভিন্ন নৌযানে মাদকের এ চালান এসে থাকে। পাশাপাশি-আমদানি রফতানির বৈধ রুটেও স্থলবন্দর হয়ে আসছে। সঙ্গত কারণে প্রশ্নটি উঠেছে, নাফ নদীতে মৎস্য শিকার বন্ধ করে সহ¯্রাধিক মৎস্য আহরণকারীর ভবিষ্যত নিয়ে। আরও প্রশ্ন উঠেছে, মাদকের বিষয়টির নেপথ্যে রয়েছে দেশীয় চোরাচালানি চক্রের অবাধ তৎপরতা। বর্তমানে ইয়াবার সঙ্গে জড়িত ১০ লিস্টেড গডফাদার। আর ৩০টিরও বেশি রয়েছে সিন্ডিকেট। পাশাপাশি ক্যারিয়ার রয়েছে শত শত। যাদের অধিকাংশ মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কক্সবাজার অঞ্চলের অনেকে। রাতারাতি অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকার কারণে দিন দিন ইয়াবার মতো মরণ নেশার অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে বিত্তশালীদের বিনিয়োগ যেমন বাড়ছে তেমনি এর ক্যারিয়ারের সংখ্যাও বাড়ছে। ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজদের বড় একটি অংশও এর সঙ্গে জড়িত হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অতীতে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় উৎপাদিত ফেনসিডিল বাংলাদেশের যুব সমাজকে গ্রাস করেছিল। কূটনৈতিক পর্যায়সহ বিভিন্নভাবে ভারত সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা আরোপিত হওয়ায় ফেনসিডিল আসার ঢেউ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। একথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। তিনি এ প্রস্েঙ্গ হেরোইনের কথাও টেনেছেন। কিন্তু উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইয়াবা নিয়ে। মূলত ইয়াবার আগ্রাসন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা সত্যিই সরকারসহ সকলের জন্য বড় ধরনের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, মরণনেশা ইয়াবার ছোবলের নেপথ্যে রয়েছে যা তা হচ্ছে ‘ঘরের শত্রুই বিভীষণ।’ এসব ঘরের শত্রু অর্থাৎ ইয়াবা চোরাচালানের গডফাদার ও সিন্ডিকেট সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তা কার্যকর করা না গেলে এর সফলতা আসার সম্ভাবনা একেবারেই তিরোহিত। পুলিশের উচ্চপর্যায় থেকে বহু আগেই ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত গডফাদার, সিন্ডিকেট সদস্য ও বিভিন্ন পর্যায়ের ক্যারিয়ারদের নাম নিয়ে একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ইয়াবা চালানের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে যারাই ধরা পড়েছে তারা মূলত ক্যারিয়ার। এসব ক্যারিয়ার জীবন- জীবিকা নির্বাহের জন্য এ পথে পা বাড়িয়ে থাকে। কিন্তু অসাধু পথে বিত্তের পাহাড় গড়ে তোলার জন্য যেসব গডফাদার এ অবৈধ ব্যবসার জন্য বিনিয়োগ করে থাকে এবং সিন্ডিকেট সদস্যরা এটিকে বিস্তৃত করছে তারা কেউ ধরা পড়ছে না। ফলে ইয়াবার আগ্রাসনও থামছে না। সরকারী পর্যায়ে মিয়ানমারের মংডু এলাকাজুড়ে যে ৩৭টি ইয়াবা উৎপাদন কারখানার কথা সে দেশের সরকারকে জানানো হয়েছে তা নিয়ে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি সে দেশের সরকার। কেননা, এরসঙ্গে জড়িয়ে আছে সে দেশের সেনা, সীমান্তরক্ষী ও পুলিশের বাঘা বাঘা কর্মকর্তা। এদের বিনিয়োগেই গড়ে উঠেছে ওসব ইয়াবা উৎপাদন ফ্যাক্টরি। মূলত ৩৭টি বলা হলেও ছোট ছোট আরও ৪টি কারখানা রয়েছে বলে দাবি রয়েছে। এসব ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত ইয়াবা মূলত বাংলাদেশেই চোরাইপথে চালান হয়ে আসছে। দেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা ইয়াবার চালান রোধে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। তারপরও চালানের ছোটবড় যেসব অংশ ধরা পড়ছে তারচেয়ে বহুগুণ বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে। এমনিতর পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাফ নদীর বাংলাদেশ অংশে দেশীয় জেলেদের মাছ ধরা বন্ধের চিন্তাভাবনার যে জানান দিয়েছেন তা পরীক্ষামূলক বলে মন্তব্য করেছেন। বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যদি এ চিন্তাভাবনা কার্যকর করা হয় তাতে সহ¯্রাধিক মৎস্য আহরণকারীর জীবন-জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের আঘাত আসবে। এরপরও সমুদ্র পথ তো খোলাই রয়েছে। আর আমদানি-রফতানির বৈধ রুট অর্থাৎ সীমান্ত স্থল বন্দরও তো উন্মুক্ত রয়েছে। নাফ নদী ছাড়া এ দুই পথেও ইয়াবার চালান আসছে প্রতিনিয়ত। নাফ নদীতে মৎস্য আহরণ বন্ধ করা গেলে বিজিবির নজরদারি প্রক্রিয়ায় সুফল আসবে সত্য, কিন্তু সমুদ্র পথ ও স্থল বন্দর দিয়ে যে ইয়াবার চালান আসছে তা রোধ করা যাবে কিভাবে? সূত্রে সর্বশেষ তথ্যে বেরিয়ে এসেছে, মিয়ানমার থেকে চিংড়িসহ মাছ আমদানির ড্রামযোগেও ইয়াবা আসছে। বিশেষ করে সে দেশের সিটওয়ে ও মংডু হয়ে পরিপূর্ণ চিংড়ি ও মাথাকাটা চিংড়ির চালানের সঙ্গে ইয়াবার চালান এসে থাকে। মাথাকাটা চিংড়ি দেশের চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় আনার ক্ষেত্রে সরকারী নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও আসছে। ড্রামের উপরিভাগে বরফযুক্ত চিংড়ি থাকে। নিচে রাখা হয় প্যাকেটজাত ইয়াবা। মৎস্য কর্মকর্তারা আমদানিকৃত মাছের চালান ফরমালিনমুক্ত বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছে। কিন্তু ড্রামের নিচের অংশে ইয়াবার চালান রয়েছে তা তারা পরীক্ষা করে দেখেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেকের দাবি টাকার অঙ্কে দফারফা করে এসব চালান খালাস করা হয়। কক্সবাজারের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট মাথাকাটা চিংড়ির চাহিদা রয়েছে বলে তা মিয়ানমার থেকে আমদানি করে থাকে। এ আমদানি প্রক্রিয়ায় মন্ত্রণালয় থেকে পারমিট গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে মাথাকাটা চিংড়ি আমদানি আপাতত বন্ধ রয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি আসছে ব্যাপকহারে। ড্রামভর্তি চিংড়ির চালানেই থাকছে ইয়াবা। এছাড়া বর্তমান সময়ে মিয়ানমারে উৎপাদিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিয়ারও আসছে। মরণনেশা ইয়াবা নিয়ে গণমাধ্যমে নানা তথ্য প্রকাশ হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। সরকারী পর্যায়ে এ নিয়ে তৎপরতা রয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন গলদ থেকেই যাচ্ছে। এরমধ্যে অন্যতম একটি বিষয় আলোচিত হচ্ছে আইন ও এর কার্যকারিতা নিয়ে। বলা হচ্ছে, ইয়াবার ছোবল থেকে রক্ষায় কঠোর আইন ছাড়া কোন বিকল্প নেই। প্রয়োজনে মৃত্যুদ-ের আইন করে হলেও এদেশের যুব সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে রক্ষার ক্ষেত্রে তৎপর হওয়া বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি ইয়াবা চোরাচালানের গডফাদার ও সিন্ডিকেট সদস্য ও ক্যারিয়ারদের কঠোর আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিধান করা ছাড়া এর বিকল্প আর কোন পথ খোলা নেই।
×