ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুই দুর্বৃত্তের হাতে যুবলীগ নেতা খুনের জের

লংগদুতে পাহাড়ী-বাঙালী উত্তেজনা- অগ্নিসংযোগ, ১৪৪ ধারা জারি

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৩ জুন ২০১৭

লংগদুতে পাহাড়ী-বাঙালী উত্তেজনা- অগ্নিসংযোগ, ১৪৪ ধারা জারি

চট্টগ্রাম অফিস/রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি ॥ রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন হত্যাকা-ের ঘটনায় সেখানকার পাহাড়ী-বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। শতাধিক দোকান ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ হয়েছে। বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছে ২৫। উপজেলাজুড়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বড় ধরনের সহিংস ঘটনার আশঙ্কায় রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে উপজেলা প্রশাসন শুক্রবার দুপুর থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেছে। এছাড়া উপজেলাজুড়ে পুলিশের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিজিবি ও সেনা সদস্যদের টহল জোরদার করা হয়েছে। সংঘটিত ঘটনার নেপথ্যের তথ্যে জানা গেছে, নিহত নুরুল ইসলাম নয়ন (৩৫) মূলত মোটরসাইকেলযোগে যাত্রী বহন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি লংগদু উপজেলা ইউনিয়নের যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বলে দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে প্রাপ্ত ঘটনার বিবরণ অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টায় নয়ন তার মোটরসাইকেলের পেছনে ২ জন পাহাড়ী যুবককে ভাড়ায় নিয়ে খাগড়াছড়ি রওনা হয়। খাগড়াছড়ি সীমানা অতিক্রম করার ৪ থেকে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে ওই দুই পাহাড়ী যুবক তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এরপর তার মোটরসাইকেলটি নিয়ে ওই দুই দুর্বৃত্ত পালিয়ে যায়। নিহত নয়নের বাড়ি লংগদু উপজেলার বাইত্যাপাড়ায়। হত্যাকা-ের প্রায় ১০ ঘণ্টা পর খাগড়াছড়ি পুলিশ নয়নের লাশ উদ্ধার করে লংগদু থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। নয়ন হত্যাকা-ের খবর ছড়িয়ে পড়লে বাঙালীদের মাঝে উত্তাপ সৃষ্টি হয়। পাহাড়ীদের অভিযোগ, রাতেই বাঙালীদের পক্ষে একযোগে পাহাড়ীদের ঘরবাড়িতে আক্রমণ করে এবং আগুন দেয়া হয়। ফলে বহু পাহাড়ী ঘরবাড়ি ফেলে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এদিকে, শুক্রবার দুপুরে নিহত নুরুল ইসলাম নয়নের জানাজা ও দাফন কার্যক্রম চলাকালে পাহাড়ী দুর্বৃত্তরা বাঙালী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ ঘটায়। এ ঘটনায় প্রায় ৭০টি দোকান ও বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়। মূলত, বৃহস্পতিবার নয়নকে হত্যার পর থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। রাতে একদফা বিক্ষুব্ধ বাঙালীরা পাহাড়ীদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। এরপর শুক্রবার দুপুরে পাহাড়ীরা বাঙালী জনঅধ্যুষিত এলাকায় অনুরূপ হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ বাঙালীরা স্থানীয় জনসংহতি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া বাঙালীরা লংগদু সদরের তিনটিলা, কাঁঠালতলা, বড়াদম, মানিকদিছড়া এলাকায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। এসব ঘটনা স্বীকার করেছেন স্থানীয় সেনা, বিজিবি, উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসন সূত্র। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক ১৪৪ ধারা জারি করার কথা জানিয়ে জনকণ্ঠকে জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অর্থাৎ বহিরাগত মানুষের আসা-যাওয়া বন্ধে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাঙ্গামাটির সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা উষাতন তালুকদার ও জেলা পরিষদ সদস্য জানে আলম জানিয়েছেন ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া জুনুবালা চাকমা (৭০) নামের একজন পাহাড়ী নিহত হয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়লেও শুক্রবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তা কোন সূত্রেই নিশ্চিত করা যায়নি। অপরদিকে, বিক্ষুব্ধ বাঙালীরা লংগদু ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ ঘটিয়েছে। এ সময় ৫ জন আহত হয়েছে। আহতদের লংগদু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। লংগদুর পরিস্থিতি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে মঙ্গল কুমার চাকমা স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে, উপজেলা সদরের তিনটিলা ও পার্শ¦বর্তী মানিকজোড় ছড়ায় সেটেলার বাঙালীরা পাহাড়ীদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুটপাট চালিয়েছে। জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে এর তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে আরও দাবি করা হয়েছে তিনটিলা এলাকায় পাহাড়ীদের দুই শতাধিক বাড়িঘর ও দোকানপাট এবং মানিকজোড় ছড়ায় ৪০টি ঘরবাড়িসহ সবমিলে ২৫০ ঘরবাড়ি ও দোকানপাট বাঙালীদের হামলার শিকার হয়েছে। জনসংহতির আরও দাবি, নুরুল ইসলাম নয়ন নামের একজন সেটেলার বাঙালীর লাশ উদ্ধারের ঘটনা কেন্দ্র করে স্থানীয় বাইত্যাপাড়া থেকে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে লংগদু এলাকার তিনটিলা এলাকায় পৌঁছলে কোন উস্কানি ছাড়াই স্থানীয় জনসংহতি সমিতির অফিস ও পাহাড়ীদের বাড়িঘরে হামলা ও আগুন দেয়া হয়। অপরদিকে, এ ঘটনার প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি ও লংগদুতে যুবলীগের পক্ষ থেকে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, হত্যাকা-ে জড়িত দুই পাহাড়ী দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। যুবলীগের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। শুক্রবার বেলা ১১টায় বাঙালী ছাত্র পরিষদ (পিবিসিপি) শহরের শাপলা চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে আদালত সড়ক প্রদক্ষিণ করে একইস্থানে গিয়ে শেষ হয়। মিছিল শেষে তারা মানববন্ধন কর্মসূচীও পালন করে। এতে মূল বক্তব্য রাখেন পিবিসিপির নেতা আবদুল মজিদ। এ কর্মসূচী থেকে আজ শনিবার খাগড়াছড়ির প্রতিটি উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের গ্রেফতার করা না হলে আরও বৃহত্তর কর্মসূচী দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। লংগদু থানার ওসি মোঃ মমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতেই প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেছে। এছাড়া মারিশ্যা থেকে বিজিবির একটি দল আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি স্থানীয় সেনা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সতর্কাবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে আরও দাবি করা হয়েছে, এ ঘটনার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী সমর্থকরা একযোগে পাহাড়ীদের ওপর হামলা চালিয়েছে, বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। কিন্তু বাঙালীদের পক্ষ থেকে এ ধরনের দাবি অস্বীকার করে বলা হয়েছে, মূলত ঘটনার পর তা অন্য খাতে প্রবাহিত করতে লংগদুর বিভিন্ন স্থানে জনসংহতি সমিতির দুর্বৃত্তরা পাহাড়ীদের বাড়িঘর থেকে সরিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এছাড়া, শুক্রবার নয়নের জানাজা শেষে দাফন কার্যক্রম চলাকালে এলাকায় যে দোকানপাট ও বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে সেখানে বাঙালীদের মালিকানার বাড়ি ও দোকানপাটও রয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি করার পর এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরিস্থিতি উত্তপ্ত অবস্থায় রয়েছে বলে সবকটি সূত্রে স্বীকার করা হয়েছে। বিকেলে পাহাড়ী-বাঙালী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এবং প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে সভা হয়েছে। পরিস্থিতি যেন কোন অবস্থাতেই অবনতির দিকে না যায় এ জন্য সকলকে একযোগে তৎপরতা চালাতে ঐকমত্যের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে, পাহাড়ের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, যুবলীগ নেতা নয়ন হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের সুযোগ সন্ধানীরা এ ঘটনাকে পুঁজি করে বড় ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টির তৎপরতা চালাচ্ছে। এ অবস্থা আঁচ করতে পেরেই পাহাড়ী-বাঙালীদের নিয়ে উপজেলা ও সেনা প্রশাসন যৌথসভা করেছে। লংগদু উপজেলা প্রশাসন সূত্রে বিকেলে জানানো হয়েছে, যারা এ ঘটনার নেপথ্যে ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশন অফিস সূত্রে এ পরিস্থিতি নিয়ে জানানো হয়েছে, তারা বিষয়টি সর্বোচ্চ নজরদারিতে রেখেছেন। সেখানকার জোন কমান্ডারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। বিজিবির পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, কোন অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে সে জন্য মারিশ্যা থেকে বিজিবির একটি দলকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে।
×